সিলেটে ‘এসকর্ট সার্ভিসের’ দৌরাত্ম
প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০৫:১৩ অপরাহ্ন
অনলাইনে দেহ ব্যবসা
এ টি এম তুরাব :
‘হাই বন্ধুরা! আমি এখন অনলাইনে আছি, আমাকে কল বা ম্যাসেজ দাও- আমি তোমাদের সাথে কথা বলবো, তোমাদের সাথে ইনজয় করবো’। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন গ্রুপে এভাবেই বার্তা দিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছে একটি চক্র। তারা সুন্দরী নারীদের ছবি ও ভিডিও দিয়ে ফাঁদ তৈরি করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এছাড়া প্রবাসীদের ইমু হ্যাক করে তাদেরকে ব্ল্যাকমেইল এবং স্বজনদের কাছ থেকে বিভিন্ন কৌশলে টাকা হাতিয়েছে।
জানা যায়, উচ্চ আদালতের নির্দেশে দেশে পর্নোসাইট বন্ধ হলেও সরকারের একাধিক সংস্থার নামকাওয়াস্ত তদারকিতে বেড়েই চলেছে ভার্চুয়াল অপরাধ। বিটিআরসি, পুলিশসহ পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিট, মাদকদ্রব্য ডিএনসিসহ একাধিক সংস্থার দুর্বল তদারকিতে ক্রমেই বাড়ছে ভার্চুয়াল অপরাধ। যদিও পৃথকভাবে প্রত্যেকটি সংস্থাই দাবি করছে, এসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণে তারা সবসময়ই তৎপর। অথচ বাস্তবের সাথে সংস্থাগুলোর বক্তব্যের মিল নেই।
এরই মধ্যে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গড়ে উঠেছে এসকর্ট সার্ভিস প্রোভাইডারদের শক্তিশালী সিন্ডিকেট। যেখানে অনায়াসে মিলছে দেহব্যবসার সুযোগ, গড়ে উঠছে মাদক বেচাকেনার প্ল্যাটফর্ম। যদিও এসব বিষয়ে জানা নেই সংস্থাগুলোর। জানতে চাইলে উল্টো সুনির্দিষ্ট তথ্য থাকলে জানানোর অনুরোধও করছে কোনো কোনো সংস্থা।
এদিকে ফেসবুক, ইমো ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গড়ে উঠেছে এসকর্ট সার্ভিস প্রোভাইডারদের গ্যাং। আর এই ভয়ংকর সাইবার ক্রাইমে জড়িয়ে পড়ছেন একশ্রেণির তরুণ-তরুণী। এ তালিকায় রয়েছেন শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী, চাকুরীজীবীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ। তাদের মধ্যস্থতায় টাকার বিনিময়ে অনায়াসেই নারী-পুরুষরা পাচ্ছে অনৈতিক মেলামেশার (দেহব্যবসা) সুযোগ।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকার পর এবার সিলেটে এসকর্ট সার্ভিসের দৌরাত্ম্য বাড়ছে। ফেসবুক পেজ কিংবা গ্রুপের মাধ্যমে বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নারীদের সংগ্রহ করে তাদের ছবি প্রদর্শনীর মাধ্যমে খদ্দের সংগ্রহ করছে সার্ভিস প্রোভাইডাররা। সপ্তাহের ২৪ ঘণ্টাই অনলাইনে সক্রিয় থাকে এই চক্র। ফোন কিংবা ম্যাসেজ করলেই সাড়া মিলছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, শুরুতেই বিকাশের মাধ্যমে টাকা পেমেন্ট করে মেম্বারশিপ নিতে হয়। এরপরই ক্যাটাগরি অনুয়ায়ী নারী দেখে নির্বাচন করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রযুক্তির ছোঁয়ায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ ও ইমো এই জনপ্রিয় যোগাযোগ মাধ্যমগুলো এখন অসামাজিক কাজের রঙ্গমহল। ডে/নাইট কথিত লাস্যময়ীদের দিয়ে রমরমা ইনকল আউট কল এসকর্ট সার্ভিসের নামে চলছে ডিজিটাল প্রতারণায়। বিভিন্ন লাস্যময়ীর মুখলুকানো অশ্লীল ছবি ব্যবহার করে এসকর্ট সার্ভিস এজেন্সি কিংবা নিজেই অনলাইন মার্কেটিংয়ে অনেকটা ওপেন সিক্রেট ভাবেই। এজেন্সির সার্ভিস নিতে হলে, এজেন্সির মেম্বার হতে হবে বাধ্যতামূলক।
সিলেটে অনলাইন এসকর্ট সার্ভিসের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ‘রিয়েল সার্ভিস সিলেট, জাহান তানহা ও সিলেটী কাপল ব্লগ, কল বয় সিলেট, সিলেট ট্যুর কাপল পার্টনার সার্ভিস’সহ অর্ধশতাধিক পেইজ ও গ্রুপ। এছাড়া ইমুতেও রয়েছে অসংখ্য ভয়েস ক্লাব। যেখান থেকে নারীরা পছন্দ করে পুরুষ, পুরুষরা নারী।
এসব ফেসবুক পেইজ ও গ্রুপে রয়েছে সুন্দরী নারীদের ছবি আর তাদের বিভিন্ন তথ্য। এতে বলা আছে, একটি নির্দিষ্ট টেলিফোন নাম্বারে যোগাযোগ করলে, যে কেউ অর্থের বিনিময়ে সুন্দরীদের সঙ্গে সময় কাটাতে পারবেন।
প্রতিবেদনের স্বার্থে কাস্টমার সেজে প্রতিবেদক ‘জাহান তানহা’ নামের একজনের সাথে ম্যাসেঞ্জারে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন শর্ত মানলে রিয়েল ছবি পাঠাবেন। বিশ্বাসের কথা বলতেই সিলেট নগরীর শিবগঞ্জ এলাকার ঠিকানা লাস্যময়ীকে সরাসরি পছন্দ করে সার্ভিস নেওয়ার কথা বলেন।
মেসেঞ্জারে কয়েক জনের মধ্যে ‘তুমি শুধু আমার’ নামের এক জনের সাথে যোগাযোগ করলে নিজেকে জাহান সাদিয়া নামে পরিচয় দেন। সার্ভিস নেওয়ার কথা বললে এডভান্স ৫০০ টাকা ০১৭৮৬ ৪৫০ ০২৪ বিকাশ করতে বলেন। এরপর বন্দরবাজারের একটি বাসার ঠিকানায় দিয়ে ছবি পাঠান। পরে বিকাশে টাকা পাঠিয়ে সেই মোবাইল নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। পাশাপাশি যে ফেসবুক থেকে ম্যাসেঞ্জারে চ্যাটিং করা করা সেটিও ব্লক করে দেয়া হয়। এরকম নামে বেনামে ফেসবুক আইডি খুলে প্রতারণা করছে বিভিন্ন চক্র। এ ডিজিটাল অনলাইনে প্রতিনিয়ত প্রতারণার শিকার হচ্ছে মানুষ।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে প্রতারণার শিকার এক ব্যবসায়ী এ প্রতিবেদককে জানান, সার্ভিস নিতে ইচ্ছে প্রকাশ করলে প্রথমে মেম্বারশিপ ফি বিকাশ পেমেন্টে করতে হয়। মেম্বারশিপের টাকা না দিলে কোন তথ্য কিংবা ছবিও দেখতে পাবেন না। শুধুমাত্র মেম্বারশিপের টাকা পেমেন্ট করলে ছবি দেখে পছন্দ করে সার্ভিস নিতে পারবেন।
তিনি আরো বলেন, পছন্দের লাস্যময়ীকে ৩ ঘন্টা পেতে হোম সার্ভিস/আউটকল ৭ হাজার টাকা এবং নাইট ইন কল বা তাদের প্লেসে সময় কাটাতে ১০ হাজার। শর্ত মেনে মুঠোফোনে যোগাযোগ করে নগরীর মীরাবাজার দাদা পীরের মাজার এলাকায় গেলে। সেখানে যাওয়ার পর দুই যুবক এসে বলে একটু সামনে আসেন। একথা বলার পর একটি গলির ভেতরে ঢুকতেই ওই দুই যুবক পকেট থেকে ছুরি বের করে বলে সাথে যা আসে দিয়ে দিতে। এরপর মোবাইল ও নগদ টাকা নিয়ে তারা সটকে পড়ে।
এ ব্যাপারে র্যাব-৯ এর মিডিয়া উইং সিনিয়র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আফসান-আল-আলম দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, র্যাবের পাশাপাশি পুলিশের সাইবার ক্রাইম বিভাগ এসব বিষয়ে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করছে। এর মাঝেও প্রতারকচক্র তাদের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। র্যাব এ বিষয়ে মনিটরিং করছে। নজরে আসা মাত্রই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।