শেয়ার বাজারে শেয়াল-কুকুরের দোস্তী!
প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০১:২৩ অপরাহ্ন
গতকাল একটি জাতীয় দৈনিকে ‘করুণ পরিস্থিতিতে শেয়ারবাজার’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, চোখের সামনে লাখ লাখ বিনিয়োগকারী একটু একটু করে পুঁজি হারাচ্ছেন। কিন্তু কিছুই করতে পারছেন না। এ অবস্থায় শেয়ারবাজারের লেনদেন ফের ২শ’ কোটি টাকার ঘরে নেমেছে। প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স নেমে এসেছে ৬১০০ পয়েন্টের ঘরে। ৯৫ শতাংশ বাজার মূলধনের শেয়ারগুলোর দরে ফ্লোর প্রাইস আরোপের পর সূচক পতনের আর তেমন জায়গা নেই। তারপরও প্রতিদিনই ১০ থেকে ১৫ পয়েন্ট করে হারাচ্ছে সূচক।
গত বৃহস্পতিবার প্রধান শেয়ার বাজার ডিএসইতে তালিকাভুক্ত ৩৯০ শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডের বেচাকেনা হয়েছে ৫ থেকে ১০টি করে শেয়ার। সর্বনি¤œ দরসীমা বা ফ্লোর প্রাইস আরোপ করা শেয়ারগুলোর দর হারানোর সুযোগ না থাকলেও বাকীগুলোর দর কমেছে। মাত্র ৭টি শেয়ারের দর বাড়ে গত বৃহস্পতিবার। বিপরীতে দর কমে ১৫০টির। অপরিবর্তিত ছিলো ১৫৪ টির। আর ক্রেতার অভাবে ৭৯টি শেয়ারের কোন কেনাবেচা হয়নি। বাকী ১৪২ শেয়ারের ১০ লাখ টাকারও শেয়ার কেনাবেচা হয়নি। সংশ্লিষ্টদের মতে গত কয়েক মাস ধরে এ অবস্থা চলছে। সামান্য মুনাফার আশায় যে বিনিয়োগকারীরা শেয়ারে লগ্নি করেছিলেন, তারা নিজেদের নির্বুদ্ধিতাকে দুষছেন। অবশ্য সাধারণ বিনিয়োগকারী থেকে শুরু করে শেয়ার বাজার সংশ্লিষ্ট ও বিশ্লেষকরা এ অবস্থার জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসিকে দায়ী করছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের ড. আল আমীন বলেন, তিনি শেয়ার বাজারের এ অবস্থায় মোটেও অবাক নন। নিয়ন্ত্রক সংস্থা গত দুই বছরে এমন কিছু দুর্ভাগ্যজনক সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার ফল যে শেষ পর্যন্ত এমটাই হবে, তা সবাই জানতো। এ বিষয়ে সতর্কও করা হয়েছিলো। কিন্তু সংস্থাটি কারো কথা শুনেনি। এখন সবার বিনিয়োগ আটকে গেছে। কারো কাছে শেয়ার কেনাবেচার টাকা নেই। যে সামান্য কিছু বেচাকেনা হচ্ছে, এগুলো কৃত্রিম লেনদেন।
বিশ্লেষকদের মতে, গত ২ বছরে শেয়ার বাজারে অবাধ কারসাজি হয়েছে। অল্প কিছু মানুষ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। কারো শাস্তি হয়নি। বরং শাস্তির নাম করে অনেককে দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে। মরা বাজারেও ৮০ টাকার শেয়ার হাজার টাকায় ওঠেছিলো। কারা করছে, কীভাবে দাম বাড়িয়েছে, তা সবাই জানে। কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থা চোখ বুঝেছিলো। এ কারণে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।
শেয়ার বাজার কারসাজি সম্পর্কে বিগত ২০১১ সালে কালের কন্ঠ পত্রিকায় বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও এ সংক্রান্ত কমিশনের প্রধান খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ লিখেন ‘জুয়াড়ি সিন্ডিকেটের চক্রান্তে ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার ব্যর্থতায় (সহায়তায়?) লাখ লাখ বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হলো। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য আইন আছে। বিধিবিধান আছে। আছে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন। তাও নাকি সিন্ডিকেটের হাতে! সবাইতো সরকারকে দোষারোপ করছে। সরকার কোন ব্যীক্ত নয়। সরকার চলে বিভিন্ন বিধিবদ্ধ সংস্থার মাধ্যমে। এক্ষেত্রে বিধিবদ্ধ সংস্থা দায় এড়াবে কীভাবে? সরকার কি অ্যাকাউন্টিবিলিটি নিশ্চিত করবে? কমিশন কি পুনর্গঠিত হবে?
না, সরকার গত এক যুগেও শেয়ার বাজারের নিয়ন্ত্রণকারীদের জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ ও শেয়ার কারসাজির হোতাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি বিধান করেনি। বরং ক্ষমতাসীনদের অনেকে এসব অপরাধ অপকর্মের সাথে যুক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে। তাই কারসাজির তদন্ত শেষে খোন্দকার ইব্রাহীম খালিদ তার রিপোর্টে যেসব অপকর্মকারী কারসাজিকারকের নাম প্রকাশ করেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রকাশ্যে অপারগতা প্রকাশ করেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী।
বিগত ২০১৭ সালে আদালত বেক্সিমকো গ্রুপের চেয়ারম্যান সোহেল এফ রহমান ও ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে ১৯৯৬ সনের শেয়ারবাজার কেলেংকারীর আলোচিত দুই মামলা বাতিলের প্রতিবাদে কর্মসূচী ঘোষণা করে দুর্নীতি প্রতিরোধ আন্দোলন নামে একটি সংগঠন। অভিযোগ করা হয়, ১৯৯৬ সালে কৃত্রিমভাবে শেয়ারের দাম বাড়িয়ে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে শত শত কোটি হাতিয়ে নেয় অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। ১৫ টি প্রতিষ্ঠান ও ৩৬ ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কারসাজির মূল হোতারা ক্ষমতাসীনদের আশ্রয় প্রশ্রয়ে ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। আর এ অবস্থা চলছে তখন থেকেই। এভাবে বিগত এক যুগে আরো একাধিক বড়ো শেয়ারবাজার কারসাজির ঘটনা ঘটেছে। অসৎ সিন্ডিকেট হাতিয়ে নিয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা। তখন থেকে সাধারণ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের আস্থা হারাতে থাকে শেয়ারবাজারের ওপর। গত এক যুগে সেই আস্থা এখন শূন্যের কোঠায় নেমে আসার উপক্রম হয়েছে। যে নিয়ন্ত্রক সংস্থা শেয়ারবাজারের ভালোমন্দ দেখার কথা, তারাই যোগ দিয়েছে অসৎ সিন্ডিকেটে। আর তাদের পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকা পালন করছে খোদ সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিরা। এভাবে গৃহস্থের কুকুর ও বনের শেয়ালের মধ্যে ভাব হয়ে যাওয়ায় মোরগ-মুরগীরূপী পুঁজিবাজারের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা হয়ে পড়েছেন অরক্ষিত ও অসহায়। ফলে আতংকিত ক্ষুদ্র শেয়ার ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে সরে পড়ছেন শেয়ার মার্কেট থেকে।