অর্থের অভাবে এসএমই কাস্টার উন্নয়ন ব্যাহত
প্রকাশিত হয়েছে : ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ৮:২৬:১২ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট: বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক উন্নয়ন মাঠ পর্যায়ে পৌঁছে দিতে বিভিন্ন সময় নেওয়া হয় নানান উদ্যোগ। এসব উদ্যোগের মধ্যে একটি বড়ো পরিকল্পনা ছিল উদ্যোক্তা বাড়ানো ও পৃষ্টপোষকতা বৃদ্ধি। সরকার চেয়েছিল ক্ষুদ্র ও মাঝারি পর্যায়ের শিল্প উদ্যোক্তাদের নানান সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত শিল্পের প্রসার ঘটাতে। এই লক্ষ্যে গঠন করা হয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প বা এসএমই ফাউন্ডেশন।
২০০৭ সালে ২ বিলিয়ন টাকার প্রাথমিক তহবিল নিয়ে এই ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠিত হয়। এরআগে এসএমই খাতের উন্নয়নের জন্য একটি সম পরিবেশ তৈরি করার ল্েয ২০০৫ সালে প্রথম এসএমই নীতি প্রণয়ন করা হয়েছিল। এই নীতি অনুসরণ করে বাংলাদেশ সরকার দারিদ্র্য বিমোচনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে সকল এমএসএমই উন্নয়নের নামে সকল পরিকল্পনা, উন্নয়নমূলক, অর্থায়ন, সচেতনতা বৃদ্ধি, মূল্যায়ন ও এডভোকেসি সেবা প্রদানের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চ হিসেবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ফাউন্ডেশন (এসএমইএফ) প্রতিষ্ঠা করে।
এই ফাউন্ডেশনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ ছিল ২০১৩ সালে কাস্টার বা গুচ্ছভিত্তিক এসএমই প্রতিষ্ঠান নির্ধারণ। কিন্তু সারা দেশে কাস্টার নির্ধারণ করা হলেও কাস্টারগুলোর উন্নয়ন ব্যহত হচ্ছে। লোকবলের অভাব, আর্থিক সহায়তা না পাওয়ার কারণে এসব কাস্টারের উন্নয়ন হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে কাস্টারভিত্তিক বা গুচ্ছ এসএমই প্রতিষ্ঠানগুলো বিচ্ছিন্ন এসএমইগুলোর চেয়ে বেশি উন্নতি করেছে। গুচ্ছভিত্তিক এসএমই প্রতিষ্ঠান অন্যদের চেয়ে ঋণও পেয়েছে বেশি। আর বিচ্ছিন্ন এসএমই প্রতিষ্ঠানগুলো অনানুষ্ঠানিক খাত থেকে ঋণ নিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করেছে। সেজন্য পুনরুদ্ধারে তারা পিছিয়ে আছে। কিন্তু অর্থ ও জনবলের অভাবে নতুন কাস্টার নির্ধারণ ও কাস্টারগুলোর কার্যক্রমে পর্যাপ্ত গতি আনা, কাস্টারের উদ্যোক্তাদের প্রশিণ দেয়া যাচ্ছে না।
এসএমই ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, শিল্প খাতের মোট শ্রমশক্তির ৮০ ভাগ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানে কাজ করে। কিন্তু ফাউন্ডেশন শুরু থেকে ৫০ জনের লোকবল নিয়ে কাজ করছে। এখানে জনবলের ঘাটতি রয়েছে। এত বড়ো খাতের জন্য না আছে বরাদ্দ, না আছে কোনো ধরনের সুযোগ-সুবিধা। এর মধ্যে কাস্টার নির্ধারণসহ বেশকিছু কাজ হয়েছে। কিন্তু এত কম লোকবল দিয়ে সব কাজ করা সম্ভব না। সেজন্য সরকারের পর্যাপ্ত সহায়তা প্রয়োজন।
এদিকে দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে (এসএমই) এগিয়ে নেওয়ার জন্য ২০১৯ সালে প্রথমবারের মতো প্রণয়ন করা হয় এসএমই নীতিমালা। এ নীতিমালায় ৬০টি পরিকল্পনার জন্য পাঁচ বছরের সময়সীমা (২০১৯-২৪) বেঁধে দেয়ায় প্রশংসিত হয় সরকারের এ সিদ্ধান্তটি। এরই মধ্যে নীতিমালা প্রণয়নের সাড়ে তিন বছর চলে গেছে, কিন্তু এখনো বাস্তবায়ন হয়নি ৪৪টি পরিকল্পনা। আবার বাস্তবায়িত এ ১৬টি পরিকল্পনার মধ্যে আটটিই নীতিমালা প্রণয়নের আগে বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
নীতিমালার আগে বাস্তবায়িত আটটি পরিকল্পনা হচ্ছে মেলা আয়োজন, উদ্যোক্তা পুরস্কার প্রদান, ওয়েবসাইট স্থাপন, বিএসটিআই, ট্রেডমার্ক সার্টিফিকেট পাওয়া, গবেষণা কার্যক্রম, অবদান নির্ধারণ, পরিসংখ্যান প্রকাশ। আর পরে বাস্তবায়িত অন্য পরিকল্পনাগুলোর মধ্যে রয়েছে উদ্যোক্তাদের জন্য ট্যাক্স, ভ্যাট রিফর্ম করা, আর্থিক সহায়তার প্রাপ্যতা আরো সহজ করা, আইএসও সার্টিফিকেট প্রাপ্তি ইত্যাদি।
এসএমই নীতিমালা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১৯ সালে এটি প্রণয়নকালে ১১টি ল্য নির্ধারণ করা হয়। এ ১১টি লক্ষের বিপরীতে নির্ধারণ করা হয় ৬০টি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা। এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ওই বছরের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়া হয়। কিন্তু এসএমই ফাউন্ডেশন ও নীতিমালা বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন অধিদপ্তর সূত্রে পাওয়া তথ্য বলছে, ৬০ পরিকল্পনার বড়ো অংশই (৪৪টি) এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।
অবাস্তবায়িত পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে এসএমই উদ্যোক্তাদের লাইসেন্স নবায়ন, রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া সহজীকরণ, জেলা-উপজেলায় আঞ্চলিক অফিস স্থাপন, প্রশিণ প্রদান, সচেতনতা সৃষ্টি, পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ, বাজার বিশ্লেষণ, রফতানি বাজার বড়ো করা, আঞ্চলিক প্রদর্শনী কেন্দ্র স্থাপন, কাস্টার উন্নয়ন, কাস্টারের উদ্যোক্তাদের দতা উন্নয়ন, পরিবেশ সহনশীল শিল্প উন্নয়ন, ই-কমার্সের প্রশিণ, প্রযুক্তির উৎকর্ষ, অনলাইন প্রশিণ কনটেন্ট উন্নয়ন, নারী উদ্যোক্তা উন্নয়ন ফান্ড, নারী উদ্যোক্তাদের পুরস্কার ও বৃত্তি প্রদান, বড়ো শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ক্ষুদ্র শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সমন্বয়সহ ৪৪টি পরিকল্পনা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যেকোনো দেশেই এসএমই খাতের উন্নয়নে তিনটি পদপে নেয়া জরুরি। এগুলো হচ্ছে এসএমই ঋণ প্রদানে বিদ্যমান ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা, উদ্যোক্তাদের সমতা বৃদ্ধির জন্য পর্যাপ্ত প্রশিণের ব্যবস্থা এবং এ খাতের উন্নয়নে সরকারের প থেকে সহায়ক নীতিমালা প্রণয়ন। আমাদের নীতিমালা প্রণয়ন হয়েছে, কিন্তু সেই নীতিমালার আলোকে যেভাবে কাজ করা প্রয়োজন ছিল সেভাবে হচ্ছে না। এখন এ পদপেগুলোকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।
এসএমই নীতিমালা প্রণয়নে যে ১১টি ল্য নির্ধারণ করা হয়, তার মধ্যে রয়েছে ব্যবসার পরিবেশ উন্নয়ন, অর্থ সংস্থানের সুযোগ, বাজারে এসএমই পণ্য সহজলভ্য করা, স্বল্প বাজেটে উদ্যোক্তা তৈরি, কাস্টারভিত্তিক নেটওয়ার্ক উন্নয়ন, তথ্যের অবাধ প্রবাহ, দতা বৃদ্ধি ও প্রশিণ প্রদান, নারী উদ্যোক্তা উন্নয়ন, বড়ো শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এসএমইর সংযুক্তি, পরিবেশ সহায়ক এসএমই শিল্প-কারখানা গড়ে তোলা, পরিসংখ্যানভিত্তিক গবেষণা ও উন্নয়ন।
এ বিষয়ে এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন অধ্যাপক ড. মাসুদুর রহমান বলেন, ‘২০১৯ সালে এসএমই নীতিমালা গ্রহণের পর আমরা যখন কাজ শুরু করলাম, তখনই নভেল করোনাভাইরাস থাবা দিয়েছে। যার জন্য আমাদের কার্যক্রম প্রায় দুই বছর স্থগিত ছিল। তখন আমাদের একদমই কাজ করার সুযোগ ছিল না। কিন্তু তার পরও আমরা চেষ্টা করেছি। করোনার সময় ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা যখন ঝরে পড়ছিল, তখন সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে আমরা তাদের ঋণের ব্যবস্থা করেছি।’
তিনি আরো বলেন, ‘একেবারে কাজ হয়নি এমনটি বলা যাবে না। আমরা কিছু কাজ করেছি। বাংলাদেশ ব্যাংকের যে বিষয়গুলো ছিল, আমরা তা পুরোপুরি সম্পন্ন করতে পেরেছি। উদ্যোক্তাদের জন্য ট্যাক্স, ভ্যাট রিফর্ম করেছি, ট্যাক্স নিয়ে আমাদের ৬৩টি প্রস্তাব এনবিআর গ্রহণ করেছে। করোনাভাইরাসের ধাক্কার কারণে আমরা যতটুকু পিছিয়ে পড়েছিলাম, এখন তা কাটিয়ে উঠতে পারব বলে আমরা মনে করছি।’