হাওরে বইয়ের গ্রাম
প্রকাশিত হয়েছে : ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ৯:০২:১০ অপরাহ্ন
মুনশী ইকবাল : হাওর বলতেই চোখে ভেসে ওঠে শুকনো মৌসুমে দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠ কিংবা বর্ষায় উত্তাল জলরাশি। সন্ধ্যার পর যেখানে ঝিঁঝির ডাকে নিস্তব্ধতা নেমে আসে। নেই যোগাযোগ ব্যবস্থায় কোনো উন্নয়নের ছোঁয়া। চলাচলে বর্ষায় নৌকা আর শুকনোয় পা’ই যেখানে ভরসা। কৃষি আর মাছ ধরা যে জনপদের মানুষের মূল পেশা। পড়াশোনা কিংবা আধুনিকতা ছোঁয়া এখানে নেই অন্যান্য জনপদের মতো। যারা এখানে পড়াশোনা করতে চায় তাদেরও নানান চরাই উতরাই পেরিয়ে যেতে হয়। ফলে এখানে একটু চাপেই ঝরে পড়ে শিক্ষার্থীরা। হাওর জনপদ বলতেই এই চিত্র নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। এই হাওরের জনপদেই বই নিয়ে স্বপ্ন দেখছেন একদল তরুণ। তারা গড়ে তুলেছেন একটি গণগ্রন্থাগার।
হাওর জনপদ সুনামগঞ্জের তাহিরপুর এক প্রত্যন্ত জনপদ। তাহিরপুরের বাদাঘাট ইউনিয়নের সীমান্ত এলাকার (চক বাজার) এক গ্রাম ঘাগটিয়া। ২৫ জনের একদল উদ্যোমী তরুণের প্রচেষ্টায় এই গ্রামটি এখন বইয়ের গ্রাম নামে চেনেন আশপাশের সবাই। শুরুটা করোনাকালে। স্কুল কলেজ বন্ধ। এলাকার পড়ুয়া তরুণরা ঝুঁকে পড়ছে মোবাইলের দিকে। মোবাইলের দিকে ঝুঁকে যাওয়া এই তরুণদের বইয়ের দিকে ফেরাতে তারা উদ্যোগ নেন একটি পাঠাগার তৈরির। তাদের সহায়তায় এগিয়ে আসের গ্রামবাসিও। সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য ডা. তোয়াজ আলী স্থানীয় চক বাজারে পাঠাগারের জন্য এক শতক জায়গা দান করেন। এই জায়গায় সিলেট সিটি কর্পোরশনের সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বর্তমানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ডিজি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পিএস এনামুল হাবীবের সহায়তায় উঠে স্থায়ী পাকা ঘর। অবশেষে ২০২০ সালের ৩ আগস্ট ‘জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হোক আগামী প্রজন্ম’ শ্লোগানে ৮০টি বই নিয়ে যাত্রা শুরু করে ঘাগটিয়া গণগ্রন্থাগার। এই গ্রন্থাগারে এখন প্রতিদিন বই পড়তে আসেন শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ। গ্রামের শিক্ষার্থীদের এখন সময় কাটে পাঠাগারে বই পড়ে, সাহিত্যের আড্ডায়। উদ্যোক্তারা তাদেই বইয়ের স্বপ্ন পাঠাগারেই সীমাবদ্ধ রাখেন নি। তারা বাড়ি বাড়ি বই পড়ুয়াদের কাছে পোঁছে দেন বই। পড়া শেষ হলে তা আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। তাদের এই উদ্যোগে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি গ্রামের মানুষও বইয়ের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। বর্তমানে এই পাঠাগারে বইয়ের সংখ্যা প্রায় দুই হাজার। পাঠাগারের জনপ্রিয়তা এতো বেড়েছে যে সময়সীমা বিকাল ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত বেঁধে দিলেও পাঠকের চাহিদার জন্য সকাল ১০টা থেকে খুলে দিতে হয়।
পাঠাগারের উদ্যোক্তারা জানান শুরুটা খুব সহজ ছিল না। অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। উদ্যোক্তাদের সবাই শিক্ষার্থী হওয়ায় এটি ছিল বেশ কঠিন। বর্তমানে পাঠাগারে বইয়ের সংকট। বই বাড়ি বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য একটি ভ্যান, তথ্য লিপিবদ্ধের জন্য একটি কম্পিউটার ও নিরাপত্তার জন্য সিসি ক্যামেরার ব্যবস্থা করা গেলে খুব ভালো ছিল।
পাঠাগার পরিচালনা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অমিও হাসান বলেন, বাড়ি বাড়ি বই পৌঁছে দেওয়ার জন্য বর্তমানে আমাদের পাঠাগারের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন একটি ভ্যান গাড়ির। এরপর বই এবং ডাটা সংরক্ষণের জন্য একটি কম্পিটার ও সিসি ক্যামেরা দরকার। তিনি বলেন তরুণদের বইমুখী করতে আমরা এই উদ্যোগ নিই। অনেকেই আমাদের এই কাজে সহায়তা করেন। আমরা সবার সহায়তা এতদূর আসতে পেরেছি।
এ ব্যাপারে স্থানীয় সাংবাদিক জাহাঙ্গির আলম ভূইয়া বলেন তরুণদের এই উদ্যোগ অন্যন্ত প্রশংসনীয়। তাদের এই উদ্যোগে আমরা এলাকাবাসি গর্বিত। মানুষ এখন ঘাগটিয়াকে বইয়ের গ্রাম হিসেবে চিনে।
জমিদাতা ডা. তোয়াজ আলী বলেন গ্রামের মানুষ আর তরুণ ছেলেপেলেরা আমাকে লাইব্রেরি করতে জায়গার জন্য বলে। আমি তাদের উৎসাহ দেখে এক শতক জায়গা দিয়ে দিই। সেখানে এখন মানুষ বই পড়ে, এলাকার ছেলেপেলেরা বাজে আড্ডায় না মেতে লাইব্রেরিতে বসে দেখে খুব ভালো লাগছে।
এ ব্যাপারে পাঠাগারে স্থাপনা নির্মাণে সহায়তাকারী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ডিজি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পিএস এনামুল হাবীব দৈনিক জালালাবাদকে জানান, সেসময় বিশ^ ব্যাংকের একটি প্রজেক্টে কাজ করছিলাম। সেই প্রজেক্টের আওতার তাদের এই পাঠাগারে ঘর করে দেওয়া হয়। সবাই তো রাস্তাঘাট আরও নানান কাজে সহায়তা করে, আমরা চেষ্টা করেছি তরুণদের বইয়ের যে স্বপ্ন তাতে একটু জড়িত থাকতে।