বাড়ছে শব্দদূষণ, ঝুঁকিতে জনস্বাস্থ্য
প্রকাশিত হয়েছে : ০৩ মার্চ ২০২৩, ৯:২৪:১১ অপরাহ্ন
স্টাফ রিপোর্টার: গতকাল ৩ মার্চ ছিলো বিশ্ব শ্রবণ দিবস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) উদ্যোগে বরাবরের মতো এবারো দিবসটি সারা বিশ্বের মতো দেশেও পালিত হয়েছে। এ বছর দিবসের প্রতিপাদ্য ‘কর্ণ ও শ্রবণসেবা সকলের তরে, আসুন করি বাস্তবায়ন ঘরে ঘরে’।
দিবসটি উপলক্ষে স্পিচ অ্যান্ড হিয়ারিং সোসাইটি অব বাংলাদেশ স্বাভাবিক শ্রবণ ক্ষমতা রক্ষায় ১৪ দফা সুপারিশ করেছে। এরমধ্যে রয়েছে হাইড্রলিক হর্ন বন্ধ করা, আবাসিক এলাকার জন্য শব্দের গ্রহণযোগ্য সর্বোচ্চ মাত্রা ৫৫ ডেসিবল ও বাণিজ্যিক এলাকার জন্য ৭০ ডেসিবল বাস্তবায়ন করা, উচ্চ শব্দের মধ্যে কর্মরতদের ক্ষেত্রে ইয়ার প্লাগ ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা, পাঠ্যসূচিতে শব্দদূষণ রোধের বিষয়ে সচেতন করা; পাবলিক প্লেসে মাইক কিংবা স্পিকার ব্যবহারে শব্দের মাত্রা ৫৩ ডেসিবলের মধ্যে রাখার জন্য আইন প্রণয়ন করা উল্লেখযোগ্য।
সিলেটে শব্দদূষণবিরোধী অভিযান মাঝে মাছে চালায় পরিবেশ অধিদপ্তর। গত ১৮ জানুয়ারী অভিযানে ৭৮টি হাইড্রোলিক হর্ন জব্দ করেছে অধিদপ্তর পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালত। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব অভিযান যথেষ্ট নয়। এতে কোনভাবেই বন্ধ হচ্ছেনা শব্দ দূষণ। যত্রতত্র ইলেকট্রিক ও অনুমোদনহীন হাইড্রোলিক হর্ণের ব্যবহারের কারণে শব্দদূষণ বেশি হচ্ছে। এতে শব্দের স্বাভাবিক মাত্রা গড়ে ৬০ ডেসিবেল হলেও শহরের কয়েকটি স্থানে এর মাত্রা ১০৩ ডেসিবল পর্যন্ত উঠেছে। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এভাবে চলতে থাকলে মানুষের শ্রবণশক্তি কমে যাওয়ার পাশাপাশি উচ্চরক্তচাপ, অনিদ্রাসহ নানা স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়বে।
২০১৭ সালে পরিবেশ অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত এবং অংশীদারিত্বমূলক কর্মসূচির আওতায় আটটি বিভাগীয় শহরের শব্দের মানমাত্রা পরিমাপ জরিপ থেকে জানা যায়, সিলেটে সর্বাধিক শব্দদূষণের শিকার করিমউল্লাহ মার্কেট এলাকা। আর সবচেয়ে কম শব্দদূষণ হয় কোর্ট এলাকায়। আবাসিক এলাকার মধ্যে শ্যামলীতে শব্দের সর্বোচ্চ মান ১২৪ দশমিক ১ ডেসিবল এবং সর্বনিম্ন ৫৮ দশমিক ৮ ডেসিবল। অপরদিকে সবচেয়ে কম শব্দদূষণ হয় লন্ডনী রোড এলাকায়। এর সর্বোচ্চ শব্দ মান ৯৫ দশমিক ৫ ডেসিবল এবং সর্বনিম্ন ৬০ দশমিক ৭ ডেসিবল। উল্লেখ্য, এই মানও শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০০৬ এর নির্ধারিত মানমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি। মিশ্র এলাকায় শব্দদূষণের ক্ষেত্রে করিমউল্লাহ মার্কেটের শব্দদূষণের মাত্রা ১৩০ দশমিক ৬ ডেসিবল। অন্যদিকে মিশ্র এলাকার মধ্যে সবচেয়ে কম শব্দদূষণ হয় কোর্ট পয়েন্ট এলাকায়। এখানকার সর্বোচ্চ শব্দ মান ৮১ দশমিক ৮ ডেসিবল এবং সর্বনিম্ন ৫০ দশমিক ১ ডেসিবল। বাণিজ্যিক এলাকাতেও শব্দদূষণ কম নয়। নির্বাচিত ৪টি বাণিজ্যিক এলাকার মধ্যে রিকাবী এলাকার শব্দের মাত্রা সর্বোচ্চ ১২৮ দশমিক ১ ডেসিবল এবং সর্বনিম্ন ৪৮ দশমিক ৮ ডেসিবল, যা শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০০৬ এর নির্ধারিত মানমাত্রার প্রায় দ্বিগুণ। বাণিজ্যিক এলাকার মধ্যে কম শব্দদূষণ হয় জিন্দাবাজার এলাকায়। বিসিক শিল্প এলাকায় শব্দদূষণের মান সর্বোচ্চ ১২৩ দশমিক ৯ ডেসিবল এবং সর্বনিম্ন ৫৮ দশমিক ১ ডেসিবল।
শুধু তাই নয়, রাত ৮টার পর সিলেট নগরে প্রবেশ করে শত শত ট্রাক। নগরের ভেতর দিয়ে এই ট্রাকগুলো ভোলাগঞ্জ, জাফলংসহ বিভিন্ন রুটে যায়। কিন্তু এই টাকগুলো নগরের বুক চিরে যাওয়ার সময় একদিকে গতির ঝড় তোলে, অন্যদিকে উচ্চ শব্দের হর্ন বাজিয়ে যায়। ট্রাকগুলোর বেশিরভাগই হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার করে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়।
রাতে উচ্চ শব্দে হর্নের বিষয়ে নগরের বিভিন্ন এলাকার মানুষ দীর্ঘদিন থেকে অভিযোগ জানিয়ে আসছেন। কিন্তু থামছেনা এর ব্যবহার। এতে অসহনীয় যন্ত্রণার মাঝে বাস করছেন সড়কঘেষা বাসার বাসিন্দারা।
সিলেট শহরের কোন উৎস থেকে সবচেয়ে বেশি শব্দদূষণ হচ্ছে, তা জানতে ২০১৭ সালের শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত এবং অংশীদারিত্বমূলক কর্মসূচির আওতায় সাধারণ মানুষের মতামতের ভিত্তিতে এক জরিপ করা হয়। সে জরিপ অনুযায়ী ৮৬ শতাংশ উত্তরদাতা মোটরযানের হর্নকে এবং ২৬ শতাংশ উত্তরদাতা নির্মাণ কাজকে শব্দদূষণের মূল কারণ বলে দায়ী করেন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, শব্দদূষণ বন্ধ করতে হলে সরকারের বেশ কিছু পদক্ষেপ একসঙ্গে নিতে হবে। আইন আছে, কিন্তু আইনের কঠোর প্রয়োগ নেই। সব মিলিয়ে সরকারের সদিচ্ছার অভাব বলেই তিনি মনে করেন।
মানুষের কানের সহনীয় শব্দমাত্রা সাধারণত ৫৫ থেকে ৬০ ডেসিবেল। কিন্তু টানা এই মাত্রা ৮৫ ডেসিবেলের বেশি হলে শ্রবণশক্তির ক্ষতি হতে পারে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। চিকিৎসকদের মতে, আমাদের দেশের প্রায় ৯ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষ যেকোনও মাত্রার বধিরতায় ভুগে থাকেন। শব্দদূষণজনিত বেশ কিছু কাজ আমরা প্রতিনিয়ত করে যাচ্ছি, সেগুলোর কিছু দীর্ঘমেয়াদি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। ফলে আমাদের অন্তঃকর্ণের বিশেষ একধরনের কোষ ধ্বংস হয়ে স্থায়ীভাবে শ্রবণের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।