পেঁয়াজে ভারত নির্ভরতা কমে এসেছে
প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ মার্চ ২০২৩, ৮:১১:৫০ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট: বাংলাদেশে কিছুদিন আগেও পেঁয়াজের বাজারের বড়ো অংশ ছিল আমদানি নির্ভর। আর এর সবচেয়ে বেশি যোগান আসতো ভারত থেকে। এতে ভারতের উপর বাংলাদেশের পেঁয়াজের বাজার অনেকাংশে নির্ভর করতো। প্রায়ই দেখা যেতো ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিতো এতে সমস্যায় পড়তে হতো দেশিয় ব্যবসায়ীদের। বিশেষ করে ২০১৯ সালে ভারতের পেঁয়াজ রপ্তানির জেরে দেশে ডাবল সেঞ্চুরি করে পেঁয়াজ। ফলে টনক নড়ে সরকারের। তাই সরকার চাইছিল এ থেকে বেরিয়ে এসে নিজস্ব সক্ষমতা বাড়াতে। এরই রেশ ধরে বাংলাদেশে বেড়েছে পেঁয়াজের উৎপাদন, কমে এসেছে ভারত নির্ভরতা। এতে দেশি পেঁয়াজের কদর বেড়েছে, লাভবান হচ্ছেন দেশি চাষিরা।
দেশে গত তিন বছরে পেঁয়াজ উৎপাদন বেড়েছে ৪০ শতাংশের বেশি। দেশে পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা ২৫ লাখ টন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে পণ্যটি উৎপাদন হয়েছে ৩৬ লাখ ৪১ হাজার টন। একই সঙ্গে বেড়েছে পণ্যটির আবাদি জমির পরিমাণ ও উৎপাদনশীলতা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশে পেঁয়াজ আবাদ হয়েছে ২ লাখ ১২ হাজার হেক্টর জমিতে। ২০২১-২২ অর্থবছরে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৫৯ হাজার হেক্টরে। এ সময়ের মধ্যে কৃষিপণ্যটির উৎপাদনশীলতা হেক্টরপ্রতি ১১ টন থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ টনে।
স্থানীয় উৎপাদন পর্যাপ্ত হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারের অস্থিতিশীলতার ছাপ দেশে পেঁয়াজের বাজারে দেখা যাচ্ছে না। কোনো কোনো দেশে পণ্যটির দাম এখন স্বাভাবিকের কয়েক গুণে দাঁড়ালেও বাংলাদেশে তা কমছে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, দেশের বাজারে দেশি পেঁয়াজ প্রতি কেজি ২৫-৩৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩০-৪০ টাকায়। এক মাস আগেও দেশি পেঁয়াজ ৩০-৪০ ও আমদানীকৃত পেঁয়াজ ৪০-৪৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। গত বছরের এ সময়ে পেঁয়াজের দাম ছিল ৪৫-৫৫ টাকা।
ভারত সরকার ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে পেঁয়াজ রফতানি সাময়িকভাবে বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়। এর প্রভাবে বাংলাদেশে পণ্যটির মূল্য দাঁড়ায় রেকর্ড সর্বোচ্চে। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে পরের বছরও। সে সময় সৃষ্ট বাজার অস্থিতিশীলতা নিয়ন্ত্রণে আমদানি উৎসে বৈচিত্র্য আনার পাশাপাশি দেশেও পেঁয়াজ উৎপাদন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আবাদ সম্প্রসারণে নানামুখী পদক্ষেপের পাশাপাশি ভর্তুকি-প্রণোদনা ছাড়াও কৃষকের মধ্যে সহজ শর্তে ঋণ বিতরণ শুরু হয়। এরই মধ্যে এসব পদক্ষেপের সুফলও মিলতে শুরু করেছে।
দেশের বৃহত্তম পাইকারি ভোগ্যপণ্য বাজার খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরাও বলছেন, কয়েক বছর ধরে নির্দিষ্ট কিছু সময়ে পেঁয়াজের দাম অস্বাভাবিকভাবে অস্থিতিশীলতার মধ্য দিয়ে যাওয়ায় দেশে ধারাবাহিকভাবে পেঁয়াজ উৎপাদন বাড়ানো হয়েছে। এ কারণে এখন উৎপাদনকারী জেলাগুলো থেকে পর্যাপ্ত সরবরাহ আসছে। ফলে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি অনেকটাই কমেছে। আগে দেশি পেঁয়াজের দাম কম ছিল। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশিয় পেঁয়াজেও ভালো দাম পাচ্ছেন কৃষক। তবে উৎপাদনের ভরা মৌসুমে চাহিদার তুলনায় বাড়তি সরবরাহের কারণে এখন দেশি পেঁয়াজের দাম কিছুটা কম। আসন্ন রমজান মাস ও কোরবানির ঈদেও দেশে পেঁয়াজের সরবরাহ সংকটের সম্ভাবনা অনেক কমেছে।
খাতুনগঞ্জের হামিদউল্লাহ মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. ইদ্রিস বলেন, ‘গুণগত মানের বিচারে দেশি পেঁয়াজ অনেক ভালো। তবে দেশিয় পেঁয়াজের বেশকিছু জাত দীর্ঘ সময় সংরক্ষণ করা যায় না। এ কারণে দেশে পর্যাপ্ত পেঁয়াজ উৎপাদন সত্ত্বেও কিছু আমদানি করতে হয়। তবে উৎপাদনের এ ধারা অব্যাহত থাকলে দেশে পেঁয়াজের সংকট বা অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি হবে না।’
স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদন ও সরবরাহ বৃদ্ধিই পেঁয়াজে ভারতনির্ভরতা কমিয়েছে বলে মনে করছেন আমদানিকারক ব্যবসায়ীরা। দেশে ভারত থেকে আমদানীকৃত পেঁয়াজের বড়ো একটি অংশ আসে হিলি স্থলবন্দর দিয়ে। সেখানকার ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, দুই-তিন বছর আগেও এখান দিয়ে প্রতিদিন পেঁয়াজবাহী ট্রাক প্রবেশ করত গড়ে ৫০-৬০টি। এখন তা মাত্র ৮-১০টিতে নেমে এসেছে।
তবে স্থানীয় পর্যায়ের পর্যাপ্ত সরবরাহই দেশের বাজারে পণ্যটির মূল্যকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। স্থানীয় সরবরাহ পর্যাপ্ত হওয়ায় কৃষকের স্বার্থ সংরক্ষণে সামনের দিনগুলোয় পণ্যটি আমদানি বন্ধ করে দেয়াই উচিত হবে বলে অভিমত তাদের।
সাবেক কৃষি সচিব ও বর্তমানে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান মো. নাসিরুজ্জামান বলেন, ‘পেঁয়াজের মতো কৃষিপণ্য আমদানি না করাই ভালো। আমাদের কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের দাম বেশি হলেও তা দিয়েই খাওয়া উচিত। সরকারের উচিত যেসব পণ্য দেশে ভালো উৎপাদন হয় তার আমদানি একেবারেই বন্ধ করে দেওয়া। যেসব পণ্য কৃষক উৎপাদন করেন তা দেশেই উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ায় জোর দিতে হবে।’
কৃষিসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশি পেঁয়াজের সংরক্ষণযোগ্যতা আমদানীকৃত পেঁয়াজের চেয়ে বেশি। আমদানি হওয়া পেঁয়াজের সংরক্ষণযোগ্যতা নেই বললেই চলে। দেশে উৎপাদিত প্রায় ৬০ শতাংশ পেঁয়াজের সংরক্ষণযোগ্যতা অনেক ভালো। এগুলোর ফলন সবসময় একই থাকে। বাকি পেঁয়াজ হলো গ্রীষ্মকালীন ও মুড়িকাটা পেঁয়াজ।
এ ব্যাপারে কৃষি সচিব ওয়াহিদা আক্তার বলেন, ‘পেঁয়াজের আমদানি নির্ভরতা বেশি থাকায় একসময় বাজারে অস্থিতিশীলতা থাকত। কিন্তু এখন আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লেও দেশের বাজারে এর প্রভাব একেবারেই নেই। কৃষকরা আমাদের সবসময় অনুরোধ করে আসছেন যেন আমরা আমদানি না করি। গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের উৎপাদন মৌসুমে যে ঘাটতি দেখা দিত, তা এখন হচ্ছে না। কৃষকরা এখন অনেক বেশি উৎপাদন করছেন। আশা করি ভবিষ্যতে কখনই পেঁয়াজের বাজার অস্থিতিশীল হবে না। এজন্য তাদের বিভিন্ন প্রণোদনাও দেওয়া হচ্ছে।’
এরআগে পেঁয়াজের আকস্মিক মূল্যবৃদ্ধি গত কয়েক বছরে ভোক্তাদের জন্য একটি বিড়ম্বনার কারণ হয়ে উঠেছিল। ‘প্রমোটিং অ্যাগ্রিফুড সেক্টর ট্রান্সফরমেশন ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকেও পর্যবেক্ষণ দিয়ে বলা হয়, বাংলাদেশে কৃষিপণ্যগুলোর মধ্যে পেঁয়াজের বাজারেই অস্থিতিশীলতা দেখা যায় সবচেয়ে বেশি। এর পেছনের কারণ হিসেবে বরাবরই পণ্যটির চাহিদা পূরণে ভারতনির্ভরতাকে সবচেয়ে বেশি দায়ী করেছেন বাজার পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষকরা। স্থানীয় উৎপাদন চাহিদা পূরণে অপর্যাপ্ত হওয়ায় প্রতিবেশী দেশটি থেকে নিয়মিতভাবেই বছরে ৮-১০ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হতো। এর সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে পণ্যটির মূল্যে বড়ো প্রভাবক হয়ে উঠেছিল ভারতে অনাবৃষ্টি-অতিবৃষ্টির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা দেশটির সরকারের পেঁয়াজ বাণিজ্য-সংক্রান্ত নীতিগত সিদ্ধান্ত। সুযোগসন্ধানীদের জন্যও পণ্যটির বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরির সুযোগ করে দিয়েছিল একক উৎসে নির্ভরতা।