বোরো’র খরচ বাড়ায় কৃষকের দুশ্চিন্তা
প্রকাশিত হয়েছে : ১৫ মার্চ ২০২৩, ১২:১০:০৯ অপরাহ্ন
স্টাফ রিপোর্টার : দেশের হাওরাঞ্চল খ্যাত সুনামগঞ্জ জেলাজুড়ে হয়েছে বোরো ধানের আবাদ। কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ না এলে বৈশাখ মাসের ১ম সপ্তাহেই ধান কাটা শুরু হওয়ার কথা। তবে এবার দীর্ঘ খরায় ধানের ফলন নিয়ে শঙ্কিত কৃষক। খরার পাশাপাশি ইতোমধ্যে পরিচর্যাসহ পানি সরবরাহ ও সার-কীটনাশক প্রয়োগে অনেক অর্থ ব্যয় করেছেন কৃষক। এ বছর বোরো উৎপাদনে বাড়তি খরচে নাভিশ্বাস ফেলছে তাদের। অর্থ সংকট আর খরচের ঊর্ধ্বগতির কারণে কৃষকদের কপালে পড়ছে দুশ্চিন্তার ভাঁজ। গত বছরের তুলনায় এবার জেলার বোরো আবাদে প্রায় পৌনে ২০০ কোটি টাকার ঊর্ধ্বে বাড়তি খরচের হিসাব গুণছেন তারা।
সুনামগঞ্জের বিভিন্ন হাওরে দেখা গেছে, কৃষকদের কাঙ্খিত বোরো আবাদের চিত্র। চারদিকে এখন গাঢ় সবুজের বিপ্লব। অন্যান্য বছরে এই চাষাবাদের সময় কৃষকের মুখে হাসি দেখা গেলেও এ বছর রয়েছে মলিন মুখে। বীজ, বিদ্যুৎ, ডিজেল, কিটনাশক ও শ্রমিকসহ অন্যান্য কৃষিপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় এ বছর বোরো আবাদের অতিরিক্ত খরচে চরম হিমশিম খাচ্ছেন তারা। চাষাবাদের খরচ জোগাতে অনেকেই ঋণের ফাঁদে পড়ছেন। সবচেয়ে বেকায়দায় পড়েছেন দরিদ্র কৃষকরা।
কৃষকরা জানান, চলতি মৌসুমে বীজতলা তৈরি ও চারা রোপণের জন্য পাওয়ার টিলারের মাধ্যমে জমি চাষ দিতে হয়। ডিজেলের দাম বেড়ে প্রতি লিটার ১১২ টাকা দরে কিনতে হচ্ছে। একই সঙ্গে বৃদ্ধি পেয়েছে বিদ্যুতের দামও। বর্তমানে প্রতি বস্তা ইউরিয়া সার ১১শ থেকে ১২শ টাকা, টিএসপি ১১শ টাকা, এমওপি ৭৫০ টাকা, দস্তা প্রতিকেজি ২শ থেকে ৩শ টাকা। পোকা দমনে কীটনাশক ছহি ১০০ মিলি ১৪৫ টাকা, ভিরতাকো ১০ গ্রাম ১৭০ টাকা, মাইকোসাল প্রতিকেজি ২০০ টাকা দরে কিনতে হচ্ছে। গত বছর এসব পণ্যের দাম কম ছিল অনেকটা। এর আগে প্রতিকেজি বীজ ২শ ২০ থেকে ৩শ ৫০ টাকায় কিনেছেন কৃষকরা। এছাড়া রোপনের সময় এবং বর্তমান পরিচর্যায় শ্রমিকের মজুরি ৪শ টাকা দিতে হচ্ছে। তবে কাটা-মাড়াইয়ের সময় শ্রমিক সংকটে দেখা দিলে তাদের মজুরি গুণতে হবে ৬শ থেকে ৭শ টাকা।
সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক বিমল চন্দ্র সোম জানান, সিলেট বিভাগের মধ্যে সুনামগঞ্জ জেলায় সবচেয়ে বেশি বোরো ধান উৎপাদন হয়ে থাকে। ১২ উপজেলার প্রকৃতি নির্ভর মৌসুমী এ ফসল স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত ফসল জাতীয় খাদ্য ভাণ্ডারে যুক্ত হয়। এবার ২ লাখ ২২ হাজার ৭৯৫ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ হয়েছে। সব ঠিক থাকলে এবছর সাড়ে ১৩ লক্ষ ৫২ হাজার মেট্রিক টন ধান পাওয়া যাবে।
সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার জাউয়া বাজার ইউনিয়নের বাসিন্দা ডেকার হাওরের কৃষক সিদ্দিক ফরহাস আহমদ জানান, গত বোরোতে ১ হেক্টর জমিতে ধান আবাদ করছিলেন। এতে তার সর্বমোট খরচ হয়েছিল ৮২ হাজার ৫শ টাকা। এ বছর তা হেক্টর প্রতি ৯৭ হাজার ৫শ টাকা খরচ হতে পারে। ফলে চলতি মৌসুমে বোরো ধান আবাদের বাড়তি খরচ নিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে। গত বছরে বিদ্যুৎ চালিত সেচযন্ত্র মালিককে হেক্টর প্রতি ভাড়া দিয়েছিলেন ১২ হাজার ৩শ টাকা। কিন্তু এ বছর বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাওয়ায় সেটি মেশিন মালিক ১৭ হাজার ৩শ টাকা নির্ধারণ করেছে।
তিনি আরও বলেন, শুধু বিদ্যুতের দামই নয়, সম্প্রতি বীজ, কীটনাশক ও শ্রমিকের দামও বেড়েছে অনেক। সব মিলে এ বছরে হেক্টর প্রতি অতিরিক্ত প্রায় ১৫ হাজার টাকা খরচ হতে পারে। আবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব পড়লে তো পথে বসা ছাড়া উপায় নেই।
শান্তিগঞ্জ উপজেলার সাংহাই হাওরের কৃষক আব্দুল্লাহ মিয়া বলেন, আগের মৌসুমে কেনা ৬৬ টাকার ডিজেল বর্তমানে কিনতে হচ্ছে ১শ ১২ টাকা পাইকারী দরে। আবহাওয়ার কারণে ১ বিঘা ধানের জমিতে সেচ দিতে কখনো ৩২ লিটার কখনও ৪৫-৫০ লিটার ডিজেলের প্রয়োজন হয়। তাই অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে উৎপাদনে। সে তুলনায় আমরা লাভবান হচ্ছি না।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার বিদ্যুৎচালিত অগভীর সেচযন্ত্রের মালিক জুনাব আলী বলেন, গত বোরো মৌসুমে গৃহস্থদের কাছ থেকে প্রতিবিঘা ১ হাজার ৬শ ৫০ টাকা নেওয়া হয়েছে। এ বছরের বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাওয়ায় ২ হাজার ৩শ ১০ টাকা নির্ধারণ করেছি। কিন্তু এখনও বিদ্যুতের নতুন বিল হাতে পাওয়া যায়নি।
সুনামগঞ্জের কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, সম্প্রতি সময়ে বৈশ্বিক সমস্যার কারণে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সেক্টরের দাম কিছুটা বেড়েছে। যার প্রভাব কৃষি ক্ষেত্রেও পড়বে। সেচ কাজে কৃষকের কিছুটা খরচ বাড়বে। তবে তাদের লোকসান হবে না। এছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে ফলন বাড়াতে এবং খরচ কমাতে সার্বিক সহযোগিতা করা হচ্ছে। বোরো আবাদে কৃষকদের লাভবান করতে ইতোমধ্যে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া কিছু কিছু জায়গায় সমলয় পদ্ধতিতে চাষাবাদ শুরু করা হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে কৃষকরা বোরো ধান ঘরে তুলে লাভবান হবেন।