জৈন্তিয়া রাজ্য পতনের ১৮৮ বছর আজ
প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ মার্চ ২০২৩, ৮:৪১:৫৩ অপরাহ্ন
গোলাম সরওয়ার বেলাল, জৈন্তপুর: সিলেটের জৈন্তা এখন আর সোনার জৈন্তাপুর নয়। রতœগর্ভ এ জনপদের প্রাচীন ঐতিহ্য এখন প্রায় হারিয়ে যাওয়ার আজ ১শ ৮৮ বছর। রাজধানী জৈন্তিয়া রাজ্যে একাধারে ২৩ জন স্বাধীন রাজা রাজত্ব করেছিলেন। এক সময় জৈন্তাপুর ছিল সমৃদ্ধ ইতিহাস, নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি, যা বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য এসব প্রতœসম্পদ সংরক্ষণ একান্ত প্রয়োজন।
পান-পানি-নারী এ তিনে জৈন্তাপুরী, অথচ কালের বিবর্তনে তাও হারিয়ে যেতে বসেছে। সিলেটের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত জৈন্তাপুর উপজেলা এক সময় বৃটিশ শাসিত ভারত উপমহাদেশের শেষ স্বাধীন রাজ্য ছিল। ১৭ পরগনা ও ২২ হাটি নিয়ে গঠিত জৈন্তা রাজ্যের রাজধানী ছিল নিজপাট। ভারতবর্ষের অধিকাংশ এলাকা যখন মোগল সা¤্রাজ্যভক্ত ছিল তখনও জৈন্তা নামে তার আলাদা ঐতিহ্য রক্ষা করে আসছিল। ১৭৯০ খ্রীস্টাব্দে তৎকালীন রাজা রাম সিংহের শাসনামলে জৈন্তার বিভিন্ন স্থানে অনেক মঠ-মন্দির নির্মাণ করা হয়। ১৮৩২ সালে রাজা রাম সিংহের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জৈন্তিয়া রাজ্যের সৌভাগ্যের সূর্য চির অস্তমিত হয়ে যায়। আর রাজা রাম সিংহের আমলে নির্মিত নিদর্শনগুলোর মধ্যে কিছু ধ্বংস হয়ে যায় ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে। তার মৃত্যুর পর ২০ বছর বয়স্ক রাজেন্দ্র সিংহ জৈন্তিয়ার রাজা হন। আর তিনিই ছিলেন জৈন্তা রাজ্যের শেষ স্বাধীন রাজা। তারপর হঠাৎ একদিন হ্যারি নামে জনৈক এক ইংরেজের আগমন ঘটে জৈন্তা রাজ্যের রাজধানী নিজপাটে। তিনি অনেক কূট-কৌশলে রাজেন্দ্র সিংহকে বিনা যুদ্ধে নিরস্ত্র করে বন্দি করে ফেলেন। সে দিন রাজ অন্তপুর, কোষাগার, সোনার থোড়, সোনার কুমড়া, সোনার পাকড়ই প্রভৃতি মূল্যবান সম্পদ নিয়ে যায় তারা। নিজপাটের মানুষের সে সময়কার ভাব যে কি মর্মভেদী আবেগপূর্ণ হয়েছিল তা ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়।
উপজেলা সদরের বাসস্টেশনস্থ বর্তমান জৈন্তেশ্বরী মিউজিয়াম বাড়ীটি তৎকালীন সময়ে ছিল বিচারালয়। বিচার কার্যে অভিযুক্তদের দেওয়া হতো নরবলী। দুঃখজনক হলেও সত্য সেকালের নরবলীর নির্ধারিত স্থান ও রক্ত গড়িয়ে যাওয়ার নালা এবং লাশ ফেলে দেওয়ার কূপ শত বছর পরে হলেও রাজ এখনো স্বাক্ষী হয়ে আছে। প্রাচীন ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মতো জৈন্তার প্রাথমিক যুগের ইতিহাস তমসায় আচ্ছন্ন। জৈন্তাপুর প্রচীনকালে রাজা শাসিত ছিল। কৃষক রাজবংশ থেকে শুরু করে পুরোহিত রাজবংশ, খাসিয়া রাজ বংশের নাম জানা-অজানা অনেক রাজাই জৈন্তাপুর রাজত্ব করেন। ১৮৩৫ সালের ১৬ মার্চ জৈন্তারাজ্য বৃটিশ অধিকারে সিলেটভুক্ত হয়। জৈন্তার রাজ শাসনামলের বহু নিদর্শন আজও অনেক স্থানে রয়েছে। জৈন্তার রাজবাড়ী, শিববাড়ী, ডুপির মঠের শিব মন্দির, সারীঘাট পান্থাশালা জৈন্তেশ্বরী বাড়ি, কেন্দ্রী হাওরের বিজয় সিংহ মন্দিরসহ ফালজুর কালীবাড়ী, নিজপাট কালীবাড়ি মন্দির যা এখনো ইতিহাস সাক্ষ্য বহন করে। ছত্র নারায়ণ রাজার মৃত্যুর পর তার ভাগিনীপুত্র বিজয় সিংহ জৈন্তার রাজা হন। ১৭৮২-৮৮ সাল পর্যন্ত বিজয় সিংহ রাজা রাজত্ব করেন। বিজয় সিংহ রাজার সময়ে ২টি কাটরা টাকা পাওয়া গেছে। সেই সময়ে নার্তিয়াং পুঞ্জির উপাংদলই পুত্র লক্ষèী সিংহ জৈন্তার রাজ দরবারে বেশ প্রতিপত্তি লাভ করে। লক্ষ্মীর শত্রুপক্ষ অপবাদ দেয় যে রাজভগ্নী বড়কুরি ও লক্শ্মীর মধ্যে গুপ্ত প্রণয় বর্তমান। বিচারে লক্ষ্মীর প্রাণদন্ড হয়। চতুলের কাদন লস্কর সেই সময় লক্ষ্মীকে পলায়ন করতে সাহায্য করেন। ফলে লক্ষ্মীর পরিবর্তে কাদন লস্করের প্রাণদন্ড হয়। তৎকালে এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পর্বতের খাসিয়া সর্দাররা জৈন্তাপুরের রাজধানী নিজপাট আসা যাওয়া বর্জন করে। ফলে স্থল ও পর্বতের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। তিন বছর এভাবে চলার পর স্থল ও পর্বতের সর্দাররা গোপন বৈঠক করে লক্ষ্মীকে রাজা করার সিদ্ধান্ত নেয়। ইতিহাস সাক্ষী দেয় সেই সময়ে জৈন্তিয়া কেন্দ্রী বিলে স্থল পর্বতের নৌকা দৌড় হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সেই নৌকা দৌড়ে রাজা বিজয় সিংহের নৌকা ডুবিয়ে তাকে হত্যা করা হয়। সেই কেন্দ্রী বিলে বিজয় সিংহ রাজার মন্দির এখনও বর্তমান। যা দেশী-বিদেশী পর্যটকরা এক নজর দেখতে এখনও আসেন। সংস্কার ও যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবে ঐতিহাসিক বিজয় সিংহ জরাজীর্ণ অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। আর সেকালের পরিকল্পিত হত্যার বিষয়ে এখনো মানুষের মাঝে একটি প্রবাদ বাক্য রয়েছে। আর তা হচ্ছে ‘হায় দ মখাই হায় আরনি যাইতায় ফুটির বাপের নায়’। অর্থাৎ সে দিন রাজা রাম সিংহকে যে নৌকাটি পরিবহন করেছিল সে মাঝির মেয়ের নাম ছিল ফুটি।