উপেক্ষিত ফায়ার সার্ভিস আইন
প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ মার্চ ২০২৩, ৪:০০:৫৩ অপরাহ্ন
মুনশী ইকবাল :
একসময়ের ছিমছাম সিলেট শহর এখন বিভাগীয় নগরী। বাড়ছে ব্যস্ততা, বাড়ছে মানুষ। ক্রমশ মানুষ শহরমুখী হচ্ছে। পুকুর, দিঘি, বাগান ঘেরা ছিমছাম নগরী এখন বিল্ডিংয়ের নগরীতে পরিণত হয়েছে। ছোটো ছোটো বাড়িগুলো এখন আকাশছোঁয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে যেন। যেখানেই এক টুকরো খালি জমি, সেখানেই গড়ে উঠছে বহুতল ভবন। হোক তা সরু গলি, পুকুর-ডোবা ভরাট করা ভূমি কিংবা পুরাতন ভবন; কোনো কিছুই বাদ যাচ্ছেনা। কিন্তু এসব ভবন নির্মাণের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মানা হচ্ছে না কোনো ধরনের নিয়মনীতি। সবচেয়ে বেশি মানা হচ্ছেনা ফায়ার সার্ভিস আইন। এতে মারাত্মক অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিতে রয়েছে আধ্যাত্মিক নগরী।
ফায়ার সার্ভিস সূত্র বলছে ,এখানে অনিয়মই নিয়মে পরিণত হয়েছে। প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভবন নির্মাণের অনুমতি নিলেও তা বাস্তবায়ন করছেন না কেউই। বহুতল ভবন নির্মানের পর তাতে ফায়ার সার্ভিসের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা হয়েছে কিনা তা অধিদপ্তরকে জানানোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে। রয়েছে পূর্বনুমতির পর বাস্তবায়ন সনদ গ্রহণের নিয়ম। কিন্তু অহরহ তা ভাঙা হচ্ছে। ফলে যেকোনো দুর্ঘটনায় এসব ভবনে অগ্নিকান্ডসহ বিভিন্ন দুর্যোগে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা হুমকির মুখে।
নগর এলাকায় ব্যবসায়িক লাভ বাড়ানোর অসৎ উদ্দেশ্যে বিকল্প সিঁড়ি ও নির্গমন পথ, ফায়ার লিফট, ফায়ার ডোর, ফায়ার ডিটেক্টর, ফায়ার স্প্রিংক্লার, ফায়ার সাপ্রেশন সিস্টেম প্রভৃতি অগ্নিনির্বাপণ সিস্টেমের যথাযথ ব্যবস্থা না করেই নির্মাণ করা হচ্ছে এসব বহুতল ভবন।
সম্প্রতি সিলেট শহরে বেশ কয়েকটি অগ্নিকান্ডের ঘটনা এবং তুরস্কে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর এ বিষয়গুলো আবারও সামনে চলে এসেছে। তুরস্কের অবস্থা বাংলাদেশে হলে কী হবে তা নিয়েও আজানা আতঙ্কে মানুষ। কেননা তুরস্কে অনেকগুলো নিয়ম বহির্ভূত ভবন জরিমানা দিয়ে বৈধ করা হয়েছিল। ভূমিকম্পে সেগুলোই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
এ ব্যাপারে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সিলেটের সহকারী পরিচালক মো. সফিকুল ইসলাম ভুঞা দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, এখন অনিয়মই নিয়মে পরিণত হয়েছে। কেউই অগ্নি নির্বাপণ আইন মেনে ভবন নির্মাণ করছেন না। বহুতল ভবন নির্মানের আগে আইন মেনে সবকিছু করবেন মর্মে অনুমোদন নিলেও ভবন নির্মানের পর অধিদপ্তরে তা অবগত করেন না। কিন্তু নিয়ম হলো ভবন নির্মাণের পর তিনি অনুমোদন অনুযায়ী কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করে ভবন নির্মাণ করেছেন তা অধিদপ্তরকে জানানো। মানে বহুতল ভবন নির্মাণের আগে একটা অনুমোদন নিতে হবে. সবাই তা নেন কিন্তু ভবন নির্মানের পর বাস্তবায়ন করা হয়েছে সাপেক্ষে আরেকটি অনুমোদন নিতে হয় অধিদপ্তর থেকে, সেই অনুমোদন কেউ নিচ্ছেন না। এভাবেই চলছে। আমরা এগুলো তদন্ত করে প্রত্যেককে চিঠি দিয়েছি। যাদের ঘটতি ছিল তাদের সেই বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করে অধিদপ্তরে জানানোর জন্য চিঠিতে বলে দিয়েছি। এরমধ্যে যারা বাদ পড়েছেন তাদের চেক লিস্ট অনুযায়ী আমাদের টিম প্রতিমাসে ৫টি ভবন পরিদর্শন করে চিঠি দিচ্ছে। এক্ষেত্রে সরাসরি আইনি কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা ফায়ার সার্ভিসের নেই। তবে যারা তাদের কাছ থেকে সনদ নিয়ে ভবন নির্মান করেন। তারা যদি সনদের নিয়ম ভাঙেন তবে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে অভিযান চালিয়ে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায় কিন্তু সরাসরি ফায়ার সার্ভিস কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। তিনি বলেন প্রতিমাসে ৫টি বহুতল ভবন পরিদর্শনের আমাদের ধারাবাহিক কার্যক্রম চলমান আছে। তবে চলতি মার্চ মাস থেকে এই কার্যক্রম আরও জোরদার করতে পুনরায় তদন্তে নামছে ফায়ার সার্ভিসের টিম। অধিদপ্তরের নির্দেশনাক্রমে উপ পরিচালক এই টিম গঠন করে দিয়েছেন। এর মাধ্যমে আগে যাদের চিঠি দেওয়া হয়েছিল তাদের পুনরায় নিশ্চিত করা হবে।
সফিকুল ইসলাম বলেন এসব বিষয় আসলে ভবন নির্মানের সময় ইঞ্জিনিয়ার এবং ঠিকাদারদের ভালোকরে বিল্ডিং আইন দেখে তারপর ভবন নির্মাণ করা উচিত। কিন্তু তারা এগুলো দেখেন কিনা তা নিয়েও সন্দেহের অবকাশ আছে।
ফায়ার সার্ভিস আইন কী বলে: অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপন আইন ২০০৩ এর সাত নং ধারায় বহুতল বা বাণিজ্যিক ভবনের নকশা অনুমোদন ইত্যাদিতে বলা আছে- আপাততঃ বলবৎ অন্য কোন আইনে যাহা কিছু থাক না কেন, অগ্নি প্রতিরোধ, অগ্নি নির্বাপন এবং এতদসম্পর্কিত নির্ধারিত বিষয়াদির ক্ষেত্রে মহাপরিচালকের ছাড়পত্র ব্যতিরেকে কোন বহুতল বা বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের নকশা অনুমোদন বা অনুমোদিত নকশা সংশোধন করা যাইবে না। তবে শর্ত থাকে যে নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে মহাপরিচালক ছাড়পত্র সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বা ব্যক্তিকে অবহিত করবেন।
আট নং ধারায় বলা আছে- বিদ্যমান বহুতল বাণিজ্যিক ভবন সংক্রান্ত বিধান (১) এই আইন কার্যকর হওয়ার তারিখে বিদ্যমান সকল বহুতল বা বাণিজ্যিক ভবনের মালিক বা দখলকার সংশ্লিষ্ট ভবনের অগ্নি প্রতিরোধ, অগ্নি নির্বাপণ ও জননিরাপত্তা ব্যবস্থা বিষয়ে, এই আইন কার্যকর হওয়া ৬ মাসের (১৮০ দিন) মধ্যে, মহাপরিচালক লিখিতভাবে রিপোর্ট প্রদান করিবেন। (২) উপধারা (১) এর অধীন প্রাপ্ত ও রিপোর্ট বিবেচনাক্রমে মহাপরিচালক প্রয়োজনবোধে সংশ্লিষ্ট বহুতল বা বাণিজ্যিক ভবন পরিদর্শন করবেন বা করাইবেন। তদভিত্তিতে ভবনের মালিক বা দখলকারকে উপধারা (১) এ উল্লেখিত ব্যবস্থাদি নিশ্চিতকরণকল্পে পরামর্শ প্রদান করিবেন।
(৩) উপধারা (২) এর অধীন প্রদত্ত পরামর্শ অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট ভবনের মালিক বা দখলকার ভবনটির অগ্নি নির্বাপণ, অগ্নি প্রতিরোধসহ অন্যান্য জননিরাপত্তামূলক ব্যবস্থার প্রয়োজনীয় সংযোজন বা সংশোধন করিতে বাধ্য থাকিবেন।
(৪) এই ধারার অধীন যাবতীয় কার্যক্রম নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে সম্পন্ন করতে হইবে, অন্যথায় ভবনটির অগ্নি নির্বাপনের ক্ষেত্রে অনুপযোগীতার কারণে ব্যবহার উপযোগী নয় মর্মে মহাপরিচালক ঘোষণা করিতে পারবেন।
(৫) উপধারা (৪) এর অধীন কোন ভবন ব্যবহার উপযোগী নয় মর্মে ঘোষণা করার কারণে কোন ব্যক্তি সংক্ষুব্ধ হইলে তিনি উক্তরূপ ঘোষণার তারিখ হইতে ৩০ (ত্রিশ) দিনের মধ্যে সরকারের নিকট আপীল দায়ের করিতে পারিবেন।
(৬) উপধারা (৫) এর অধীন আপীল প্রাপ্তির ৬০ (ষাট) দিনের মধ্যে সরকার তদসম্পর্কে সিদ্ধান্ত প্রদান করিবে এবং সরকারের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হইবে।
নগর-পরিকল্পনাবিদরা মনে করেন, মানুষের জীবনকে প্রাধান্য দিয়ে বহুতল ভবনসহ নগরে অগ্নি ও দুর্যোগজনিত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ডেভেলপার ও ভবনমালিকদের দায়বদ্ধতায় নিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ সব নগর সংস্থাসমূহকে জবাবদিহির আওতায় আনা প্রয়োজন।
বিশেষজ্ঞদের মতে ভবন নির্মাণে যথাযথ মানদণ্ড ও অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোডের প্রস্তাবনা অনুযায়ী বাংলাদেশ বিল্ডিং রেগুলেটরি অথরিটি অনতি বিলম্বে গঠন করে কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
তারা বলছেন, নগর এলাকাতেই অত্যন্ত সরু রাস্তার পাশেই ১০ থেকে ১২ তলা বা ততোধিক উচ্চতার বহুতল ভবন নির্মাণ মানদণ্ড বা অগ্নিনিরাপত্তা ছাড়া গড়ে উঠছে। ফায়ার-সংক্রান্ত দেশের বিদ্যমান আইনে ৭ তলা ভবনকে বহুতল ভবন হিসেবে বিবেচনা করা হলেও ইমারত নির্মাণ বিধিমালা, ২০০৮ এবং বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড, ২০২০-এ ১০ তলা ভবনকে বহুতল হিসেবে বিবেচনা করবার ফলে ৭ তলার ওপর অনেক ভবনেই অগ্নিনিরাপত্তা ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি হিসেবে দেখা দিচ্ছে।
নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করা সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) একটি পর্যবেক্ষণ জানিয়েছে, তুরস্কের ভূমিকম্প দুর্যোগের পরে দেখা গেছে, ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ভঙ্গ করে যেসব ডেভেলপার, আবাসন ব্যবসায়ী বা উদ্যোক্তা বহুতল ভবন নির্মাণ করেছিলেন এবং পরবর্তী সময়ে জরিমানা দিয়ে সেগুলোকে বৈধ করে নিয়েছিলেন, সেসব ভবনই দুর্যোগে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাংলাদেশের বহুতল ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রেও ইমারত নির্মাণ বিধিমালা এবং অগ্নিনিরাপত্তা-সংক্রান্ত আইন অবজ্ঞা করে বহুতল ভবন নির্মাণ ও ব্যবহার চলছে। এসব ভবন অগ্নিসহ বিভিন্ন দুর্যোগে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে।