রোজায় আমিষে টানের শঙ্কা
প্রকাশিত হয়েছে : ১৯ মার্চ ২০২৩, ৭:৩৬:৩২ অপরাহ্ন
মুনশী ইকবাল: পবিত্র রমজান মাস শুরুর আর মাত্র তিনদিন বাকি। রোজায় মাংসের প্রতি আগ্রহ থাকে সবচেয়ে বেশি। গরু এবং খাসি সাধারাণ ক্রেতার নাগাল ছাড়িয়েছে অনেক আগেই। তবে নিম্ন আর মধ্যবিত্তের ধরাছোঁয়ায় ছিল ব্রয়লার মুরগি। গত কিছুদিনে ব্রয়লারের উর্ধ্বগতিতে তা নিম্ন বিত্তের নাগালও ছাড়িয়েছে। দাম এভাবে থাকলে এই রোজায় মুরগির ক্রয়ক্ষমতা মধ্যবিত্তের নাগালও ছাড়াতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
রোজায় মধ্যবিত্তের আমিষের শেষ ভরসা ব্রয়ালারেও টান পড়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন ছাত্রবাস ও মেসেও খাদ্য তালিকায় কমেছে মুরগির দাম। গরু-খাসি তারা কবে ছেড়েছেন ভুলে গেছেন জানান মেসবাসি। রেস্টেুরেন্টে কমেছে তরকারিতে মুরগির টুকরো। এসব কারণে ব্যাপক হারে কমেছে মুরগি বিক্রিও। এতে লোকসানের শঙ্কাও করছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। প্রতিদিন নতুন নতুন করে দাম আপডেট হচ্ছে। বেশিরভাগ প্রান্তিক খামারি মুরগি উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছেন। তাদের অভিযোগ বড়ো ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের জন্য এই অবস্থা। মুরগির বাচ্চা ও ফিডের দাম ডাবলের উপর বড়েছে। এটা কে নিয়ন্ত্রণ করবে?
এদিকে রোজা আসলেই বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়ার প্রবণতা সবসময়ই ছিল। তবুও মানুষ সামর্থ অনুপাতে একটু ভালো খেতে সাহরীতে মাংসের আয়োজন রেখে থাকেন। গত কয়েকবছর ধরে গরু-খাসির দাম বেশি থাকায় ব্রয়লার মুরগিতেই তারা কাজ চালাতেন। কিন্তু এবার রোজা আসার কয়েকমাস আগ থেকেই দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়তে শুরু করে। সর্বশেষ বাড়লো মুরগির দাম। দামের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে এই মুরগির দামই।
নিত্যপণ্যের দাম তো নিত্যদিন বেড়েই চলছে। পাশাপাশি অন্য মাংসের দামও বেড়েছে। এরসাথে পাল্লাদিয়ে বাড়লো মুরগির দাম। হুট করে কেজিতে একশো টাকার মতো দাম বেড়ে সেই জায়গায় তিন সাপ্তাহ ধরে খুঁটি গেড়ে বসে আছে ব্রয়লার। অনেক ক্রেতা আশঙ্কা করছেন রোজায় তা আরও বেড়ে যেতে পারে।
নগরীর জল্লারপারের একটি মেসে থাকেন প্রকৌশলী এমডি বশির আলী। তিনি যে মেসে থাকেন তারা সবাই আইএলটিএস প্রোগামে ভর্তির জন্য সিলেট শহরে আছেন। বশির বলেন তাদের মেসে আগে সাপ্তাহে তিনদিন মুরগি থাকতো। দাম বেশি থাকার কারণে গরু বা খাসি কখনোই মেসে রান্না বাদ হয়েছে ভুলে গেছেন। ইদানীং মুরগির দামও বেড়েছে। তাই কয়েক সাপ্তাহ থেকে তারা মুরগি তিনদিন থেকে একদিনে নিয়ে এসেছেন। বাকিদিন সবজি দিয়ে চালাচ্ছেন।
জাল্লারপারের ভাতের হোটেল বারাকাহ রেস্টুরেন্টের মালিক রাশেদ হক জানান স্বল্পমূল্যে ভাতের জন্য আমরা রেস্টুরেন্টটি চালু করেছিলাম। বেশ সারাও পেয়েছি। কর্মজীবীদের কাছে রেস্টেুরেন্ট খুব জনপ্রিয়তা পায়। কিন্তু জিসিনপত্রের দাম বাড়ার কারণে আমাদের মান ধরে রাখতে কষ্ট হচ্ছে। দাম ঠিক রাখলেও আমাদের খাবারের পরিমাণ কমিয়ে দিতে হচ্ছে। আমাদের এই হোটেলে মুরগি ও ডিমের তরকারির চাহিদা বেশি। তবে যে হারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে এভাবে আর স্বল্পমূল্যে কয়দিন চালাতে পারবো বুঝতে পারছিনা। কারণ আমাদের কাস্টমার সব কর্মজীবী, যাদের আয় নির্দিষ্ট।
নগরীর কয়েকটি বাজারে ঘুরে দেখা যায়, মাংসের বেশি দামের কারণে ক্রেতার সংখ্যা অনেক কমে গেছে। প্রতি কেজি গরুর মাংস ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকা, খাসি এক হাজার, ব্রয়লার মুরগি ২৪৫-২৫০ টাকা বিক্রি হচ্ছে।
মাংস ব্যবসায়ী হেকমত উল্লাহ বলেন স্বাধীনের পর থেকে মাংস বিক্রি করেন। ইদানীংকালের মতো মাংসের বাজার এত খারাপ তারা আগে দেখেননি। শুধু অনুষ্ঠান ছাড়া এখন আর কেউ বেশি করে গরু-খাসি কিনে না। বিক্রি একেবারে কমে গিয়েছে। মানুষ এখন কমদামি মাংস মুরগিই খেতে পারছেনা গরু-খাসি কীভাবে খাবে বলে মন্তব্য তার। তিনি বলেন সাধারণ কোনো ক্রেতা এখন আর মাংস কিনতে আসেন না। ক্রেতার মধ্যে কিছু সরকারি অফিসের লোক আর আগে যারা কয়েক কেজি কিনতেন তারা অল্প মাংস কিনেন।
নগরীর রিকাবীবাজারের মুরগি ব্যবসায়ী সেলিম জানান রোববার ব্রয়লার ছিল ২৪৫টাকা, লাল মুরগি ছিল ৫৭০ টাকা। তিনি বলেন বিক্রি প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। আগে অর্ডার ছাড়া নরমালি ৭০ থেকে ৮০ পিস ব্রয়লার বিক্রি হতো এখন ৩৫ থেকে ৪০টি বিক্রি হয়। তিনি বলেন আমরা খুচরা ব্যবসায়ী, যে দামে আমরা পাইকারি কিনে আনি সেই দামের সাথে মিল রেখেই বিক্রি করতে হয়। দাম কমানো বাড়ানোতে আমাদের কিছু করার থাকে না। তবে দাম বাড়ায় আমাদের লস হচ্ছে। বিক্রি কমেছে।
এদিকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ার জন্য ফিডের দাম বেশি এবং বিদ্যুৎ ও জ¦ালানির দাম বৃদ্ধিকে দায়ী করেছেন। একবারে এত দাম কেন বাড়লো আর দাম নড়ছেনা কেন এজন্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলেন মূলত তিনটি বড়ো কোম্পানির জন্য পাইকারি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা জিম্মি হয়ে আছেন। একটি কোম্পানি ডিমের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে এবং বাকি দুটি ফিডের দাম। ডিম ও ফিডের দাম না কমলে ব্রয়লারের দাম কোনোভাবেই কমার সুযোগ নেই। একমাত্র সরকার যদি এই সিন্ডিকেটের গলা চেপে না ধরে তবে সাধারণ ব্যবসায়ীদের কিছু করার নেই।
পাইকারি মুরগির খামার জেডই এগ্রো’র কর্ণধার জাকারিয়া মজুমদার বলেন অত্যাধিক দাম এবং লোকসানের জন্য বেশিরভাগ প্রান্তিক খামারি খামার বন্ধ করে দিয়েছেন। ডিমের দাম বেড়েছে, বিদ্যুৎ বিল বেড়ে যাওয়ায় বাচ্চার দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। ২৫ টাকার একদিনের বাচ্চা এখন ৫০ টাকার উপরে চলে গিয়েছে। ফিডের দাম ডাবলের উপর বেড়ে গেছে। একদিন দুইদিন পরপরই তা বাড়ছে। বিদ্যুত ও জ¦ালানির দাম বাড়ায় উৎপাদন ও পরিবহন খরচে বড়ো কোম্পানিগুলোর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে প্রান্তিক খামারিদের টেকা মুশকিল হয়ে গেছে। এই অবস্থায় এখন মুরগির ব্যবসায় কেবল বড়ো কোম্পানিগুলোই ব্যবসা করছে। প্রান্তিক খামারিরা খামারে উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছেন।
বাজার পরিস্থিতি প্রসঙ্গে সিলেট বিভাগীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক ফখরুল ইসলাম বলেন, আমরা নিয়মিত বাজার পরিস্থিতি মনিটরিং করছি। ফিড এবং আনাষাঙ্গিক পণ্যের দাম বাড়ায় মুরগির দাম বেড়েছে। তবে আমরা নজর রাখছি কেউ যাতে দাম বাড়ার অজুহাতে অত্যাধিক দাম না বাড়ায়।