সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে সুপারিশমালা
প্রকাশিত হয়েছে : ২১ মার্চ ২০২৩, ১২:৩৫:১৫ অপরাহ্ন
এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, ২০২২ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৯ হাজার ৯৫১ ব্যক্তি। আহত হয়েছেন ১২ হাজার ৩৫৬ জন। যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব বলেন, বেপরোয়া গতি, বিপজ্জনক ওভারটেকিং, রাস্তাঘাটের নির্মাণ ত্রুটি, ফিটনেসবিহীন যানবাহনের অবাধ চলাচল, যাত্রী ও পথচারীদের অসতর্কতা, চালকের অদক্ষতা ও বেপরোয়া মনোভাব, চলন্ত অবস্থায় মোবাইল বা হেডফোন ব্যবহার এবং মাদক সেবন করে যানবাহন চালানোর কারণে দিন দিন সড়ক দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিনি আরো বলেন, ২০২১ সালের চেয়ে ২০২২ সালে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে প্রায় ২০ শতাংশ। এতে মৃত্যু বেড়েছে ২৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ।
তিনি বলেন, গত ৮ বছরের মধ্যে ২০২২ সালেই সড়কে সবচেয়ে বেশী দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে। এ সময়ে নিবন্ধিত যানবাহনের পাশাপাশি ছোট যানবাহন, বিশেষভাবে মোটর সাইকেল ও ইজিবাইকের সংখ্যা ৪ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২২ সালে অর্থাৎ গত বছর প্রায় ১০ হাজার সড়ক দুর্ঘটনার মধ্যে ১৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রে বাস, ২৪ দশমিক ৫০ শতাংশ ট্রাক-পিকআপ কাভার্ড ভ্যান ও লরি ও ৬ দশমিক ৯৫ শতাংশ অটোরিকশা, ২৮ দশমিক ৫৯ শতাংশ মোটর সাইকেল, ১১ দশমিক ৪২ শতাংশ ব্যাটারি রিকশা ও ইজি বাইক, ৮ দশমিক ৩২ শতাংশ নছিমন-করিমন-মাহিন্দ্রা ও লেগুনা দুর্ঘটনায় পতিত হয়েছে। এসব দুর্ঘটনার ২৭ দশমিক ৭০ শতাংশ জাতীয় মহাসড়কে, ৫২ দশমিক ২ শতাংশ আঞ্চলিক মহাসড়কে এবং ১১ দশমিক ৮৮ শতাংশ ফীডার রোডে ঘটেছে। সারা দেশে সংঘটিত মোট দুর্ঘটনার ৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ ঢাকা মহানগরীতে, ১ দশমিক ৭১ শতাংশ চট্টগ্রামে, শূন্য দশমিক ৯৯ শতাংশ রেলক্রসিংয়ে হয়েছে।
অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয়, গত রোববার মাদারীপুরের শিবচরে সংঘটিত এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় বাস খাদে পড়ে ২০ জন নিহত হন। ঐদিন সকাল সাড়ে ৭ টার দিকে মাদারীপুরের শিবচরে পদ্মাসেতুর এক্সপ্রেসওয়ের কুতুবপুর এলাকায় যাত্রীবাহী এই বাসটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে দুমড়ে মুচড়ে যায়। অপর এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সিলেটে ২০২২ সালে ৩৩৭ জন প্রাণ হারিয়েছেন সড়ক দুর্ঘটনায়। নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) এর এক প্রতিবেদনে এ তথ্য ওঠে এসেছে। প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, গত বছর সিলেট বিভাগে ২৮৬ টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় ৩৩৭ জন নিহত ও ৪৩৫ জন আহত হন। জেলাভিত্তিক তথ্য অনুসারে এই বিভাগের সিলেট জেলায় সর্বোচ্চ ১৩৬ টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ১৪৬ জন, আহত হয়েছেন ২৪৮ জন। এক্ষেত্রে হবিগঞ্জ দ্বিতীয় অবস্থানে। এই জেলায় মারা গেছেন ১০৩ জন, আহত হয়েছেন ৯৬ জন।
এসব দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশী ঘটেছে সিলেট-ঢাকা মহাসড়কে। এ মহাসড়কে সিলেট বিভাগের অংশে প্রাণ হারান ১২২ জন, আহত হন ১৮৭ জন। নিসচার প্রতিবেদনে সড়ক দুর্ঘটনার কিছু কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে, সড়কে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও মনিটরিংয়ের অভাব, টাস্কফোর্স কর্তৃক ১১১টি সুপারিশমালা বাস্তবায়ন না হওয়া, চালকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানোর প্রবণতা, লাইসেন্স ছাড়া চালক নিয়োগ, পথচারীদের মধ্যে সচেতনতার অভাব, ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করে ওভারটেকিং, বিরতি ছাড়া দীর্ঘ সময় ধরে গাড়ি চালনা, সীটবেল্ট ব্যবহার না করা, চালকদের মাদকাসক্তি, মহাসড়কে নির্মাণ ত্রুটি, শিশুদের উপযোগী আসন না থাকা, সড়ক-মহাসড়কে মোটর সাইকেল ও তিন চাকার গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি, মোটর সাইকেল চালকদের মানসম্মত হেলমেট ব্যবহার না করা, রাস্তার পাশে হাট বাজার ও দোকানপাট বসানো।
এছাড়া অশিক্ষিত ও অদক্ষ চালক, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব, সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ বাস্তবায়ন না হওয়াকেও কারণ হিসেবে প্রতিবেদনে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর বাইরে জেলা পর্যায়ে দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে অতিরিক্ত লোকসংখ্যা, অপর্যাপ্ত রাস্তা, মোটর সাইকেলছ ও রিকশার আলাদা লেইন না থাকা, ব্যাটারী চালিত যান সড়ক মহাসড়কে ওঠে বেপরোয়া গতিতে চালানো, পথচারীদের নিয়ম না মানার প্রবণতা, জেব্রা ক্রসিং, ওভারব্রিজ, আন্ডারপাস ব্যবহার না করে যত্রতত্র পারাপার ও রাস্তার চলাচল এবং পারাপারের সময় মোবাইল ফোন ব্যবহার দায়ী করা হয়েছে। নিসচার প্রতিবেদন অনুসারে ২০২১ সাল থেকে ২০২২ সালে সিলেটে সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির সংখ্যা বেড়েছে।
এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে ২০১৯ সালে ২২০ সদস্যের একটি কমিটি করে জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল। ৭ মাসে ৭টি সভা করে ১১১ টি সুপারিশ করে ওই কমিটি, যার মধ্যে ৫০ টি সুপারিশ ২০১৯ সালে, ৩২ টি ২০২১ সালে এং অবশিষ্ট ২৯টি সুপারিশ ২০২৪ সালের মধ্যে বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত ছিলো। কিন্তু ইতোমধ্যে বছর তিনেক অতিবাহিত হওয়া সত্বেও এসব সুপারিশ বাস্তবায়নে তেমন কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এভাবে দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলোর একটি সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধের বিষয়টি উপেক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে। আমরা বিভিন্ন পরিসংখ্যান তুলে ধরলাম, যেগুলোতে অত্যন্ত সুচিন্তিত সুপারিশ ও গাইডলাইন দেয়া হয়েছে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে। আশা করি, সড়ক যোগাযোগ মন্ত্রণালয়সহ সরকারের উর্ধতন মহল এদিকে দৃষ্টি দেবেন।