নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়া ওসমানী হাসপাতালে ভবন নির্মাণ : মৃত্যুঝুঁকিতে শ্রমিক ও পথচারী
প্রকাশিত হয়েছে : ২৯ মার্চ ২০২৩, ১২:১৩:৪৪ অপরাহ্ন
স্টাফ রিপোর্টার : নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়া চলছে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নতুন ভবনের নির্মাণ কাজ। ফলে একদিকে মৃত্যুঝুঁকিতে কর্মরত শ্রমিকরা অপরদিকে নির্মাণাধীন ভবনের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া ব্যস্ততম সড়কে যাতায়াতকারীরা পথচারীরা রয়েছেন দূর্ঘটনার ঝুঁকিতে। সম্প্রতি হাসপাতালের নির্মাণাধীন ভবন থেকে পড়ে শ্রমিক নিহত হওয়ার পরও নেয়া হয়নি পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা। বাড়তি সতর্কতা না থাকায় দিন দিন তালা বাড়তে থাকা নির্মাণাধীন ১৫ তলা ভবনটি নির্মাণ কাজে থাকা শ্রমিক ও পথচারীদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে।
মঙ্গলবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালের ১৫তলা ক্যান্সার ভবনের চতুর্থ তলার ছাদ ঢালাই কাজ চলছে। অনেক শ্রমিক সেখানে কাজ করছেন। তবে কারো মাথায় হেলমেট, পায়ে গাম বুট কিংবা কোমরে সেইফটি বেল্ট নেই। নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়াই কাজ করে যাচ্ছেন শ্রমিকেরা। শুধু ভবনের ৪ পাশে টিন দিয়ে একটি দেওয়াল নির্মাণ করেছে ঠিকাদার কর্তৃপক্ষ। নিরাপত্তা বেষ্টনী না থাকায় গত ১৯ মার্চ নির্মাণাধীন এই ভবনের ৩য় তলা থেকে পড়ে জুরান মিয়া নামের এক শ্রমিক মারা যান। তারপরও বাড়তি নিরাপত্তার কোনো উদ্যোগ নেয়নি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠাটি। এ বিষয়ে ওসমানী হাসপাতাল ও গণপূর্ত বিভাগের নির্দেশনা মানছেনা ঐ ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান।
সিলেট গণপূর্ত বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ৮৯ কোটি ৫৫ লাখ ৩৮ হাজার ১৬৮ টাকা ব্যয়ে বেসমেন্টসহ ১৭তলা ক্যান্সার ভবনের নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। প্রকল্পের কাজ পেয়েছে ঢাকার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এম জামাল অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড।
দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী, শ্রমিকের কাজের জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করবে। আর শ্রমিকদের নিরাপত্তাসহ প্রকল্পের যাবতীয় কাজ তদারকি করবে গণপূর্ত বিভাগ। কিন্তু ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান শুরু থেকেই নিরাপত্তার ব্যাপারে উদাসীন। ১ম দিকে ১ম ও ২য় তলার কাজ চলমান থাকায় ভবনটি দৃশ্যমান ছিলনা। দিন দিন তলা বাড়ছে। বর্তমানে ৪র্থ তলা ভবনের কাজ চলছে। দিন দিন ভবনটি দৃশ্যমান হওয়ার সাথে উচু হচ্ছে। এই সময়ে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে অব্যশই বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
মঙ্গলবার সরেজমিনে গিয়ে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলতে চাইলে তারা বক্তব্য দিতে অপরাগতা প্রকাশ করে। শেষ পর্যন্ত অনেক পীড়াপিড়িতে কাজের তদারকিতে থাকা একজন সাইট প্রকৌশলী বলেন, সকল ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েই শ্রমিকরা কাজ করছেন। নিহত শ্রমিক জুরান মিয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি আর কথা না বলে সটকে পড়েন।
কাজে থাকা একাধিক শ্রমিক বলেন, নিহত শ্রমিক জুরান মিয়ার পরিবার এখনো আসেনি। আসলে ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে। তার পরিবারের সাথে যোগাযোগ হয়েছে এখন রমজান মাস চলছে, পরবর্তীতে তার পরিবারের লোকজন আসবেন। তারপর আলোচনা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।
স্থানীয় বাসিন্দা মাহবুবুর রহমান বলেন, নিরাপত্তা বলয় তৈরি না করে ব্যস্ততম এলাকায় উচু ভবন নির্মাণ কোনভাবেই ঠিক নয়। কারণ যেকোনো সময় বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। উপর থেকে নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত জিনিসপত্র মাথায় পড়ে আহতের পাশাপাশি অনাকাঙ্খিত মৃত্যুও হতে পারে। কিছুদিন আগে এক শ্রমিক পড়ে মারাও গেছেন। তারপরও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আমাদের প্রতিদিন এ রাস্তা দিয়ে চলতে হয়।
মেডিকেল রোডের ব্যবসায়ী শামসুজ্জামান বলেন, ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল হচ্ছে সিলেট বিভাগের সর্ববৃহৎ সরকারী হাসপাতাল। এখানে বিভাগের সব জায়গা থেকে প্রতিদিন শত শত রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন। এছাড়া হাসপাতালের সড়ক দিয়ে প্রতিদিনি হাজার হাজার গাড়ি ও মানুষ চলাচল করেন। নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। দ্রুত নিরাপত্তা বেষ্টনি দেওয়া দরকার।
সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা: সৌমিত্র চক্রবর্তী দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, ভবনটি নির্মাণ করছে ঢাকার ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। আর তদারকি করছে গণপূর্ত বিভাগ। যদিও ভবন নির্মাণ দেখভালের জন্য হাসপাতালেরও একটা কমিটি রয়েছে। শুরুর দিক থেকে আমরা ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বলে আসছি। একই সাথে নিরাপত্তা বেষ্টনি দেওয়ার জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে গণপূর্ত বিভাগকেও জানানো হয়েছে। কিন্তু তারা বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছেনা।
তিনি বলেন, আমি আজ (মঙ্গলবার) ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলীকে অফিসে ডেকে পাঠিয়েছিলাম। তাদেরকে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বলেছি। অন্যথায় মানুষের জানমালের নিরাপত্তার সার্থে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নির্মাণ কাজ বন্ধ করতে বাধ্য হবো। ইতোমধ্যে আমরা গণপূর্ত বিভাগের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে প্রেরণের জন্য একটা চিঠি তৈরী করেছি। আজকালের মধ্যে সেটা প্রেরণ করা হবে।
এ ব্যাপারে সিলেট জেলা গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রিপন কুমার রায় দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, আইন অনুযায়ী ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান পর্যাপ্ত নিরাপত্তা বেষ্টনী দিতে প্রতিশ্রুতবদ্ধ। শ্রমিকের নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করেই ভবনের কাজ করাতে হবে। শর্ত অনুযায়ী কাজে থাকা শ্রমিকদের হেলমেট, কোমরে বেল্ট, বুট জুতা ব্যবহার করতে হবে। আর চতুর্থ তলার ছাদ হওয়ার পর নিরাপত্তা বেষ্টনি ব্যবহার করে কাজ করার কথা টেন্ডারেও উল্লেখ আছে। সুতরাং এ ব্যাপারে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান কোন দায় এড়াতে পারেনা।
তিনি বলেন, কিছুদিন আগে ৩ তলা থেকে পড়ে একজন শ্রমিক মারা গেছেন। তার মাথায় হেলমেট, কোমরে বেল্ট ও পায়ে জুতা ছিল না। এগুলো থাকলে হয়তো তার মৃত্যু এভাবে নাও হতে পারতো। ঐ শ্রমিক ৩য় তলার সাটারিং খোলার কাজ করতে গেয়ে নিচে পড়ে মারা যান। আমি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে সতর্ক করেছি। নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত না করলে আগামী বিলের অর্থ নিতে আসলে আটকে দেয়া হবে। শর্ত অনুযায়ী পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই কাজ করতে হবে।