সিলেটে বসছে প্রিপেইড গ্যাস মিটার : প্রস্তুতি সম্পন্ন, এপ্রিলে স্থাপন শুরু
প্রকাশিত হয়েছে : ৩১ মার্চ ২০২৩, ২:১৬:১১ অপরাহ্ন
স্টাফ রিপোর্টার : দেশে বিদ্যুতের সাথে পাল্লা দিয়ে দফায় দফায় বাড়ছে গ্যাসের দাম। যা গ্রাহকদের ঘাড়েই পড়ে। কিন্তু লস ঠেকানোর উদ্যোগগুলো খুবই ধীরগতিতে চলে। রান্নার গ্যাস ব্যবহারে চুলাপ্রতি টাকা দেয়ার বদলে প্রিপেইড মিটারে খরচ ও গ্যাসের ব্যবহার দুটোই অনেক কম হয়। কিন্তু সিলেটে মিটার বসানোর এই প্রকল্পে রয়েছে ধীরগতি। তবে শেষমেষ আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে মিটার স্থাপন প্রকল্প। এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে সিলেট শুরু হতে যাচ্ছে মিটার স্থাপনের কাজ। ইতোমধ্যে চীন থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে আসা মিটারগুলো রিসিভ হয়ে গেছে বলেও নিশ্চিত করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, সিলেটে বর্তমানে জালালাবাদ গ্যাসের প্রায় ৩ লাখ আবাসিক গ্রাহক রয়েছেন। এই প্রকল্পের মাধ্যমে এপ্রিল মাস থেকে জালালাবাদ গ্যাস টিঅ্যান্ডডি সিস্টেমস লিমিটেডের (জেজিটিডিএসএল) এর আবাসিক পর্যায়ের ৫০ হাজার গ্রাহক প্রিপেইড মিটারের আওতায় আসবেন। পর্যায়ক্রমে বাকিদেরও মিটারের আওতায় আনা হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিলেটে আবাসিক পর্যায়ে গ্রাহকদের প্রিপেইড মিটারের আওতায় নিয়ে আসার এটিই প্রথম উদ্যোগ। এতে গ্যাসের অপচয় রোধ করা সম্ভব হবে এবং গ্রাহক অতিরিক্ত বিল দেয়ার হাত থেকে রেহাই পাবেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিলেটে গ্যাসের আবাসিক গ্রাহকদের প্রিপেইড মিটারের আওতায় আনতে এক বছর আগে দরপত্র আহ্বান করা হয়। এরপর গেল বছরের অক্টোবর মাসে চীনের দুটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে জালালাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম লিমিটেড (জেজিটিডিএসএল)। এরই মধ্যে প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়।
প্রকল্প বাস্তবায়নে চীনা প্রতিষ্ঠান দ্য কনসোর্টিয়াম অব জেনারেল মিটারিং টেকনোলজি (সাংহাই) লিমিটেড ও হেক্সিং ইলেকট্রিক্যাল কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি করে জেজিটিডিএসএল। এরপর শুরু হয় প্রকল্পের জরিপ কাজ। ইতোমধ্যে নগরীর ৫০ হাজার গ্যাসের চুলা বসানোর জরিপ কাজ শেষ হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, প্রথম ডিপিপি অনুযায়ী গেল বছরের নভেম্বরে এই প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। আর চলতি বছরের মার্চের মধ্যে কাজ শুরুর কথা। তবে ডিপিপি সংশোধন করে গেল বছরের মার্চে দরপত্র আহ্বান করে জালালাবাদ গ্যাস। এতে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয় ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত।
দেরিতে চুক্তি সম্পর্কে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, ২০১৯ সালে এ ব্যাপারে একটি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) মন্ত্রণালয়ে জমা দেয় জালালাবাদ গ্যাস কর্তৃপক্ষ। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকল্প অনুমোদিত হয়। এরপর দরপত্র আহ্বান করা হলেও উপযুক্ত দরদাতা পাওয়া যাচ্ছিল না। এ ছাড়া প্রকল্পের প্রস্তাবিত ব্যয়েও কিছু অসামঞ্জস্য ছিল। তাই ডিপিপি সংশোধন করে গেল বছরে আবার দরপত্র আহ্বান করা হয়।
সংশ্লিষ্টদের সাথে আলাপকালে জানা গেছে, জালালাবাদ গ্যাস টিঅ্যান্ডডি সিস্টেমস লিমিটেডের (জেজিটিডিএসএল) উদ্যোগে গত ২২ মার্চ দুপুরে গ্যাসের মিটার স্থাপন নিয়ে এক গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়। গ্যাসভবনে আয়োজিত গণশুনানিতে প্রকল্প পরিচালক লিটন নন্দী জানান, সিলেট নগরীতে বর্তমানে গ্যাসের ১ লাখ আবাসিক চুলা রয়েছে। সে হিসেবে তারা প্রাথমিকভাবে ৫০ হাজার মিটার স্থাপনের পরিকল্পনা নিয়েছেন। সিলেট বিভাগের বাকি দেড় লাখ গ্যাস গ্রাহকও প্রিপেইড মিটারের আওতায় আসবেন জানিয়ে তিনি বলেন, তাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে গ্যাসের অপচয় রোধ করা। আগামী এপ্রিল থেকেই সিলেট নগরীতে প্রিপেইড গ্যাস মিটার বসবে। এরই মধ্যে মিটার স্থাপনের সার্ভে শেষ হয়েছে। চীন থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে আসা মিটারের গ্যাস-ট্যাক্স পরিশোধ করা হয়েছে। আগামী সপ্তাহে মিটার সিলেটে আসছে। এপ্রিলের ২য় সপ্তাহে মিটার স্থাপনের কাজ শুরু হবে।
জেজিটিডিএসএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) প্রকৌশলী মো. কামরুজ্জামান খানের সভাপতিত্বে ও কোম্পানি সচিব মো. শহিদুল ইসলামের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত ঐ গণশুনানিতে ভার্চুয়ালি প্রধান অতিথির বক্তব্যে পেট্রোবাংলার পরিচালক (প্রশাসন) আলতাফ হোসেন বলেন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার মাধ্যমে দুর্নীতি রোধ করাই তাদের মূল লক্ষ্য। এর মাধ্যমে সার্ভিস গ্রহণ ও সার্ভিস প্রদানকারীর মধ্যে সেতুবন্ধন রচিত হয়। ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি বাস্তবায়ন ও ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশ গঠনে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিরলস কাজ করে যাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
গণশুনানি অনুষ্ঠানে জালালাবাদ গ্যাস টিঅ্যান্ডডি সিস্টেমস লিমিটেডের (জেজিটিডিএসএল) কোম্পানি সচিব মো. শহিদুল ইসলাম জানান, জালালাবাদ গ্যাসকে এরই মধ্যে অবৈধ সংযোগমুক্ত কোম্পানি ঘোষণা করা হয়েছে। অবৈধ গ্যাস সংযোগকারীদের কোনো ছাড় নেই বলে জানান তিনি। অনুষ্ঠানে জালালাবাদ গ্যাসের তৎকালিন জিএম (বিপণন-দক্ষিণ) বর্তমান এমডি প্রকৌশলী মনজুর আহমদ চৌধুরী ও জিএম (পরিকল্পনা) প্রকৌশলী এবিএম শরীফ বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানে শিল্প শ্রেণির ৯ জন, বাণিজ্যিক শ্রেণির একজন, সিএনজি শ্রেণির ছয়জন এবং চারজন আবাসিক শ্রেণির গ্রাহক বক্তব্য দেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সিলেটে প্রিপেইড মিটার স্থাপন প্রকল্পে প্রায় ১২০ কোটি টাকা ব্যয় হবে। এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে কাজ শুরু হয়ে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করা যাবে। দুই চুলার গ্যাসের জন্য এখন প্রতি মাসে গ্রাহক এক হাজার টাকার ওপরে বিল দিচ্ছেন। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে ছোট পরিবারের একজন গ্রাহক এক হাজার টাকায় ৩ মাস গ্যাস ব্যবহার করতে পারবেন। মাসে তার খরচ পড়বে ৩০০ টাকার মতো। এ ছাড়া গৃহস্থালি পর্যায়ে প্রিপেইড গ্যাস মিটার ব্যবহারের মাধ্যমে গ্রাহকদের মধ্যে গ্যাস ব্যবহারে সচেতনতা বৃদ্ধি, কোম্পানির ব্যবস্থাপনা দক্ষতা বৃদ্ধি এবং মনিটরিং ব্যয়ও কমবে।
কন্টাক্টলেস স্মার্ট কার্ডভিত্তিক উন্নত প্রযুক্তির মিটার জালালাবাদ গ্যাসের পক্ষ থেকে গ্রাহকদের বিনামূল্যে দেয়া হবে জানিয়ে প্রকল্প পরিচালক লিটন নন্দী দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, মিটারের মূল্য মাসিক ভাড়া হিসাবে সমন্বয় করা হবে। নিকটস্থ রিচার্জ পয়েন্ট থেকে স্মার্ট কার্ডের মাধ্যমে ক্রেডিট কিনে প্রিপেইড মিটার রিচার্জ করা যাবে। রিচার্জ শেষ হলেও এতে ইমার্জেন্সি ব্যালেন্সের সুবিধা থাকবে। তিনি বলেন, ঢাকা ও চট্টগ্রামে প্রিপেইড গ্যাস মিটার থাকলেও সিলেটে প্রথমবারের মতো চালু করা হচ্ছে এ পদ্ধতি। ইতোমধ্যে রাজধানী ঢাকাতে ৩ লাখ গ্যাসের চুলা প্রিপেইট মিটারের আওতায় এসেছে। রাজধানীতে প্রকল্পটি জনপ্রিয় হয়েছে। ঢাকায় অনেক গ্রাহক নিজ থেকে প্রিপেইড মিটার স্থাপনের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দ্বারস্থ হচ্ছেন।
জালালাবাদ গ্যাস (জেজিটিডিএসএল) কর্মকর্তারা জানান, এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে প্রতিটি আবাসিক গ্রাহকের মাসিক গড় গ্যাস ব্যবহার ৬৬ ঘনমিটার থেকে ৪০ ঘনমিটারে নেমে আসবে। ফলে গ্রাহকপ্রতি গ্যাস সাশ্রয় হবে গড়ে ২৬ ঘনমিটার। গ্যাস বিতরণ লাইন লিকেজজনিত অপচয়ও রোধ হবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ১ম ধাপে সিলেট নগরীর কিছু জায়গায় কাজ শুরু করতে সার্ভে করা হয়েছে। জায়গাগুলো হচ্ছে, শাহজালাল উপশহর, হাউজিং এস্টেট, মিয়া ফাজিল চিশত, মিরাবাজার, মেহেন্দীবাগ, লামাবাজার, মেজরটিলা সহ তৎপাশর্^বর্তী এলাকা। প্রথমেই শাহজালাল উপশহর ও হাউজিং এস্টেট আবাসিক এলাকায় পাইলটিং ভিত্তিতে এই প্রকল্পের কাজ শুরু হবে। কারণ সরকারি মালিকানাধীন এই দুই আবাসিক এলাকা পরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে। তাই এখানে কাজ করা সহজ হবে।
এ ব্যাপারে জালালাবাদ গ্যাস টিঅ্যান্ডডি সিস্টেমস লিমিটেডের (জেজিটিডিএসএল) এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মঞ্জুর আহমদ চৌধুরী দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, প্রিপেইড মিটারের কাজ আরো আগে শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনা মহামারীসহ বৈশি^ক সংকটের কারণে বিলম্বিত হয়েছে। এপ্রিলের মাঝামাঝিতে কাজ শুরু হবে চলতি ডিসেম্বরের মধ্যেই ১ম ধাপের ৫০ হাজার প্রিপেইড মিটার স্থাপনের কাজ শেষ করা হবে। এরপর পরবর্তীতে আরেক ধাপে আরেকটি প্রকল্পের মাধ্যমে বাকীদেরও প্রিপেইড মিটারের আওতায় আনা হবে।
তিনি বলেন, গ্যাসের চুলা প্রিপেইড মিটারের আওতায় এলে গ্রাকরাই সবদিক থেকে উপক্রিত হবেন। বিল দেয়ার জন্য ব্যাংকে লাইন ধরতে হবেনা। ঘরে বসেই টাকা রিচার্জ করতে পারবেন। পুুরো মাস বন্ধ থাকলে বিল আসবেনা। এতে গ্যাসের সাশ্রয়ের পাশাপাশি গ্রাহকের অর্থ সাশ্রয় হবে।