বিদ্যুতের জোয়াল কতো টানবে জনগণ
প্রকাশিত হয়েছে : ০৬ এপ্রিল ২০২৩, ২:৫৩:১৭ অপরাহ্ন
প্রাত্যাহিক জীবনে বিদ্যুৎ একটি অপরিহার্য জিনিস, জরুরী সেবা। কিন্তু এই জিনিসটি এখন এদেশের সাধারণ জনগণের জন্য দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিদ্যুৎ না থাকলে মহাবিপদ, আবার থাকা সত্বেও অনেক বিপদ ও সমস্যা। বিদ্যুৎ না থাকলে এদেশবাসীর জীবনযাত্রা প্রায় অচল হয়ে পড়ে। যখন বিদ্যুৎ বিভ্রাট, লোডশেডিং বা রক্ষণাবেক্ষণ ও অন্যান্য কারণে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকে, তখন জনজীবন স্থবির হয়ে পড়ে, অচল হয়ে পড়ে ব্যবসা বাণিজ্য। আর সরবরাহ অব্যাহত থাকলেও বিদ্যুতের জন্য অস্বাভাবিক হারে মূল্য প্রদান এমনকি বিদ্যুতের প্রিপেইড মিটার রিচার্জ করতে গিয়ে চরম ভোগান্তির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। জানা গেছে, বিদ্যুতের দাম আরো কয়েক দফা বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
বিদ্যুৎ খাতে লোকসান থেকে বের হতে পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। এজন্য ইতোমধ্যে তিন দফায় বিদ্যুতের ৫ শতাংশ হারে মোট ১৫ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়েছে। আরো কয়েক দফা দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের পক্ষ থেকেও বিদ্যুতের ভর্তুকি কমানোর চাপ রয়েছে। এভাবে প্রতিনিয়ত বাড়ছে বিদ্যুতের ব্যয়। এতে বিদ্যুৎ কেনার ব্যয় সংকুলান নিয়ে চাপে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। একদিকে জ্বালানীর অতিরিক্ত ব্যয়, অন্যদিকে বিপুল অংকের ক্যাপাসিটি চার্জ। সব মিলিয়ে ২০২২-২৩ অর্থ বছরের বাজেটে প্রস্তাবিত অর্থ দিয়ে বিদ্যুৎ ক্রয়ের ব্যয় সংকুলান অসম্ভব হয়ে পড়েছে, এমন ভাষ্য সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের। তাদের মতে, এ অবস্থায় নতুন করে সংশোধন করা হয়েছে ২০২২-২৩ অর্থ বছরে বিডিপি’র জন্য বরাদ্দকৃত বাজেট। চলতি ২০২২-২৩ অর্থ বছরের বাজেটে বিদ্যুৎ কেনা বাবদ বিপিডিকে অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়েছিলো ৬০ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা। মার্চে তা বাড়িয়ে এ বাবদ ৮৪ হাজার ৭৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ের অনুমোদন দিয়েছে অর্থ বিভাগ। সেই অনুযায়ী, এবার বিপিডি’র বিদ্যুৎ কেনার ব্যয় বাড়ছে প্রস্তাবিত বাজেটের তুলনায় ২৩ হাজার ৮২৯ কোটি টাকা।
বিপিডি’র সদস্য (অর্থ) সেখ আখতার হোসেন বলেন, বিদ্যুৎ ক্রয় বাবদ বিপিডি’র ব্যয় বাড়ার একটি কারণ জ্বালানী খরচ। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানী তেলের দাম বাড়ার কারণে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জ্বালানী আমদানীতে খরচ বেড়েছে। এছাড়া ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে বড় অংকের ঘাটতিও তৈরী হয়েছে।
অতিরিক্ত দামে বিদ্যুৎ কিনতে গিয়ে বিপিডি’র পুঞ্জিভূত লোকসান বেড়ে ৬৫ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। বিদ্যুতের নীতি ও গবেষণা সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, বিদ্যুৎ খাতে সরকারের এখন পরিকল্পনা হচ্ছে ভর্তুকি থেকে বেরিয়ে আসা। কারণ ভর্তুকি দিলে এই খাতে ধনিক শ্রেণীই লাভবান হয়। ফলে পর্যায়ক্রমে এ থেকে বেরিয়ে এসে সব শ্রেণীর গ্রাহকের বিদ্যুৎ সুবিধা নিশ্চিত করা হবে।
গত জানুয়ারী মাসে ডেইলী স্টার-এ ‘শুধু অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বিল নয়, দৈনন্দিন খরচও বেড়ে যাবে’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, বিদ্যুতের দাম বাড়ার ফলে ভোক্তা পর্যায়ে ব্যয় তো বাড়বেই, একই সঙ্গে বিদ্যুৎ ভিত্তিক কৃষি ও শিল্পখাতে উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। ফলে বিভিন্ন জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। এই দাম বৃদ্ধির ফলে সরকারের ভর্তুকি হয়তো কিছুটা কমবে, কিন্তু এর ফলে ভোক্তা পর্যায়ে বিদ্যুতের যে প্রাপ্যতা, সেটা বাড়বে না। বরং বিদ্যুৎ পাওয়ার ক্ষেত্রে যেসব চ্যালেঞ্জ আছে, তা থেকেই যাবে অর্থাৎ মূল্যবৃদ্ধির কোন সুফল ভোক্তা পর্যায়ে বা উৎপাদক পর্যায়ে নেই।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে পাশ কাটিয়ে সরকারের এই দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তটি কার্যত: বিইআরসিকে অকেজো করে ফেলা বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বলেন, এর মাধ্যমে সরকার বিদ্যুৎ খাতে দীর্ঘমেয়াদী যে সমস্যাগুলো ছিলো সেগুলোকে পাশ কাটিয়ে অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ের বোঝা আবার ভোক্তাদের ওপর চাপিয়েছে।
বিদ্যুৎ সংক্রান্ত সরকারী কর্তৃপক্ষসমূহের প্রদত্ত বক্তব্য থেকে যা বোঝা যাচ্ছে, তা হচ্ছে, তারা তাদের ব্যয়ভার কমাতে উদগ্রীব। কিন্তু এই ব্যয়ভার বা ভর্তুকি কমাতে গিয়ে সাধারণ মানুষের ঘাড়ে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির যে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে, এদিকে তারা খুব সামান্যই মনোযোগ দিচ্ছেন।
আমাদের কথা হচ্ছে, বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে মূলত: এদেশের জনগণের জন্য। বিদ্যুৎ বিভাগসহ সরকারের সকল সংস্থা ও দেশের জনগণের জন্য, তাদের কল্যাণে নিয়োজিত। কিন্তু বিদ্যুতের ঘাটতি কমিয়ে সরকার তথা দেশের কল্যাণ করতে গিয়ে জনগণের জীবন যদি দুর্বিসহ করে তোলা হয়, তবে এই বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রয়োজন বা সার্থকতা কোথায়?
মোদ্দা কথা, ভর্তুকি কমাতে গিয়ে সাধারণ মানুষকে দারিদ্র্যের শেষ প্রান্তে ঠেলে দিলে দেশের কী লাভ হবে। দেশের উন্নয়ন যদি লক্ষ্য হয়, তবে দেশের মানুষের দুর্ভোগ হ্রাস এবং জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি করতে হবে সরকারকে। আর ক্ষমতাসীন মহলসহ কিছু সরকারীয় আমলাদের পকেট ভারী ও আখের গোছানো যদি উদ্দেশ্য হয়, তবে সরকার ভর্তুকি কমানোর জন্য জনগণের কাঁধে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির জোয়াল যতোটা খুশী ততোটা চাপাতে পারে। এ ব্যাপারে জবাবদিহিতাহীন বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ তথা সরকারের বিরুদ্ধে আমাদের কিছুই বলার নেই।