ফুটপাত-সড়ক-হকার একাকার!
প্রকাশিত হয়েছে : ১২ এপ্রিল ২০২৩, ৩:০১:০৪ অপরাহ্ন

নগরের ব্যস্ততম বন্দরবাজার
মুনশী ইকবাল ::
বন্দরবাজারকে বলা হয় সিলেট নগরের প্রাণকেন্দ্র। এখানেই রয়েছে নগরভবন, জেলা প্রশাসকের অফিস, পুলিশ সুপারের কার্যালয় এবং আদালত। রয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও একাধিক মসজিদ। ব্যস্ততম ও গুরুত্বপূর্ণ এ বন্দরবাজার থাকার কথা সবচেয়ে গোছানো। কিন্তু যুগের পর যুগ ধরে এই বন্দরবাজারই নগরের সবচেয়ে অগোছালো এলাকা। সাম্প্রতিক সময়ে এই বাজারটি যেন আরো অগোছালো হয়ে পড়েছে। পুরো বন্দরবাজার রাস্তা, ফুটপাত, যানবাহন আর হকারে একাকার। বিশেষ করে পোস্ট অফিস থেকে নগরভবনের সামনে তাকালে বুঝার উপায় নেই যে, এটি সড়ক না কি বাজার!
শুরুতে কেবল ফুটপাত দখল করে বাজার গড়ে উঠলেও এখন ফুটপাত ছাড়িয়ে তা রাস্তায়ও নেমে এসেছে। আগে রাস্তার কিছু অংশ জুড়ে রাত ৮টার পর হকার ও ভ্যানওয়ালাদের দোকানপাট বসতে দেখা গেলেও এখন সকাল থেকেই ধীরে ধীরে রাস্তাজুড়ে বসতে শুরু করেন হকাররা। দুপুরের পর রাস্তার বেশিরভাগ দখলে চলে যায় হকারদের। শুধু নগরভবনের গেইটের সামনের কয়েকশ গজ দখলে থাকে সিএনজি অটোরিকশা ওয়ালাদের। তাদের এই দখল রাজত্বে চরম বিড়ম্বনায় পড়েন যাত্রী, ক্রেতা এবং এই এলাকায় বিভিন্ন কাজে আসা লোকজন। রাস্তা হকার আর সিএনজির দখলে থাকায় দীর্ঘসময় লেগে থাকে যানজট। পথচারীদের সাথে হকারদের প্রায় সময়ই বাকবিতন্ডা লেগে থাকে। যানজটের কারণে এই এলাকায় রিকশাওয়ালারা আসতে চান না, কেউ আসতে চাইলে ভাড়া বেশি চান।
সিলেটের সবচেয়ে বড়ো পাইকারি বাজার কালীঘাট ও মহাজনপট্টি যেতে হয় এই রাস্তা দিয়ে। এসব বাজার থেকে পাইকারি মালামাল কিনে লোকজন রিকশা, ভ্যান ইত্যাদি দিয়ে মালামাল নিয়ে নিজেদের গন্তব্যে যান। অনেকে বিয়ের বাজার করতে আত্মীয় স্বজনের বহর নিয়ে মহাজনপট্টির পাইকারি শাড়ির দোকানগুলোতে আসেন। আর তখনই তাদের দুর্ভোগে পড়তে হয়। হকার আর যানজটে রাস্তা ব্লক থাকায় কোনো রিকশা যেতে চায় না। মালামাল নিয়ে দীর্ঘক্ষণ দাড়িয়ে থাকতে হয়।
গতকাল ছিল চৈত্রের তীব্র দাবদাহ। তাপমাত্রা ছিল ৩৫ ডিগ্রির কোটায়। বিকেল ৩ টার দিকে মিউনিসিপ্যালিটি মার্কেটের সামনে কথা হয় এক স্টেশনারী ব্যবসায়ীর সাথে। তিনি তার দোকানের জন্য দিস্তা কাগজের কয়েকটি বান্ডিল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন রিকশার অপেক্ষায়। এই ব্যবসায়ী বলেন, দোকানে বিক্রির জন্য পেছনের পাইকারী মার্কেট থেকে কাগজ কিনি। ভারি বোঝা বয়ে নেওয়া সম্ভব নয় কিন্তু গরমে রোদের মধ্যে রোজার মাসে প্রায় আধাঘণ্টা ধরে দাঁড়ানো, কিন্তু কোনো রিকশা থামে না। রাস্তায় কোনো রকমে রিকশা গাড়ি চলছে। পুরোটাই হকারদের ভ্যান আর তরকারির ঝুড়িতে পরিপূর্ণ। ফলে যানজটের ভয়ে কেউ এখানে থামে না, যেতেও চায় না। যারা যেতে চায় তারা ভাড়া বেশি চায় কিন্তু অল্প টাকার ব্যবসায় কয় টাকাই বা লাভ হয়। ভাড়ার পেছনেই যদি টাকা চলে যায় তাহলে ব্যবসা করে চলবো কীভাবে? নগরভবনের মতো অফিসের সামনে কীভাবে এরকম একটি বাজার রাস্তা দখল করে দিনে দুপুরে বসে থাকে তা নিয়ে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেন। বলেন হাতে কাগজের বোঝা নিয়ে যে একটু সামনে এগিয়ে রিকশায় খুঁজবো তারও উপায় নেই। হাঁটবো কোথায়? আগে ছিল ফুটপাত দখল, এখন রাস্তা। রিকশা গাড়িই রাস্তায় চলতে পারছে না মানুষ হাঁটবে কীভাবে। সোমবার বিকেলে দেখা যায় নগরভাবনের সামনে থেকে করিমউল্লাহ মার্কেটের বিপরীত পয়েন্ট পর্যন্ত রাস্তা প্রায় পুরোটাই হকারদের দখলে। ফুটপাত ছাড়িয়ে মূল সড়কে কয়েক দফায় রাস্তা দখল করে রেখেছেন ভাসমান বিক্রেতারা। তাদের বিক্রিকৃত পণ্যের বেশিরভাগই আলু, পেঁয়াজ, রসুন, আদা। এরবাইরে বড়ো একটা অংশ সবজি। আছেন ছোটো ছোটো দু চাকার গাড়ি করে আশ্চর্য মলমসহ ইঁদুর, তেলাপোকা, ছাড়পোকার মারার বিষ বিক্রেতারাও। দখলকরা জায়গাগুলোও বিভিন্ন ধাপে সাজানো। ফুটপাত ও এর সাথের সড়কে কাঁধে বহনযোগ্য ঝাঁপিতে বিভিন্ন পদের তরকারিওয়ালা, এর সামনে ভ্যানে আলু, পেঁয়াজের বিক্রেতারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে কেউ বসে কেউ দাঁড়িয়ে পণ্য বিক্রি করছেন। তাদের সাথে দরদাম করছেন অনেক ক্রেতা। তবে কেনাকাটার চেয়ে বাকবিতন্ডাই হচ্ছে বেশি। কমদামে পণ্য কিনতে গিয়ে এখানে প্রায় সময়ই পচা পণ্য কিনে ঠকার অভিযোগ অনেক ক্রেতার। এসব হকারের দোকানের মতো কোনো ঠিকানা না থাকায় একবার পণ্য কিনে আপত্তি থাকলে পরে এসে আর তা বদলের সুযোগ থাকে না।
সরেজমিন দেখা গেছে একটা সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয় এসব হকার। প্রতিটি ভ্যান বা হকার পণ্যের একই দাম হাঁকেন। নির্ধারিত ফি না দিয়ে কেউ এখানে ভ্যান রাখতে পারেন না। কিন্তু কাদের ফি দেন তা বলতে রাজি হননি কোনো হকার। হকারদের সাথে কথা বলে জানা যায় এসব পজিশন বেশিরভাগ অনেক প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের থেকে তারা ভাড়া নেন। কেউ কেউ তাদের ভাড়ায় এখানে বসান। তারাই নগরভবন ও প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করেন। তারা বলেন আমাদের তুলে দিলে কেবল আমরা লোকসানে পড়বো তা নয় বরং এতে ওসব নেতা ও নগরভবনের লোকদেরও পাতে টান পড়বে। সবাই মিলেমিশে এখানে ব্যবসা চলে। একজন বলেন হকার থাকলেও গাড়ি চলবে না থাকলেও চলবে। তাই হকারদের রেখে গাড়ি চললে সমস্যা কী?
আনোয়ার হোসেন নামে হাসান মার্কেটের দক্ষিণ দিকের এক ব্যবসায়ী বলেন হকার আর সিএনজির দখলের কারণে এই এলাকায় সবসময় যানজট লেগে থাকে। এতে আমাদের ব্যবসায় সমস্যা হয়। ক্রেতারা নির্বিঘ্নে আসতে পারেন না। আমাদের অনেক মহিলা কাস্টমারও আছেন যারা রিকশা ছাড়া আসতে যাদের কষ্ট হয়। তারা অনেক কষ্ট করে হেঁটে আসেন। অনেকেই এসব বিড়ম্বনায় আসা কমিয়ে দিয়েছেন। এতে আমাদের ব্যবসাও কমেছে।