সুনামগঞ্জে খড় সংগ্রহের ধুম
প্রকাশিত হয়েছে : ০৬ মে ২০২৩, ৩:০০:৪১ অপরাহ্ন
হাওরে উঠছে ১০০ কোটি টাকার খড়
এমজেএইচ জামিল, সুনামগঞ্জ থেকে ফিরে :
কয়েক বছর পর ডর, ভয় ও শঙ্কাহীনভাবে উৎসবমূখর পরিবেশে বোরো ধান উত্তোলন করেছেন সুনামগঞ্জের হাওরপারের কৃষক। ইতোমধ্যে প্রায় শেষের পথে ধান উত্তোলন। রৌদ্রজ্জ্বল আবহাওয়া থাকায় ধান শুকানোর শেষ দিকে এসে গোখাদ্য খড় সংগ্রহে ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা। জেলায় শতভাগ বোরো ধান উত্তোলনের পাশাপাশি এবছর ১০০ কোটি টাকার খড় সংগ্রহের আশা করছে প্রাণি সম্পদ বিভাগ। যা থেকে হাওরাঞ্চলের ১০ লাখ গবাদি পশুর এক বছরের খাদ্য মজুদ হবে।
সরেজমিনে জেলার কয়েকটি হাওরঘুরে ও কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৭ সালে হাওরে ব্যাপক ফসলহানির পর এবার কোনো ঝামেলা ছাড়াই বোরো ধান গোলায় তুলতে পেরেছেন হাওরপারের কৃষক। গত বছরের এপ্রিলেও পাহাড়ি ঢলে বেশ কয়েকটি হাওরে ফসলহানি ঘটে। এরপর জুন মাসের ভয়াবহ বন্যায় গোলায় রাখা ধানও নষ্ট হয়ে যায়। কয়েক বছর পর এবারই প্রত্যাশার চেয়ে বেশি ধান পেয়েছেন কৃষকেরা। তাই হাওরজুড়ে অন্যরকম এক উৎসব চলছে। দিনরাত ব্যস্ত হাওরের কৃষক পরিবারের লোকজন। ধান তোলার কাজ শেষে এবার গোখাদ্য খড় উত্তোলনে ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা। গেল বন্যায় গোলায় রাখা ধানের সাথে প্রায় অধিকাংশ কৃষকের গোখাদ্য নষ্ট হয়। ফলে গোখাদ্য কিনে পশুকে বাচিয়ে রাখেন তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সুনামগঞ্জে চলতি বছর প্রায় ১ হাজার হার্ভেস্টর যন্ত্রে হাওরের বোরো ধান দ্রুত কাটা হয়েছে। কর্তন ও মাড়াই এক সঙ্গে হওয়ায় ধান সংগ্রহ সহজ হয়েছে কৃষকের। কৃষকের সময় ও কষ্ট লাঘব হলেও এবার গবাদি পশুর খাদ্য সংগ্রহ নিয়ে দুর্ভোগে পড়েছেন কৃষক। তারা জানিয়েছেন এখনো হাওরের কৃষি নির্ভরশীল গবাদিপশুর উপর। আর এই গবাদি পশুর খাবার প্রাকৃতিকভাবে হাওরের খড় থেকে সংগ্রহ করেন। যা মাড়াই শেষে সংগ্রহ করে থাকেন কৃষকরা। কিন্তু এবার বেশিরভাগ এলাকায় হার্ভেস্টরে ধান কর্তন ও মাড়াই করার কারণে সহজে গোখাদ্য সংগ্রহ করতে পারছেননা কৃষক।
সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জেলায় প্রায় ৪ লাখ কৃষক পরিবার রয়েছে। যারা হাওরে হালচাষ করেন। এ বছর প্রায় ১ হাজার হার্ভেস্টর যন্ত্রে ধান কর্তন করেছেন কৃষক। প্রায় দুই শতাধিক রিপার যন্ত্রও ছিল। হার্ভেস্টর যন্ত্রে দিনে ৩০ বিঘা জমির ধান কাটা ও মাড়াই করা যায় সহজে। তবে হার্ভেস্টরে ধান কর্তন করতে গিয়ে প্রাকৃতিক গোখাদ্য খড় সংগ্রহের কোন সুযোগ নেই। যার ফলে কৃষকদের ধান কর্তনের পর আলাদাভাবে শ্রমিক লাগিয়ে খড় সংগ্রহ করতে হচ্ছে। এতে তাদের বাড়তি অর্থ লাগছে এবং খাদ্য হিসেবে খড় প্রস্তুত করতে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করতে হচ্ছে। অন্যান্য বছর ধান তোলা শেষ হলে কৃষকরা আনুষ্ঠানিকভাবে উৎসবের মাধ্যমে গোখাদ্য সংগ্রহ করেন। ‘খেড়ের লাছি’ বা (খড়ের গম্বুজ) করে তারা খড় সংগ্রহ করেন।
সুনামগঞ্জ প্রাণিসম্পদ অফিস সূত্রে জানা গেছে, সুনামগঞ্জের হাওরে প্রাকৃতিকভাবে হাওরের ধান কাটা শেষে প্রায় ৪ লাখ মেট্রিক টন খড় উৎপাদন হয়। যা এই অঞ্চলের প্রায় ১০ লক্ষ গবাদিপশুর খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে বছরের পর বছর। হাওরে উৎপাদিত এই খড়ের মূল্য প্রায় ১০০ কোটি টাকা। বর্ষার পুরোটা সময় সংগৃহিত এই প্রাকৃতিক খড় খাইয়ে চাষাবাদের গবাদিপশুকে বাঁচিয়ে রাখেন কৃষকরা। কোন কারণে হাওরের ফসলডুবি হলে গোখাদ্যের চরম সংকট দেখা দেয় হাওরে।
ছাতক উপজেলার জাউয়াবাজার ইউনিয়নের ডেকার হাওর (দেখার হাওরের) কৃষক ফরহাস আহমদ বলেন, এবার হাওরের ধান কাটা ও মাড়াই সহজ হলেও খড় সংগ্রহ করতে আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। কারণ যন্ত্রে খড় সংগ্রহের কোন সুযোগ নাই। তাই নতুন করে শ্রমিক লাগিয়ে ক্ষেত থেকে কেটে খড় সংগ্রহ করতে হচ্ছে। এতে সময় ও অর্থ অপচয় হচ্ছে এবং খড়ের গুণও থাকছেনা।
শান্তিগঞ্জ উপজেলার সাংহাই হাওরের কৃষক শানুর আহমদ বলেন, আবহমান কাল থেকেই আমরা বৈশাখে খড় সংগ্রহ করি উৎসবের মাধ্যমে। খেড়ের লাইছ করে আনন্দ ফুর্তি করি। কিন্তু এবার এই সুযোগ নেই। কারণ যন্ত্রে ধান কাটার ফলে আমাদের খড় সংগ্রহের সুযোগ বাঁধাগ্রস্থ হয়েছে।
হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সুনামগঞ্জ জেলা সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল হক মিলন দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, হাওরের কৃষকরা প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত খড় দিয়েই পশু খাদ্যের চাহিদা মিটিয়ে থাকেন। আবহমানকাল থেকেই ধান কাটার পর মাড়াইকৃত খড় গবাদিপশুর খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করেন। কিন্তু এবার যন্ত্রে ধান কাটার ফলে সেই সুযোগ কমে গেছে। এটি হাওরের কৃষকের জন্য একটি নতুন সংকট। তবে যাদের গবাদি পশু রয়েছে তারা যেভাবেই হোক খড় সংগ্রহ করছেন। ধান তোলা শেষে হাওর এলাকার কৃষকগণ খড় তোলায় ব্যস্ত সময় পার করছেন।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. আসাদুজ্জামান বলেন, হাওরাঞ্চলে প্রায় ১০ লাখ গবাদিপশু রয়েছে। এই পশুগুলোর বেশিরভাগ খাদ্যই হাওরের প্রাকৃতিক খড়। যা ধান কাটার পর কৃষকরা সংগ্রহ করেন। তবে সুনামগঞ্জে যন্ত্রে ধান কাটায় খড় কিছুটা নষ্ট হয়েছে। তবে শেষ সময়ে দিন ভালো থাকায় কৃষকগণ চাহিদামতো খড় সংগ্রহ করেছেন। আরো কয়েকদিন তারা খড় সংগ্রহে ব্যস্ত সময় কাটাবেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সুনামগঞ্জের উপ-পরিচালক বিমল চন্দ্র সোম দৈনিক জালালাবাদকে জানান, এবার জেলার প্রায় ৪ লাখ কৃষক পরিবার ১৪২টি ছোট বড় হাওরে বোরো আবাদ করেছিলেন। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ১২টি উপজেলায় হাওরে শতভাগ ধান কাটা শেষ। অপরদিকে হাওরের বাইরে (নন হাওর) ৬০ ভাগ ধান কাটা শেষ হয়েছে। তবে পুরো জেলায় এর পরিমাণ ২০ হাজার হেক্টরের বেশী নয়। আগামী ৪/৫ দিনের মধ্যে এসব ধানও শতভাগ তোলা হয়ে যাবে।
তিনি জানান, এবার জেলায় বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ২২ হাজার ৩০০ হেক্টর। আবাদ হয়েছে ২ লাখ ২২ হাজার ৭৯৫ হেক্টর। জেলায় এবার সবচেয়ে বেশি আবাদ হয়েছে উফশী ধান। প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার উফশী আবাদ হয়েছে। হাইব্রিড ৬০ হাজার ৮০০ হেক্টর এবং দেশি ১ হাজার ৩৭০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। উৎপাদিত ধান থেকে প্রায় ৯ লাখ টন চাল পাওয়া যাবে। যা স্থানীয় চাহিদার ৬ লাখ টন মিটিয়ে আরও ৩ লাখ টনের বেশি চাল উদ্ধৃত্ত থাকবে। এ বছর ফলন ভালো হওয়ায় লক্ষ্যমাত্রায় কোনো প্রভাব পড়েনি। হাওরে উৎপাদিত ধানের মূল্য প্রায় ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকার বেশি।