উচ্চ শিক্ষায় ভর্তিতে বাণিজ্য ২ হাজার কোটি টাকা
প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ মে ২০২৩, ১১:০০:১০ অপরাহ্ন
জালালাবাদ ডেস্ক: উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরই শুরু হয়ে যায় শিক্ষার্থীদের দৌড়াদৌড়ি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পর্যন্ত সাত-আট মাস তারা ব্যয় করে কোচিং সেন্টারের পেছনে। অনেকে তিন-চারটি কোচিং সেন্টারেও পড়ে থাকেন। কোচিংয়ে ভর্তি না হয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বা মেডিকেলে সুযোগ পাওয়ার নজির খুব কম।
কোচিংয়ের পেছনে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঢালার পর শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি ফরম কেনার প্রতিযোগিতা। ২২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের গুচ্ছে যুক্ত হওয়ার পরও একজন শিক্ষার্থী আট-দশটি ভর্তি ফরম কিনে থাকে। এতেও বড় অঙ্কের টাকা ব্যয় করতে হয় অভিভাবকদের।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে কোচিং সেন্টার ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরম কেনার জন্য প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হয়। এই টাকার সিংহভাগ যায় ১৫ কোচিং সেন্টারের পকেটে। আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে বেশি আয় করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়ও কম নয়। এ আয়ের ভাগ পান ভর্তি-সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা। ভর্তি ফরম বিক্রি থেকে আয় করা টাকার বড় অংশ ব্যয় না হলেও প্রতি বছরই ফরমের দাম বাড়ায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।
অভিযোগ রয়েছে, কোচিং সেন্টারগুলোর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষকের যোগসাজশ রয়েছে। কিছুু কোচিং সেন্টারে পড়লে মেডিকেল বা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়া অনেক সহজ হয়। বলা চলে শিক্ষার্থীরা কোচিং সেন্টারে যেতে বাধ্য হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘আমাদের ছেলেমেয়েরা যারা বাইরে পড়তে যায়, তাদের তো ওইসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে হয় না। তাহলে আমাদের কেন ভর্তি পরীক্ষা নিতে হচ্ছে? আসলে আমাদের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা যথার্থ ও নির্ভরযোগ্য করা সম্ভব হয়নি। সেটা হলে ফলের ভিত্তিতেই ভর্তি করা যেত। শিক্ষার্থীদের কোচিংয়ের পেছনে দৌড়ানোর প্রয়োজন হবে না।’
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ প্রণয়ন কমিটির সদস্য অধ্যাপক ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য শিক্ষার্থীদের এসএসসি ও এইচএসসি পর্যায় থেকেই প্রস্তুত করতে হবে। সে অনুযায়ী পরীক্ষা নিতে হবে। ফলের ভিত্তিতে ভর্তি করা হলে এইচএসসি পরীক্ষার পর সাত-আট মাস বসে থাকতে হবে না। দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীরা কোচিং না করার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে না, সেটাও আর হতো না। শিক্ষায় বৈষম্য অনেক কমে যেত।’
সূত্র জানায়, ২০২২ সালের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় ১০ লাখ ১১ হাজার ৯৮৭ জন শিক্ষার্থী। জিপিএ ৫ পেয়েছে ১ লাখ ৭৬ হাজার ২৮২ জন। জিপিএ ৪ থেকে ৫-এর নিচে পেয়েছে ৪ লাখ ৪৯ হাজার ৬৩৯ জন। এই শিক্ষার্থীদের ৭০ শতাংশ নানা ধরনের কোচিংয়ের পেছনে ছুটে। অনেকেই একাধিক কোচিং সেন্টারে পড়ে থাকে। এদের বেশিরভাগই ঢাকায় থেকে কোচিং করে। তাদের বেশিরভাগ এ বছর কোচিং শেষ করে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে। মেডিকেল ভর্তি ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোরও আবেদন গ্রহণ শেষ পর্যায়ের দিকে।
শিক্ষার্থীরা জানায়, বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রস্তুতির জন্য কোচিং সেন্টারে তিন-চার মাসের একটি প্যাকেজের ফি দিতে হয় প্রায় ২২ হাজার টাকা। মেডিকেলসহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ইউনিট ভেদে এর পরিমাণ আবার ভিন্ন। কোচিং সেন্টার থেকে বই দেওয়া হলেও প্রায় শিক্ষার্থীই নিজের সেরা প্রস্তুতির জন্য বাড়তি কিছু বই কিনে থাকে। আর প্রতিদিন বিভিন্ন শিটের ফটোকপির বিষয় তো আছেই।
কোচিংয়ের শিক্ষকরাও আবার সব বিষয় পড়ান না। তখন শিক্ষার্থীদের সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট ব্যাচে পড়তে হয়। এতেও সাড়ে ৩ হাজার থেকে সাড়ে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ হয়। একজন শিক্ষার্থী, ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিকেল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য দুই-তিনটি কোচিং সেন্টারের সঙ্গে যুক্ত থাকে। থাকা-খাওয়া ছাড়া কোচিংয়ের পেছনেই একজন শিক্ষার্থীর প্রায় ৪০ হাজার টাকা ব্যয় হয়।
পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ৪ লাখ ৩৮ হাজার শিক্ষার্থী কোচিংয়ের পেছনে ৪০ হাজার টাকা করে ব্যয় করলে এক সেশনেই কোচিংয়ে আয় হয় প্রায় ১ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা। আর ৩ লাখ শিক্ষার্থী যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি গুচ্ছ, প্রকৌশল গুচ্ছ, সাধারণ গুচ্ছে ভর্তি ফরম কেনে তাহলে গড়ে ১ হাজার ২০০ টাকা করে ফি হলেও ব্যয় করতে হয় প্রায় ২৮৮ কোটি টাকা।
জানা গেছে, গত বছর গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় প্রাথমিকভাবে আবেদন করেছিল ৩ লাখ ৬০ হাজার ৪০৬ জন শিক্ষার্থী। এবার গুচ্ছ ফরমের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১ হাজার ৫০০ টাকা। এবার মেডিকেল কলেজে ভর্তির জন্য এক হাজার টাকা ফি দিয়ে ১ লাখ ৩৯ হাজার ২১৭ জন আবেদন করেছিল। তাতে শিক্ষার্থীদের ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৪ কোটি টাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে প্রতি বছর কোচিং সেন্টার ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার বেশি বাণিজ্য করছে।
গত ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬ হাজার ৩৫টি আসনের বিপরীতে পাঁচটি ইউনিটে ২ লাখ ৯০ হাজার ৪৮০ জন শিক্ষার্থী আবেদন করেছিল। আবেদন ফি ছিল ১০০০ টাকা। আবেদনপিছু অনলাইন সার্ভিস চার্জ ও ব্যাংক পেমেন্ট সার্ভিস চার্জ বাবদ ৪৩ টাকা ৫০ পয়সা খরচ ছিল। এই খরচ বাদ দিলে আবেদন ফি থেকে ২৭ কোটি ৭৮ লাখ ৪৪ হাজার ১২০ টাকা সংগ্রহ করেছিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। যদিও এর অর্ধেকের কম পরীক্ষা আয়োজন করতে খরচ হয়েছে।
ভর্তি ফরম বিক্রি বাবদ আয় করা টাকা প্রায়ই বাটোয়ারা করে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিরুদ্ধে। নিয়ম হলো, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি ফরম বিক্রি করে যে টাকা আয় করবে, তার ৬০ শতাংশ পরীক্ষা সংক্রান্ত খাতে ব্যয় করতে পারবে। আর ৪০ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাগারে দিতে হবে। গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য এই নিয়ম প্রযোজ্য নয়।
গুচ্ছে অন্তর্ভুক্ত নয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। তারপরও তারা ভর্তি আবেদন থেকে আয় করা টাকার ৪০ শতাংশ কোষাগারে জমা দেয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) এক তদন্তে দেখা গেছে, ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি ফরম বিক্রি বাবদ আয় করেছিল প্রায় ২০ কোটি টাকা। এর ৪০ শতাংশ বা প্রায় ৮ কোটি টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাগারে জমা হওয়ার কথা। ওই শিক্ষাবর্ষে ওই পরিমাণ টাকা কোষাগারে জমা হয়নি। ভর্তি-সংশ্লিষ্টরা ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছেন।
ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কমাতে আমরা গুচ্ছ পদ্ধতির প্রবর্তন করেছি। আগামী বছর থেকে একটা মাত্র পরীক্ষার মাধ্যমে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরিকল্পনা করা হয়েছে। তা হলে শিক্ষার্থীদের ভর্তি ফরম কেনার খরচ কমবে। এরপরও বলব, আমাদের মানসিকতা বদলাতে হবে। তখন অনেক কিছুই করা সম্ভব।’