হারিয়ে যাচ্ছে নদী: ৪০ বছরে অর্ধেকে নেমেছে পদ্মার আয়তন
প্রকাশিত হয়েছে : ০৭ মে ২০২৩, ১০:০২:৩২ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট: বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। নদী ঘিরেই এদেশের মানুষের জীবনকাল প্রবাহমান আবহমানকাল ধরে। কিন্তু নদী শাসনের নামে নদী শোষণ এদেশের মানুষের জন্য এক অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই অভিশাপ নদীতে বাঁধ। উজানে প্রতিবেশী দেশের স্বেচ্ছাচারী বাঁধে বিপর্যস্ত ভাটির জনপদ বাংলাদেশের অনেক মানুষের। এর সময়ের খরস্রোতা নদীর অনেকগুলো আজ বিলীন। বড়ো বড়ো নদীগুলো প্রতিনিয়ত খালে পরিণত হচ্ছে। পদ্মা, সুরমা, তিস্তার আজ মরণ দশা। এভাবে চললে অচিরেই খালে বিলীন হয়ে যাবে শতবছরের ইতিহাস বয়ে বেড়ানো নদীগুলো। সম্প্রতি এক গবেষণায় সেই চিত্রই ফুটে উঠলো।
৪০ বছরের ব্যবধানে পদ্মা নদীর আয়তন নেমেছে অর্ধেকে। এতে পানির গভীরতার পাশাপাশি কমেছে প্রবাহ। আবাসস্থল হারিয়ে বিলুপ্তির আশঙ্কায় বিভিন্ন দেশীয় প্রজাতির মাছ। হুমকিতে পড়েছে পদ্মার পুরো জীববৈচিত্র্য। ফারাক্কা বাঁধের কারণেই এ সংকট সৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছেন গবেষকরা।
স্প্রিংগার থেকে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী ‘বায়োডাইভারসিটি অ্যান্ড কনজারভেশন’ ২০২৩ সালের জানুয়ারি সংখ্যায় এ তথ্য উঠে এসেছে বলে জানিয়েছেন একদল গবেষক। এতে বলা হয়, ১৯৮৪ সালের তুলনায় শুকনো মৌসুমে পদ্মা নদীর আয়তন কমেছে প্রায় ৫০ শতাংশ। পানির গভীরতা কমেছে ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ। প্রবাহ কমেছে ২৬ দশমিক ২ শতাংশ। আর মিঠা পানির সরবরাহ সর্বোচ্চ ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে।
এছাড়া পদ্মা অববাহিকায় বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ১৯ দশমিক ২ শতাংশ কমেছে। ১৯৮১ সালে যেখানে তাপমাত্রা ছিল ২৫ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ২০১৯ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬ দশমিক ২ ডিগ্রিতে। মূলত পদ্মার প্রকৃত অবস্থা বুঝতেই গবেষণার জন্য শুকনো মৌসুমকে বেছে নেয়া হয় বলে জানান গবেষকরা।
গবেষক দলটিতে ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শামস মুহা. গালিব। তিনি বলেন, ‘আমরা ১৯৮২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত পদ্মার হাইড্রোলজিক্যাল, জলবায়ু ও নৃতাত্ত্বিক পরিবর্তনের সঙ্গে মৎস্য প্রজাতির সম্পর্কের প্রক্রিয়া অনুসন্ধান করছিলাম। এটা করতে গিয়ে দেখা গেছে, পদ্মার আয়তন বর্তমানে অর্ধেক কমে গেছে। এর প্রভাবে পদ্মার পুরো জীববৈচিত্র্যে প্রভাব পড়েছে।’
রাজশাহীর গোদাগাড়ী থেকে চারঘাটের সারদা পর্যন্ত পদ্মার ৭০ কিলোমিটার অংশ নিয়ে গবেষণাটি পরিচালিত হয়। ওই এলাকার নয়টি পয়েন্টে মৎস্য প্রজাতির নমুনা সংগ্রহ করা হয়। পদ্মাপাড়ের ২৭টি জেলেপল্লী থেকে নেয়া হয় তথ্য। স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবি বিশ্লেষণের মাধ্যমে পদ্মার বর্তমান চিত্র তুলে আনার চেষ্টা করেছে গবেষক দল।
হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে উৎপত্তি গঙ্গার। এ নদী ভারতের পশ্চিমবঙ্গ হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জের মধ্য দিয়ে। এরপর পদ্মা নামে বিস্তৃত হয়েছে ৩৬৬ কিলোমিটার পথ। দুই পাড়ের লাখো মানুষের জীবন-জীবিকার উৎস এ নদী। কিন্তু পদ্মার বর্তমান পরিস্থিতির কারণে জীবিকায় টান পড়েছে এ অঞ্চলবাসীর।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পদ্মা নদীর চেহারা পাল্টাতে শুরু করে ১৯৭৫ সালের পর। ওই বছর পদ্মার ১৮ কিলোমিটার উজানে ফারাক্কা বাঁধ চালু করে ভারত। এ বাঁধ দিয়েই ভাগীরথী ও হুগলি নদীতে পানি প্রত্যাহার শুরু করে প্রতিবেশী দেশটি। এর প্রভাবে পানি কমতে শুরু করে পদ্মায়।
গবেষকরা জানান, ফারাক্কা বাঁধ চালুর আগে ১৯৬৯ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত পদ্মায় প্রতি সেকেন্ডে পানি প্রবাহিত হতো ৯ হাজার ৩২ ঘনমিটার। বাঁধ চালুর পর থেকে অর্থাৎ ১৯৭৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রবাহ নেমেছে ৫ হাজার ১৪৬ ঘনমিটারে।
ফারাক্কা বাঁধ চালু হওয়ার পর শুকনো মৌসুমে পদ্মার প্রবাহ কমে দাঁড়িয়েছে প্রতি সেকেন্ডে ২ হাজার ৩৩ ঘনমিটারে। বাঁধ চালুর আগে শুকনো মৌসুমে পদ্মায় প্রবাহ ছিল ৩ হাজার ৬৮৫ ঘনমিটার। কেবল শুকনো মৌসুমেই নয়, বর্ষাকালেও প্রবাহ কমেছে পদ্মায়। ফারাক্কা চালুর আগে বর্ষায় গড় পানির প্রবাহ ছিল সেকেন্ডে ১২ হাজার ১১৫ ঘনমিটার। বর্তমানে এ প্রবাহ নেমে দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৮২৭ ঘনমিটারে।
পদ্মায় প্রবাহ কমে আসায় কমেছে পানির গভীরতা। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৫ সালের দিকে পদ্মার গড় গভীরতা ছিল ১২ দশমিক ৮ মিটার। ওই সময় প্রবাহ ছিল প্রতি সেকেন্ডে ৬ হাজার ৮ ঘনমিটার। ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে গড় গভীরতা নেমে আসে ১১ দশমিক ১ মিটারে। তখন প্রবাহ নেমে আসে ৪ হাজার ৫৮১ ঘনমিটারে।
গবেষকরা আরো জানান, ১৯৮০ সালে পদ্মা অববাহিকায় দৈনিক গড় বৃষ্টিপাত ছিল ৫ দশমিক ২ মিলিমিটার। ২০১৯ সালে এসে দৈনিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪ দশমিক ২ মিলিমিটারে। এদিকে ২০০৭ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সমীক্ষা চলাকালে দেশীয় ৭৭ প্রজাতির ১ লাখ ১ হাজার ৭৮১টি মাছের নমুনা নিয়ে পর্যবেক্ষণ করে গবেষক দল। এর মধ্যে ২০০৭ সালে ৪৩ হাজার ৬৮১, ২০১২ সালে ৩৫ হাজার ১৬২ ও ২০১৭ সালে ২২ হাজার ৯৩৮টি মাছ ছিল।
দেখা যায়, ওই ৭৭ প্রজাতির মাছের মধ্যে দেশে তিনটি প্রজাতির অবস্থা সংকটজনক বিপন্ন, ১০টি প্রজাতি বিপন্ন, নয়টি প্রজাতি অতিবিপন্ন এবং আরো নয়টি প্রজাতি বিপন্নপ্রায় অবস্থায় রয়েছে। এগুলোর মধ্যে বৈশ্বিকভাবে অতিবিপন্নের তালিকায় দুটি প্রজাতি ও আটটি প্রজাতি রয়েছে বিপন্নপ্রায় অবস্থায়। গবেষকরা জানিয়েছেন, পদ্মা থেকে হারিয়ে যাওয়া মৎস্য প্রজাতির ৬০ শতাংশই এখন বিলুপ্তির হুমকিতে রয়েছে। এদিকে ২০০৭ সালে পদ্মায় দশমিক ৪ শতাংশ বিদেশী প্রজাতির মাছ মিলত। ২০১৭ সালে এসে তা দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৪ শতাংশে। এই এক দশকে পদ্মায় বিদেশী মাছের প্রাচুর্য বেড়েছে ১১ দশমিক ৩ গুণ। এসব মাছের কারণে পদ্মায় দেশীয় মাছের প্রজনন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, দীর্ঘমেয়াদে যার প্রভাব পড়েছে। দেশীয় প্রজাতির মাছ বিলুপ্তির আরেকটি কারণ হিসেবে গবেষণায় বলা হয় অত্যধিক শিকার ও আবাস হারানো।
অপেক্ষাকৃত সহজ হওয়ায় প্রতি বছরই একটি বড় অংশের জনগোষ্ঠী যোগ হচ্ছে এ পেশায়। অনেকেই আবার নিষিদ্ধ ‘কারেন্ট’ জালে মাছ শিকার করছে। এতে নির্বিচারে শিকার হচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। এসব কারণে পদ্মার সার্বিক জীববৈচিত্র্যে এসেছে পরিবর্তন।
মাঠ পর্যায়ের কাজে গবেষক হিসেবে দলে ছিলেন মো. তাসকিন পারভেজ। তিনি বলেন, ‘পদ্মা নদীর আয়তন যেমন কমেছে, তেমনি গভীরতা ও পানিপ্রবাহও উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে, এটা অত্যন্ত শঙ্কার বিষয়। এর প্রভাবে জীববৈচিত্র্যে কী কী পরিবর্তন এসেছে, এসব বিষয় নিয়ে আগে কখনো গভীর অনুসন্ধান হয়নি। এ গবেষণার আলোকে কীভাবে পদ্মা নদীকে সুরক্ষিত করা যায়, সে বিষয়টি খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে।’ পদ্মার জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ফারাক্কার ভাটিতে পানি সংরক্ষণের পক্ষে মত দেন এ গবেষক।
গবেষকরা বলছেন, জলবায়ুর প্রভাব স্থানীয় মাত্রায় কাটিয়ে ওঠা কঠিন। তবে এর প্রভাব টেকসই পরিকল্পনার মাধ্যমে কমিয়ে আনা সম্ভব। তাছাড়া মাত্রাতিরিক্ত মাছ শিকার বন্ধের উদ্যোগ নিতে হবে। জেলেদের নিয়ন্ত্রণে লাইসেন্স ফি নির্ধারণ করে দেয়া উচিত। অধিকাংশ দেশীয় প্রজাতির মাছ বর্ষাকালে বংশবৃদ্ধি করে। এ সময়ে মাছ শিকার সীমিত করাসহ পদ্মায় মাছের অভয়াশ্রম গড়ে তোলারও তাগিদ দেন তারা।
পদ্মার রুগ্ন দশার বিষয়টি স্বীকার করেছেন নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পিন্টু কানুনগোয়। তিনি বলেন, ‘শুকনো মৌসুমে ছয় মাস পদ্মা প্রায় পানিশূন্য হয়ে পড়ে। এটি দৃশ্যমান। এর প্রধান কারণ ফারাক্কা বাঁধ। তবে আরেকটি বড় কারণ পদ্মা-গঙ্গা অববাহিকায় প্রবাহ কমেছে আগের তুলনায়। উজানের উপনদীগুলোয় বাঁধ নির্মাণ করে পানি উত্তোলন হচ্ছে। এতে ফারাক্কা পয়েন্টে পর্যাপ্ত পানি আর আসছে না। ফলে চুক্তি অনুযায়ী পানি পাচ্ছে না বাংলাদেশ।’
ধারাবাহিকভাবে পরিস্থিতি আরো জটিল হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এ সংকটের শেকড় অনেক গভীরে। পদ্মার এ রুগ্ন দশার কারণ কী, এটি সবাই বোঝে। সংকট মোকাবেলায় অববাহিকাভিত্তিক বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালকে সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা নিতে হবে। আমরা বরাবর এটিই বলে আসছি। এখন প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারকে রাজনৈতিকভাবে বিষয়টি সমাধান করতে হবে।’