সিলেটে জঙ্গি সংগঠন ‘শারক্বীয়া’র দাওয়াতি শাখার প্রধানসহ ৪ জন গ্রেফতার
প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ মে ২০২৩, ৮:১৫:০৪ অপরাহ্ন
প্রবাসীরা বুঝে না বুঝে জঙ্গি সংগঠনে অর্থায়ন করছেন : র্যাব
স্টাফ রিপোর্টার : নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার দাওয়াতি শাখার প্রধান ও শুরা সদস্য আবদুল্লাহ মায়মুন ওরফের মুমিনসহ চারজনকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। মঙ্গলবার সকালে সিলেট সদর উপজেলার বিমানবন্দর বড়শালা এলাকার একটি বাড়ি থেকে এই চারজনকে গ্রেফতার করা হয় বলে জানিয়েছে র্যাব। দুপুর ১২টার দিকে র্যাব-৯ সিলেটের সদর দপ্তরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান সংস্থাটির আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, গ্রেফতারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ওই চার ব্যক্তি র্যাবকে জানিয়েছেন, তারা সংগঠনের আমিরের নির্দেশে আত্মগোপনে ছিলেন। এর মধ্যে আবদুল্লাহ মায়মুন সিলেটে অবস্থান করে জঙ্গিদের সংগঠিত করার চেষ্টা করছিলেন। তারা সবাই পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত।
গ্রেফতার ব্যক্তিরা হলেন- সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার হাফিজ মাওলানা মাহমুদ হোসাইনের ছেলে আবদুল্লাহ মায়মুন (৩৪), ফরিদপুরের চরভদ্রসেনের শেখ আব্দুস ছালাম মাষ্টারের ছেলে মো. আবু জাফর ওরফে জাফর ওরফে তাহান (৪০), চাঁদপুর মতলব উত্তরের মৃত: মোস্তফা কাজী’র ছেলে মো. আক্তার কাজী ওরফে সাইদ ওরফে আইজল (৩৮) ও গোপালগঞ্জ জেলার মুকসেদপুরের মৃত আব্দুর রাজ্জাক মোল্লার ছেলে সালাউদ্দিন রাজ্জাক মোল্লা (৩২)।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, অভিযানের সময় গ্রেফতার ব্যক্তিদের কাছ কাছ থেকে নগদ ২ লাখ টাকা, ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস ও গুরুত্বপূর্ণ নথি জব্দ করেছে র্যাব। আবদুল্লাহ মায়মুনসহ ওই চার ব্যক্তি তাদের পরিচয় গোপন করে সিলেটের বড়শালা এলাকার একটি বাসায় ছয় থেকে সাত দিন ধরে অবস্থান করছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে খন্দকার আল মঈন বলেন, জঙ্গি সংগঠনে বিদেশ থেকে কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হচ্ছে। প্রবাসীদের অনেকে জেনে শুনে টাকা পাঠাচ্ছেন। কেউবা না জেনে অর্থায়ন করেছেন। প্রতি ৪-৫ মাস পর পর ২০ লাখ টাকা করে এই সংগঠনে এসেছে। এই অর্থ আমীরের নির্দেশে বিভিন্নভাবে তারা মসজিদ, মাদরাসার কথা বলে সংগ্রহ করতেন। সেসব অর্থের যোগানদাতা কিছু ব্যক্তির নাম পেয়েছে র্যাব। যাদের নিয়ে কাজ করা হচ্ছে।
আবদুল্লাহ মায়মুন সম্পর্কে খন্দকার আল মঈন আরো বলেন, আবদুল্লাহ মায়মুন আনসার আল ইসলামের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি সংগঠনটির সিলেট বিভাগীয় মসূল বা প্রধানের দায়িত্বে ছিলেন। সংগঠনটির শীর্ষ নেতা চাকরিচ্যুত মেজর জিয়ার সঙ্গে আবদুল্লাহ মায়মুনের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। এমনকি জিয়া নিয়মিত আবদুল্লাহ মায়মুনের বাসায় যাতায়াত করতেন। ২০১৯ সালে মায়মুন বগুড়ায় সন্ত্রাসবিরোধী একটি মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারাভোগও করেন। পরে ২০২০ সালের শেষের দিকে জামিনে মুক্তি পেয়েছিলেন। পরে জামিন বাতিল হলেও আবদুল্লাহ মায়মুন আত্মগোপনে চলে যান। মূলত আবদুল্লাহ মায়মুন জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সঙ্গে নতুন সংগঠনটির যোগাযোগ করিয়ে সেতুবন্ধন করে দিয়েছিলেন। আবদুল্লাহ মায়মুনের মাধ্যমেই নতুন সংগঠনকে ১৫ লাখ টাকা অনুদান দেয় আনসার আল ইসলাম।
তিনি আরো বলেন, ঢাকার আদালত প্রাঙ্গণ থেকে যে জঙ্গিরা পালিয়ে গিয়েছিলেন, তাদের সঙ্গে মায়মুনের ভালো সম্পর্ক ছিল। বিষয়টি গোয়েন্দা বিভাগ খতিয়ে দেখছে। সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন র্যাব-৯ সিলেটের অধিনায়ক উইং কমান্ডার মো. মোমিনুল হক।
প্রশিক্ষণ ও অর্থ জোগান : নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার আমির হলেন আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদ। তার সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র গোষ্ঠী কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) প্রধান নাথাম বমের সুসম্পর্ক ছিল। এর সূত্র ধরে তাদের মধ্যে অর্থ বিনিময়ের চুক্তি হয়। চুক্তির অংশ হিসেবে শারক্বীয়ার জঙ্গিদের পাহাড়ে আশ্রয়, অস্ত্র-রসদ সরবরাহ ও সশস্ত্র প্রশিক্ষণ প্রদান করতো কেএনএফ। সংগঠনটির সদস্যদের প্রশিক্ষণ এবং থাকার ব্যবস্থা করার জন্য কেএনএফকে মাসে ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা দিতো সংগঠনটি। সংগঠনটি ২০২১ সালে প্রশিক্ষণ শুরু করেছিল। এর আগে ২০১৮ থেকে ২০১৯ সাল থেকে তারা সদস্য সংগ্রহ করছিল। গ্রেফতার হওয়া দাওয়াতি শাখার প্রধান আবদুল্লাহ মায়মুন প্রবাসে থাকা বিভিন্ন ব্যক্তি, অন্যান্য সংগঠন এবং নিজ অর্থায়নে সংগঠনের জন্য প্রাথমিকভাবে ৫০ লাখ টাকা সংগ্রহ করেছে বলে প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছে র্যাব।
ভিডিও তৈরির প্রস্তুতি : নতুন জঙ্গি সংগঠনটি নিজেদের অবস্থান জানান দিতে বিভিন্নভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তবে এরই মধ্যে গোয়েন্দা খবরের ভিত্তিতে র্যাবের অভিযানের খবর পেয়ে সংগঠনের সদস্যরা সতর্ক হয়ে পড়েছিলেন। তাদের অবস্থান জানান দিতে তারা ভিডিও তৈরিসহ বিভিন্ন প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তবে অভিযানের কারণে তারা সেটি সম্পন্ন করতে পারেননি। র্যাবের নিয়মিত অভিযানের ফলে সংগঠনটির আমিরের নির্দেশে জঙ্গিরা পাহাড় থেকে পালিয়ে সমতলের বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপনে গিয়ে পুনরায় সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছিলেন।
অর্থের জোগানদাতাদের তালিকা হচ্ছে : র্যাব জানায়, জঙ্গি সংগঠনে অর্থের জোগানদাতাদের মধ্যে অনেকে বুঝে শুনে অর্থ দিয়েছেন। আবার অনেকে না বুঝে বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গঠনসহ নানা কাজের কথা শুনে আবদুল্লাহ মায়মুনের কাছে অর্থসহায়তা দিয়েছেন। দেশ-বিদেশ থেকে আবদুল্লাহ মায়মুন এসব অর্থ সংগ্রহ করতেন। এর মধ্যে মায়মুনের আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধবসহ অনেকেই আছেন।
এ বিষয়ে খন্দকার আল মঈন বলেন, অর্থ জোগানদাতাদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। তাদের ব্যাপারে বিস্তারিত খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। যারা বুঝে শুনে অর্থের জোগান দিয়েছেন, তাদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গ্রেফতার চারজনের পরিচয় : আবদুল্লাহ মায়মুনের পরিবারের সদস্যরা সবাই যুক্তরাজ্যে আছেন। তার স্ত্রী ও সন্তানও সেখানে থাকেন। তবে আবদুল্লাহ মায়মুন কখনো যুক্তরাজ্যে জাননি বলে জানিয়েছে র্যাব। আবদুল্লাহ মায়মুন সিলেটের স্থানীয় একটি মাদ্রাসা থেকে দাখিল সম্পন্ন করেন। পরে তিনি অনলাইনে ফিলিস্তিন, মিয়ানমার, ইরাকসহ বিভিন্ন স্থানে মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের ভিডিও দেখে উগ্রবাদে আকৃষ্ট হন। ২০১৩ সালে স্থানীয় এক ব্যক্তির মাধ্যমে আনসার আল ইসলামে যোগ দেন। পরে তিনি সংগঠনটির সিলেট বিভাগীয় প্রধান ছিলেন। ২০১৯ সালে কারাগারে যাওয়ার পর ২০২০ সালে জামিনে মুক্তি পেয়ে আত্মগোপনে চলে গিয়েছিলেন। ২০২১ সালে শুরা সদস্য রণবীর ও মানিকের মাধ্যমে শারক্বীয়ায় যোগ দিয়ে পাহাড়ে চলে যান। আনসার আল ইসলামের বিভাগীয় প্রধান হওয়ায় নতুন সংগঠনে শুরা সদস্য ও দাওয়াতি শাখার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পান।
আবু জাফর ২০০১ সালে সুন্দরবনে হুজির সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নেওয়া অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি জেএমবিতে যোগ দিয়েছিলেন। জেএমবিতে থাকাকালীন ২০০৫ সালে পুনরায় গ্রেফতার হয়েছিলেন। পরে কারাগার থেকে বেরিয়ে ২০১৮ সালে আবু জাফর মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে চলে গিয়েছিলেন। সেখানে থাকা অবস্থায় আবু জাফর শারক্বীয়ায় যোগ দেন। দেশে ফিরে তিনি নতুন সংগঠনের ১২ জনের দলনেতা হিসেবে পাহাড়ে প্রশিক্ষণের জন্য তথাকথিত হিজরত করেন। পাহাড়ে বিভিন্ন অস্ত্র চালানোসহ বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তবে আবু জাফরের পরিবারের সদস্যরা জানতেন তিনি মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থান করছেন। আবু জাফরের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী একাধিক মামলা আছে।
আক্তার কাজীর বিরুদ্ধে ২০০৪ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ছিনতাই ডাকাতিসহ ৮ থেকে ১০টি মামলা আছে। তাকে চাঁদপুর, সিলেট, নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা একাধিকবার গ্রেফতার করেছে। ২০১৭ সালে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে আক্তার কাজী আনসার আল ইসলামে যোগ দেন। পরবর্তী সময়ে শারক্বীয়ায় যোগ দিয়ে তিনি পাহাড়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।
সালাউদ্দিন রাজ্জাক শারক্বীয়ার অন্যতম সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। ২০১৮ সালে তিনি সংগঠনটিতে যোগ দেন। ঢাকার মিরপুরে থাকাকালীন বিভিন্ন সময় তার বাসায় সংগঠনের আমির ও শুরা সদস্যরা বৈঠক করতেন।