গ্রামীণ সড়কের দুরবস্থা : সংসদীয় কমিটিতে প্রশ্ন
প্রকাশিত হয়েছে : ১০ মে ২০২৩, ২:৪৫:৪৫ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট: দারিদ্র্যের হার কমানো, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, শিক্ষাসহ সামাজিক নানা সূচকে বাংলাদেশ যে সাফল্য দেখিয়েছে, তাতে গ্রামীণ সড়কের (অবকাঠামো) উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। বাংলাদেশে গত কয়েক দশকে তিন লাখ কিলোমিটারেরও বেশী পল্লি সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। যেসব এলাকায় এসব সড়ক হয়েছে, সেখানে দারিদ্র্য অন্য এলাকার তুলনায় উল্লেখযোগ্যহারে কমেছে। এই গ্রামীণ অধিকাংশ সড়কের এখন দুরবস্থা। মাসের পর মাস গেলেও এগুলো সংস্কার হয়নি, আবার সংস্কার হলেও মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এ নিয়ে সংসদ সদস্যের মধ্যেও ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সংসদীয় কমিটির দুটি বৈঠকে।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির দুটি বৈঠকে গ্রামীণ রাস্তার মান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন সরকারি ও বিরোধী দলের চারজন সংসদ সদস্য। এর মধ্যে একজন বলেছেন, বেহাল রাস্তার কারণে সংসদ সদস্যদের কটূক্তি শুনতে হচ্ছে।
সামনে বর্ষা। এরপর জাতীয় নির্বাচন। বৃষ্টিতে ভাঙাচোরা রাস্তার অবস্থা আরও খারাপ হবে। এর আগেই রাস্তাঘাট সংস্কার করার জন্য সংসদীয় কমিটির বৈঠকে মন্ত্রণালয়কে পরামর্শ দেন সংসদ সদস্যরা।
দেশের সবচেয়ে বড় সড়ক নেটওয়ার্ক স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি)। উপজেলা, ইউনিয়ন ও গ্রামীণ সড়ক- এ তিন ক্যাটাগরিতে সংস্থাটির পাকা সড়কের পরিমাণ এক লাখ ১৭ হাজার কিলোমিটার। এর বড় একটি অংশই বেহাল।
বিশেষজ্ঞরাও এলজিইডির সড়কের বেহাল দশার কিছু কারণ চিহ্নিত করেছেন। এসবের মধ্যে রয়েছে- বন্যা, নিম্নমানের কাজ ও নির্মাণ উপকরণ, অনিয়ম-দুর্নীতি, অদক্ষ ঠিকাদার, রক্ষণাবেক্ষণের অভাব, নকশার ত্রুটি ও অপ্রতুল বরাদ্দ।
দেশের সব উপজেলা সড়ক এবং ইউনিয়ন সড়কের দায়িত্ব স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডির)। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সূত্র জানায়, গত ৩০ জানুয়ারি ও ৩০ মার্চ অনুষ্ঠিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে এলজিইডির সড়ক নিয়ে আলোচনা হয়। গত ৩ মে অনুষ্ঠিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে ৩০ মার্চের বৈঠকের কার্যবিবরণী অনুমোদন করা হয়।
সংসদীয় কমিটির সূত্র জানায়, এলজিইডি সংসদীয় কমিটিকে জানায়, গ্রামীণ রাস্তা মেরামতের জন্য যে চাহিদা, তাতে ৯ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন। পাওয়া গেছে ৪ হাজার কোটি টাকার মতো। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রথমে উপজেলা সড়ক এবং পরবর্তী সময়ে গ্রামীণ গুরুত্বপূর্ণ সড়ক মেরামতের কার্যাদেশ দেওয়া হয়। এসব কাজের ৭৫ শতাংশ বাস্তবায়নের পর নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়ার কারণে কাজের গতি মন্থর হয়। তবে এখন কাজ চলছে।
বন্যায় সিলেট ও সুনামগঞ্জের ১১ হাজার ৬৭০ কিলোমিটার রাস্তাও একেবারে তছনছ হয়ে যায়। অনেক স্থানে রাস্তা কেটে দেওয়া হয়েছে। কোথাও কোথাও রাস্তার লেশমাত্র নেই। পানির তোড়ে ছোট, দুর্বল ও পুরোনো কালভার্ট-ব্রিজ উপড়ে গেছে। অনেক স্থানে পানির নিচ থেকে বেরিয়ে আসে এবড়োখেবড়ো রাস্তা। কিন্তু এসবের অর্ধেকেরই সংস্কার শুরু হয়নি বলে জানা গেছে সংশ্লিষ্ট সূত্রে।
এলজিইডির প্রকৌশলী, সড়ক বিশেষজ্ঞ ও স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় অনেক অগুরুত্বপূর্ণ সড়কে রক্ষণাবেক্ষণ কাজ করা হয়। কিন্তু জরুরি হলেও অনেক সড়ক সংস্কারে বরাদ্দ দেওয়া হয় না। আবার সড়কে কাজের মান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। সাধারণত সড়ক নির্মাণের পাঁচ বছরের মধ্যে সংস্কার করা হয় না। কিন্তু দেখা যায় নির্মাণের পর বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সড়ক ভাঙতে শুরু করে। দু-তিন বছরের মধ্যেই সড়ক বেহাল হয়ে যায়। এক্ষেত্রে হাওর এলাকায় বন্যা একটি বড় কারণ।
গ্রাম ও উপজেলা পর্যায়ের এই সড়কগুলো স্থানীয় মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, ভালো যোগাযোগব্যবস্থা সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য জরুরি।
সরকারের জাতীয় সড়কব্যবস্থার শ্রেণিবিন্যাস অনুযায়ী, দেশের সব উপজেলা সড়ক এবং ইউনিয়ন সড়কের একক দায়িত্ব এলজিইডির। গ্রামীণ সড়কের উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও এলজিইডির। বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বিস্তৃত সড়ক নেটওয়ার্ক রয়েছে সংস্থাটির আওতায়, মোট ৩ লাখ ৩০ হাজার ৮৩১ কিলোমিটার। এর মধ্যে ৪৫ শতাংশ পাকা, ৫৫ শতাংশ কাঁচা।
এলজিইডির ৫০ শতাংশ সড়ক সব সময় ভালো থাকে, ২৫ শতাংশের মোটামুটি মেরামত প্রয়োজন। আর ২৫ শতাংশ ব্যবহারের অনুপযোগী থাকে। ব্যবহারের অনুপযোগী এসব সড়কের প্রায় সবটাই গ্রামের। প্রতিবছর অনেক সড়ক অগ্রাধিকার ভিত্তিতে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। বিপরীতে কাঁচা রাস্তাগুলোতে বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব হয় না। ফলে বছরের পর বছর এই সড়কগুলো ভাঙাচোরা থাকে। আবার অনেক ক্ষেত্রে বরাদ্দ দেওয়া হলেও অন্য গাফিলতিতে কাজ হয় না।