সিলেটে হিটস্ট্রোক আতঙ্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ১১ মে ২০২৩, ১০:০০:৫৪ অপরাহ্ন
সুনামগঞ্জে ৪ জনের মৃত্যু
মুনশী ইকবাল : সুনামগঞ্জে বুধবার ‘হিটস্ট্রোকে’ ৪ জনের মৃত্যু হয়। তারা সকলেই মাঠে কাজ করছিলেন। যদিও সুনামগঞ্জের ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. শোকদেব সাহা বলেন, হিটস্ট্রোকে ৪ জনের মৃত্যুর কোনো রেকর্ড নেই। এজন্য চারজনের মৃত্যু হিট স্ট্রোকে হয়েছে সেটা বলা যাবে না।
ছাতকের কৈতক ২০ শয্যা হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, বুধবার দুপুরে ছাতকের জাউয়া বাজার ইউনিয়নের সাদারাই গ্রামের মৃত শামসুল হকের পুত্র মঞ্জুর আহমদ (৪০) হাওরে ধান কাটার অবস্থায় প্রচন্ড গরমে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসলে কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন। একইভাবে ছাতকের সিংচাপইড় ইউনিয়নের সিংচাপইড় গ্রামে তেরাব আলী পুত্র হাসনাত মিয়া (৪৫) েেত কাজ করে বাড়িতে এসে প্রচন্ড গরমে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। হাসপাতালে নিয়ে আসলে কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
অপরদিকে দোয়ারাবাজার উপজেলার পান্ডার গাঁও ইউনিয়নের জলসি গ্রামের তাজির উদ্দিন (৬৫) হাওরে েেতর কাজ করছিলেন। হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়লে তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। হাসপাতালে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
অপরদিকে শান্তিগঞ্জ উপজেলার দরগাপাশা ইউনিয়নের দরগাপাশা গ্রামের নূর আলমের স্ত্রী রাফিয়া বেগম (৬০) ধান শুকানোর কাজে ব্যস্ত ছিলেন। তিনি হঠাৎ করে অজ্ঞান হয়ে পড়লে তাকে হাসপাতালে আনা হয়। হাসপাতালেই মৃত্যু হয়।
এতে সিলেটে হিটস্ট্রোক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। বুধবার সুনামগঞ্জের ‘হিটস্ট্রোকে’ নারীসহ ৪ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর থেকেই এই আতঙ্ক বেশি ছড়ায়। বিশেষ করে যারা বাইরে রোদে কাজ করেন তারা এবং শ্রমজীবীদের মধ্যে আতঙ্ক বেশি বিরাজ করছে। কারণ সুনামগঞ্জে মারা যাওয়া সকলেই মাঠে কাজ করছিলেন। মৃত্যুবরণকারী ৪ জনের মধ্যে মঞ্জুর আহমদ ও হাসনাত মিয়ার বাড়ি ছাতকে এবং অপর দুজনের মধ্যে তাজির উদ্দিনের বাড়ি দোয়ারাবাজারে ও রাফিয়া বেগমের বাড়ি শান্তিগঞ্জে। এরমধ্যে পুরুষ তিনজন মাঠেই অজ্ঞান হয়ে মারা যান আর শান্তিগঞ্জের নারীকে অজ্ঞান হওয়ার পর হাসপাতালে নিলে সেখানে তার মৃত্যু হয়।
জলবায়ুবিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালের গরম রীতিমতো আপদ (হ্যাজার্ড) থেকে দুর্যোগে রূপ নিচ্ছে। তারা বলছেন, অতি উষ্ণ তাপের মধ্যে কেউ যদি টানা ছয় ঘণ্টা থাকেন, তাহলে তাঁর শরীরের ভেতরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যেমন কিডনি, ফুসফুস ও যকৃতের দীর্ঘমেয়াদি তি হতে পারে। এমনকি হিটস্ট্রোকে মৃত্যুর ঝুঁকিও রয়েছে। তাদের এই আশঙ্কার সত্যতা অনেকটাই সুনামগঞ্জে বুধবার দেখা মিললো।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন শরীরের তাপমাত্রা অস্বাভাবিক বেড়ে গেলে হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। মানবদেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৯৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট। এটি বাড়তে বাড়তে ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট পেরিয়ে গেলেই হিটস্ট্রোক হতে পারে। এটি একটি মেডিকেল ইমার্জেন্সি। দ্রুত চিকিৎসা না দিলে রোগীর মৃত্যুর আশঙ্কা রয়েছে।
হিটস্ট্রোকের প্রধান কারণ পানিশূন্যতা। এর লণগুলো হলো-মাথা ঝিমঝিম করা, বমি, অবসাদ ও দুর্বলতা, মাথাব্যথা, মাংসপেশির খিঁচুনি, চোখে ঝাপসা দেখা ইত্যাদি। হিটস্ট্রোকের রোগীর ত্বকে ঘাম থাকে না, ত্বক খসখসে, শুষ্ক ও লাল দেখায়, পাশাপাশি হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়। শ্বাসকষ্টও হতে পারে। ছোটো শিশু, বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তি, দিনমজুরদের হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি।
তাই হিটস্ট্রোক থেকে বাঁচতে তাদের পরামর্শ হলো-পানিশূন্যতা যেন না হয়, সেদিকে ল রাখতে হবে, গরমে ও রোদে প্রচুর পরিমাণ পানি, ডাবের পানি, স্যালাইন খেতে হবে। বিদ্যালয়ে বা খেলার মাঠে শিশুদের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। দুপুরের প্রচণ্ড রোদে ভারী কাজ বা শারীরিক ব্যায়াম করা যাবে না। বাইরে বেরোলে সাদা বা হালকা রঙের কাপড় পরতে হবে এবং ছাতা ব্যবহার করতে হবে।
এদিকে গত কয়েকদিন থেকেই সারাদেশের মতো সিলেটে তীব্র তাপদাহ বয়ে যাচ্ছে। এতে ঘরে বাইরে সবারই নাভিশ^াস উঠছে। যদিও দু’দিন থেকে বিকেলে সিলেটে ঝড়ো হাওয়া এবং সন্ধ্যায় কিছু বৃষ্টিপাত হয়েছে তবে এতে গরম তেমন কমেনি। অনেকেই মনে করেছিলেন এবার হয়তো কিছুটা পরিত্রাণ মিলবে কিন্তু তা আর হয়নি। বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই তেতে ছিল রোদ। বিকেলের দিকে রোদের তেজ কমে আকাশ মেঘলা হলেও গরম কমেনি। আবহাওয়া অফিসের তথ্য অনুযায়ী সিলেটে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৫ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যদিও বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসে গরমের অনুভূতি মাত্রা ছিল ৪৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং তাপমাত্রা ছিল ৩৮ এর কোটায়।
মূলত সাগরে বিরাজমান ঘূর্ণিঝড়ের কারণে এই তীব্র গরম বলে আবহাওয়া অধিদপ্তর সূত্রে জানাগেছে। যা আরও দীর্ঘায়িত হতে পারে বলে তারা ধারণা করছেন। এরবাইরে গরম বাড়ার অন্য কারণ হিসেবে আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে এপ্রিল ও মে মাস দেশের উষ্ণ মাস। গত এপ্রিল মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টি হয়েছে। এ দুই মাসের বৈশিষ্ট্যের কারণেই এখন গরম বেশি। বৃষ্টি কম হওয়ায় গরম কম হয়েছে।
গরমের কারণে রাস্তাঘাটে দিনের বেলা মানুষ ছিলেন কম। অনেক অভিভাবক বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাননি। এসএসসি পরীক্ষা দিতে আসা পরীক্ষার্থীদের অপেক্ষমান অভিভাবকদের বিভিন্ন কেন্দ্রের বাইরে ঘেমে জবুথুবু হতে দেখা গেছে। আবহাওয়া ছিল গোমট, কোনো বাতাস ছিল না, যারা বাইরে বের হয়েছিলেন তাদের দুর্ভোগের সীমা ছিল না।
নগরীর দাড়িয়াপাড়ায় রসময় স্কুলের সামনে কথা হয় এক এসএসসি পরীক্ষার্থীর অভিভাবকের সাথে। তিনি বলেন পরীক্ষা না থাকলে এই গরমে কোনো অবস্থায়ই বের হতাম না। বাচ্চাকে নিয়ে বের হওয়ার তো প্রশ্নই আসেনা। তিনি বলেন এত গরম আগে দেখিনি। এরমধ্যে সন্ধ্যা থেকে বিদ্যুৎ থাকে না। তাই গরম আর কারেন্ট মিলে খুব কষ্ট হচ্ছে। বাচ্চারা পরীক্ষা দিতে খুব দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। এই্ অভিভাবক আক্ষেপ করে বলেন, এত যে গরম দিন দিন বাড়ছে কিন্তু এনিয়ে কারো কোনো চিন্তাই চোখে পড়ছে না। আগে এই শহরে চতুর্দিকে পুকুর দিঘি ছিল, অনেক গাছপালা ছিল এখন কিছুই নেই। কেউ গাছ লাগায় না, যা আছে তাও লোকজন কেটে ফেলার অজুহাত খুঁজে। এসময় তিনি পাশেই কোণায় একটা বাসা দেখিয়ে বলেন সকালে দেখলাম বিশাল আমগাছ ওরা কেটে ফেলছে। বিশাল দালান তারপরও গাছ কেটে ঘর করার জন্য মানুষকে আরও ঘর করতে হবে। গরম তো আমরাই ডেকে আনছি।
নগরীর ক্বীনব্রিজ এলাকায় কথা হয় এক রিকশাচালকে সাথে। ব্রিজের নিচে ছায়ায় বিশ্রাম নিচ্ছিলেন তিনি। বাড়ি সুনামগঞ্জের তাহিরপুর। তিনি বলেন গরমে অবস্থা কাহিল। লোকজন অজ্ঞান হয়ে মারা যাচ্ছে শুনেছি। গরমে বেশিক্ষণ রিকশাচলাতে পারি না। এতে রুজি কমছে আবার একটু চালালে কাহিল হয়ে যাচ্ছি।
ঘূণিঝড়ের ব্যাপারে বৃহস্পতিবার আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, সকাল ৬টায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ১২৯৫ কি.মি. দণি- দণিপশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ১২২০ কিলোমিটার দণি-দণিপশ্চিমে, মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ১২৬৫ কিলোমিটার দণি-দণিপশ্চিমে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ১২২৫ কিলোমিটার দণি-দণিপশ্চিমে অবস্থান করছিল ঘূর্ণিঝড়টি। এটি আরও ঘণীভূত হয়ে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত উত্তর-উত্তরপশ্চিম দিকে এবং পরবর্তীতে দিক পরিবর্তন করে ক্রমান্বয়ে উত্তর-উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর হতে পারে।
আবহাওয়া অফিস জানায়, ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৫৪ কিলোমিটার এর মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২ কিলোমিটার। যা দমকা অথবা ঝোড়ো হাওয়ার আকারে ৮৮ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে।