নাগালের বাইরে বেকারী পণ্য
প্রকাশিত হয়েছে : ১৩ মে ২০২৩, ৩:০০:২২ অপরাহ্ন
২ বছরে দাম বেড়েছে দ্বিগুণ
এমজেএইচ জামিল :
চিনি-ভোজ্যতেল সহ নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে সিলেটে বাড়ছে বেকারি পণ্যের দাম। একদিকে পরিমাণ কমে পণ্যের প্যাকেট সাইজ ছোট হচ্ছে অপরদিকে দাম বেড়েছে কয়েক গুণ। ফলে মধ্য ও নিম্নবিত্তের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে অধিকাংশ বেকারী পণ্য।
এক বছরের ব্যবধানে ব্রেড, বিস্কুট, কেক সহ সকল প্রকার কনফেকশনারি পণ্যের দাম বেড়েছে দুই গুণ। সম্প্রতি ফের চিনির দাম বাড়ায় আবারো বেকারীপণ্যের দাম বৃদ্ধির শঙ্কায় ক্রেতা সাধারণ। এদিকে চিনি, ভোজ্যতেল, ময়দা, আটাসহ বেকারী পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিপাকে পড়েছেন খোদ বেকারী মালিকগণ। প্রতিটি পণ্যের দাম কয়েকগুণ বাড়লেও সেই হারে বাড়েনি বেকারী পণ্যের দাম। প্রস্তুতখরচ ও প্রস্তুতকৃত পণ্যমূল্যের সমন্বয় করতে গিয়ে সিলেটের ছোটখাটো বেকারীগুলো বন্ধ হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এভাবে গ্যাস, বিদ্যুৎ, ভ্যাট-ট্যাক্স ও নিত্যপণ্যের দাম বাড়তে থাকলে সিলেটের আরো বেকারী প্রতিষ্ঠান বন্ধ হতে পারে বলে মন্তব্য তাদের।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাজারে বর্তমানে ১০ টাকার নিচে ছোট এক প্যাকেট কেকও মিলছেনা। আর বাজারে ২০ টাকার নিচে নেই ব্রেডের প্যাকেট। ১ বছর আগে ১০ টাকা দামের ব্রেডের প্যাকেট এখন বিক্রি হচ্ছে ২০ টাকা। দাম দ্বিগুণ বাড়লেও কমানো হয়েছে পণ্যের পরিমাণ। বাজারে এখন ৫ টাকা দামের বনরুটির দেখা নেই। ১০ টাকা দামের বনরুটি পাওয়া গেলেও সেটা কোম্পানীভেদে হয় ২ না হয় ৪ পিসের প্যাকেট। ফলে অনেকেই ক্রয় করতে পারেন না।
শুক্রবার নগরীর বিভিন্ন কনফেকশনারী দোকানে গিয়ে দেখা যায়, এক বছর আগের ১০ টাকা মূল্যের ব্রেড বিক্রি হচ্ছে ২৫ টাকা, ২০ টাকার ব্রেড ৩৫ টাকা, ৩০ টাকার ব্রেড ৫০ টাকা। ৫০ টাকার ব্রেড ৮০ টাকা, ৬০ টাকার ব্রেড ১০০ টাকা। তবে কোম্পানীর নামভেদে ব্রেডের দামেরও ভিন্নতা রয়েছে।
এদিকে সিলেটে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ব্রেড এন্ড বিস্কুট ফ্যাক্টরীর সঠিক তথ্য কোন সরকারী দফতরে নেই। বিএসটিআই, ভোক্তা অধিকার, বিসিক কেউই জানেনা তাদের পণ্যের দাম নির্ধারণ সম্পর্কে। বিভিন্ন কারখানা ও ফ্যাক্টরীর মালিকরা নিজেরা বসে একটা মূল্য নির্ধারণ করে দেন। সেই অনুযায়ী বিক্রি হয় ব্রেড ও বিস্কুট জাতীয় পণ্য। মূল্য তালিকা কোন সরকারী দফতরে দিতে হয়না জমা। ফলে পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হচ্ছে।
এদিকে বেকারী মালিকরা জানিয়েছেন, নিত্যপণ্যের দামবৃদ্ধির কারণে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে যাওয়ায় উৎপাদনও কমানো হয়েছে। এরপরও উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করা যাচ্ছেনা। এছাড়া নিত্যপণ্যের পাশাপাশি এর সাথে সংশ্লিষ্ট শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন বাড়ানো হয়েছে। গ্যাস-বিদ্যুতের সাথে অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে ভ্যাট-ট্যাক্স। ফলে এই খাতে সংশ্লিষ্ট শিল্প মালিকগণ অনেকটা বেকায়দায় পড়েছেন। বেকারী পণ্যের ব্যবসায় জড়িত অনেকে ব্যবসা বদলের চেষ্টায় আছেন। কেউ কেউ এই ব্যবসা ছেড়ে দেয়ার পরিকল্পনা করছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২১ সালের ২০ ফেব্রুয়ারী থেকে বাংলাদেশ ব্রেড, বিস্কুট ও কনফেকশনারী প্রস্তুতকারক সমিতি সিলেট জেলার এক সভায় বৈশ্বিক মহামারি করোনা পরিস্থিতি ও বেকারী উপকরণের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বেকারীর সব ধরনের পণ্যের দাম বৃদ্ধি করা হয়। বেকারীর প্রতিটি পণ্য তেল, ময়দা, চিনির দাম অধিক হওয়ায় তখন বেকারীর প্রতিটি পণ্যে শতকরা ২০ ভাগ দাম বৃদ্ধি করা হয়। কিন্তু ২০২২ সালের মে মাসে ভোজ্যতেল সহ নিত্যপণ্যের আরেকদফা দাম বাড়ায় ফের বাড়ানো হয় বেকারী পণ্যের দাম। এরপর থেকে দফায় দফায় ভোজ্যতেল, চিনি ও ময়দাসহ নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার সাথে বাড়তে থাকে বেকারী পণ্যের দাম। বেকারী মালিকগণ নিজেরা বসেই পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে থাকেন। দাম বাড়ানোর হলেও সব পণ্যের পরিমাণ কমানো হয়েছে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ। কিছুক্ষেত্রে দুইগুণ দাম বাড়ানোর পর পণ্যের পরিমাণ অর্ধেকে নেমে এসেছে।
নগরীর কয়েকটি ব্রেড বিস্কুটের দোকানে গিয়ে দেখা গেছে, সিলেটের বাজারে অভিজাত মিষ্টান্ন কোম্পানী ও স্থানীয় বেকারী পণ্য এই দুই ধরনের বেকারী পণ্য রয়েছে। দুই ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলো নিত্যপণ্যের সাথে সমন্বয় করে ব্রেড, বিস্কুট, মিষ্টি ও মিষ্টিজাত পণ্যের দাম বাড়িয়েছে। সিলেটের অভিজাত মিষ্টান্ন কোম্পানীগুলোর মধ্যে বনফুল, মধুবন, স্বাদ, ফিজা, ফুলকলি, পিউরিয়া, মি: সুইট, মধুফুল সহ কয়েকটি কোম্পানী বাজারে বেকারী পণ্য সরবরাহ করছে। স্থানীয় বেকারীগুলোর মধ্যে মৌমিতা, সানবেস্ট, মধুমিতা, বসুন্ধরা, এশিয়া, রিশতাসহ কয়েকটি কোম্পানী বাজারে বেকারী পণ্য সরবরাহ করছে।
এ ব্যাপারে স্বাদ কোং এর ব্যাবস্থাপনা পরিচালক নুরুল আলম দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, করোনাকাল থেকে সবধরনের নিত্যপণ্যের যে অস্বাভাবিক উর্ধ্বগতি শুরু হয়েছিল তা এখনো অব্যাহত রয়েছে। বৃহস্পতিবার থেকে ফের চিনির দাম বাড়ছে। বেকারী ও মিষ্টিজাত পণ্য তৈরীর প্রধান উপকরণ হচ্ছে তেল, ডালডা, চিনি, ময়দা। কিন্তু প্রতিটি পণ্যই বাড়ছে। সেই হারে বেকারী পণ্যের দাম বাড়ানো যাচ্ছেনা।
তিনি বলেন, এক থেকে দেড় বছর আগের ১৭০০ টাকা দামের চিনির বস্তা এখন ৬ হাজার টাকার বেশী। ৭০-৮০ টাকা দামের সয়াবিন তেল প্রায় ২০০ টাকা লিটার। ৬০-৭০ টাকা কেজির ডালডা এখন ২৫০ টাকা কেজি। এরমধ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন ধরনের উপকরণ ব্যবহার করে। যেমন তেল আটা ময়দার আলাদা কোয়ালিটি আছে। যে কোম্পানী যে উপকরণ ব্যবহার করবে সেই হারে দাম নির্ধারণ হয়ে থাকে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্রেড, বিস্কুট ও কনফেকশনারী প্রস্তুতকারক সমিতি সিলেট জেলা সভাপতি ও এশিয়া ফুডস-এর স্বত্তাধিকারী ছালেহ আহমদ চৌধুরী দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, সকল নিত্যপণ্যের দাম কয়েকগুণ বেড়েছে। বাজারে নিত্যপণ্যের দামের সাথে সমন্বয় করে আমরা পণ্যের দাম নির্ধারণ করি। এছাড়া বড় বড় কোম্পানী যেমন প্রাণ, অলটাইম সহ বিভিন্ন কোম্পানী বেকারী পণ্যের কি দাম নির্ধারণ করে সেটিও আমরা পর্যালোচনা করি। যে হারে চিনি-তেল, ময়দা সহ নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে সেই হারে বেকারী পণ্যের দাম বাড়ানো হলে ৩ গুণ হতো। কিন্তু আমরা বেকারী মালিকগণ নামমাত্র মুনাফা করে কোনরকম ব্যবসায় টিকে আছি। সিলেটে কয়েকটি বেকারী বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকে কষ্ট করে টিকে আছে। এভাবে চলতে থাকলে আরো বেকারী বন্ধ হতে পারে।
তিনি বলেন, আমাদের সমিতির আওতায় সিলেটে ৫৮টি বেকারী রয়েছে। এসব বেকারীতে ব্রেড, বিস্কুটের পাশাপাশি কেকসহ বিভিন্ন পণ্য রয়েছে। সিলেটের বাজারে স্থানীয় বেকারীর ব্রেড বেশী চলে। তাই স্থানীয়ভাবে আলোচনা সাপেক্ষেই ব্রেডের দাম বাড়ানো হয়েছে। ব্রেডের ন্যায় বিস্কুট ও অন্যান্য বেকারী পণ্যের দামও বেড়েছে। এরপরও স্থানীয় বেকারী সমূহের বিস্কুটের দাম কিন্তু এতটা বাড়েনি। এক্ষেত্রে অভিজাত কনফেকশনারির সাথে বেকারী গুলোর তুলনা করা যায়না। কারণ বেকারীর বিস্কুটের দাম নির্ধারণ করা হয় ক্রেতার দিক লক্ষ্য রেখে। অনেক সময় ক্রেতা সাধারণ অভিজাত বেকারীগুলো থেকে অতিরিক্ত দামের পণ্য কেনে স্থানীয় বেকারীকে দায়ী করেন। যা দুঃখজনক।
বিএসটিআই সিলেটের উপপরিচালক (মেট্রোলজি) মো. লুৎফুর রহমান দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, বাংলাদেশের একমাত্র সেক্টর হচ্ছে বেকারী সেক্টর। যেখানে পণ্যের দাম বাড়া কমা নিয়ে কোন কর্তৃপক্ষ নেই। ব্রেড বিস্কুটের দাম নির্ধারণ সংক্রান্ত বিষয়ের সাথে আমাদের সম্পর্ক নেই। আমাদের কাজ হচ্ছে গায়ে লেখা ওজন অনুযায়ী পণ্য প্যাকেটে বা কৌটায় থাকতে হবে। এছাড়া পণ্যের মান ঠিক থাকতে হবে। এসবে কোন ভেজাল হলে বিএসটিআই একশনে যেতে পারে। এর বাইরে আমাদের কোন এখতিয়ার নেই।
ভোক্তা অধিকার সিলেট বিভাগীয় উপপরিচালক মো. ফখরুল ইসলাম দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, বেকারী পণ্যের দাম নির্ধারণ নিয়ে সিলেটে সরকারীভাবে কোন কর্তৃপক্ষ আছে বলে আমার জানা নেই। যদি কোন ক্রেতা বেকারীজাত পণ্য কিনে প্রতারিত হন। কিংবা কেউ যদি অধিক মুনাফা লাভের চেষ্টা করে তাহলে ভোক্তা অধিকার বেকারীর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করতে বাধ্য হবে।
বেকারী পণ্যের ব্যবসায়ীদের সাথে আলাপকালে জানা যায়, গেল ২ বছরে চিনি, তেল, ময়দা, আটা, ঘি, ডালডাসহ সবগুলো উপকরণের দাম ২ থেকে ৩ গুণ বেড়েছে। কিন্তু এই ২ বছরে ১০ টাকার ব্রেড মার্কেট থেকে উঠিয়ে নেয়া হলেও ৫০ টাকার ব্রেড কিন্তু ১০০ টাকা হয়নি। কিছুক্ষেত্রে ৬০-৭০ টাকা হয়েছে। উপকরণের হারে দাম বাড়ানো হলে আগের ৫০ টাকার ব্রেড এখন কমপক্ষে দেড়শো টাকা হতো। কম মুনাফা করেও বাজারে ক্রেতা নেই। অর্ধেক পণ্য তৈরী করেও বিক্রি করা যাচ্ছেনা। আর দাম বাড়ানো হলে তো কেউ বেকারী পণ্য কিনতে চাইবেনা। তাই ক্রেতাদের বিষয়টি মাথা রেখেই কম মুনাফা করেই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন বেকারী মালিকগণ।
নগরীর আম্বরখানা এলাকার এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বলেন, আগে ১০ টাকায় যে ব্রেডের সাইজ ছিল সেই ব্রেডের দাম এখন ২৫ টাকা হলেও সাইজ আরো ছোট হয়েছে। সাধারণ মানুষ এত দামে বেকারির পণ্য কিনতে নারাজ। প্রতিদিন যেখানে আমার ৩০ থেকে ৪০ পিস ব্রেড বিক্রি হয় সেখানে দাম বৃদ্ধির কারণে ৫ থেকে ১০ পিস ব্রেড বিক্রি করাও কঠিন হয়ে পড়েছে। সবকিছুর দাম বাড়ছে তাই বেকারির পণ্যেরও দাম বাড়ছে। কিন্তু গরীব ও শ্রমজীবি মানুষগুলো কি খাবে সেটা নিয়ে কেউ ভাবেনা।
সুবিদবাজার এলাকার শ্রমজীবি রুহুল ইসলাম বলেন, সামান্য বনরুটির দাম তাও দ্বিগুণ হয়ে গেল বাজারে সবকিছুর দাম দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমি প্রতিদিন সকালবেলা একটা চা ও একটা বনরুটি খাই। সম্প্রতি সকালে স্থানীয় চায়ের দোকানে গেলে দোকানদার জানান রুটি কিন্তু এখন ১০ টাকা। দাম শুনে আমি অবাক হয়ে যাই। যে রুটি ৫ টাকায় খেয়েছি সেই রুটি এখন ১০ টাকায় খেতে হবে। আমাদের মত খেটে খাওয়া মানুষের পরিবারগুলো মুখ বুজে আর্তনাদ করা ছাড়া কোনো উপায় নেই।