প্রশিক্ষণের বাইরে ৯৮ শতাংশ বেসরকারি শিক্ষক!
প্রকাশিত হয়েছে : ১৩ মে ২০২৩, ১২:১০:৩৩ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট: নতুন শিক্ষাক্রমের ওপর এখন পর্যন্ত ইবতেদায়ি মাদ্রাসা ও কিন্ডারগার্টেনের মাত্র ২ শতাংশ শিক্ষক প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। ৯৮ শতাংশ শিক্ষকের প্রশিক্ষণের বাইরে থাকার পেছনে দুটি বিষয় সামনে এনেছেন সংশ্লিষ্টরা। এগুলো হলো শিক্ষকদের অনাগ্রহ ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের তদারকির অভাব। একে তো প্রশিক্ষণ শুরু হতে দেরি, তার ওপর আছে ধীরগতি। ফলে এই প্রশিক্ষণ কবে শেষ হবে, সেটিই প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ৩ মাস পরও মাদ্রাসা ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ৯৮ শতাংশ শিক্ষক প্রশিক্ষণের বাইরে থাকা মোটেও ভালো খবর নয় উল্লেখ করেন কারিকুলাম বিশেষজ্ঞরা।
জানা গেছে, নতুন শিক্ষাক্রমের ওপর মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষকদের অনলাইনে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) এই প্রশিক্ষণ দেয়। অনলাইন প্রশিক্ষণ শেষে ৬ থেকে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রথম ধাপে মোট ৫ দিন এবং ২০ থেকে ২৪ জানুয়ারি দ্বিতীয় দফায় পাঁচ দিন শিক্ষকদের সরাসরি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
অন্যদিকে, প্রাথমিকের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের উদ্বোধন হয় গত ২৩ জানুয়ারি। এরপর ৩ ফেব্রুয়ারি থেকে প্রশিক্ষণ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও সেটি হয়নি। ৭ মে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই) বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়ে একটি আনুষ্ঠানিক পত্র পাঠায়। শিক্ষকদের বলা হয়—অধিদপ্তর পরিচালিত ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম ‘মুক্তপাঠ’ এ প্রবেশ করে কোর্স সম্পন্ন করতে। ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয় তাদের অনলাইন প্রশিক্ষণ। এরপর মাদ্রাসা ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের চিঠি দিয়ে অনলাইন কোর্স সম্পন্ন করতে বলা হয়। ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয় এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ।
শিক্ষকদের এই অনলাইন প্রশিক্ষণ ৩ মার্চের মধ্যে শেষ করার চেষ্টা ছিল অধিদপ্তরের। কিন্তু সেটি না হওয়ায় আবার বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ৩০ এপ্রিলের মধ্যে অনলাইন কোর্স শেষ করতে বলা হয়। এদিকে এপ্রিল পেরিয়ে মে মাসেরও এক সপ্তাহ পার হয়ে গেছে। এখনো শিক্ষক প্রশিক্ষণ সন্তোষজনক নয়। বছরের শুরুতে এক মাসের মধ্যে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করে মাউশি। তবে পর্যাপ্ত জনবল থাকার পরও তিন মাসে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ইবতেদায়ি মাদ্রাসা ও কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ শেষ করতে পারেনি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। অনলাইন প্রশিক্ষণ শেষ না হওয়ায় শুরু করা যাচ্ছে না সরাসরি প্রশিক্ষণ কার্যক্রমও।
৮ মে পর্যন্ত পাওয়া শিক্ষক প্রশিক্ষণের একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ইবতেদায়ি মাদ্রাসা ও কিন্ডারগার্টেনের মোট ৬ লাখ ৩৯ হাজার ২২৪ শিক্ষকের মধ্যে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ২ লাখ ৯৪ হাজার ৩৮৭ জন। এর হার ৪৬ দশমিক ০৫ শতাংশ। এই শিক্ষকদের মধ্যে কোর্স শেষ করে সনদ পেয়েছেন ২ লাখ ৭৪ হাজার শিক্ষক। অংশগ্রহণকারী শিক্ষকদের মধ্যে ভালো অবস্থানে রয়েছে খুলনা, বরিশাল ও রাজশাহী বিভাগ। তাদের প্রশিক্ষণ গ্রহণের হার যথাক্রমে ৫৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ, ৫০ দশমিক ৪৪ শতাংশ এবং ৪৯ দশমিক ৬০ শতাংশ। প্রশিক্ষণ গ্রহণের দিক দিয়ে সবার পেছনে ঢাকা বিভাগ। এই বিভাগের মাত্র ৩৯ দশমিক ৮৩ শতাংশ শিক্ষক প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এ ছাড়া রংপুরের ৪২ দশমিক ৮২ শতাংশ ও সিলেটের ৪৩ দশমিক ৭৮ শতাংশ শিক্ষক প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। আর চট্টগ্রামের ৪৭ ও ময়মনসিংহের ৪৮ শতাংশ শিক্ষক প্রশিক্ষণের আওতায় এসেছেন।
জানা গেছে, সারা দেশে শুধু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক আছেন ৩ লাখ ৮৯ হাজার ৫১৪ জন। যার মধ্যে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ২ লাখ ৮৯ হাজার ৩১৫ জন। অংশগ্রহণের হার ৭৪ দশমিক ২৮ শতাংশ। সরকারি প্রাথমিকের মধ্যে প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়ার হার বেশি রাজবাড়ী জেলায় ৯৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ। সবচেয়ে কম ঝালকাঠি জেলায় ৪৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ। আর মাদ্রাসা ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষক আছেন ২ লাখ ৪৯ হাজার ৭১০ জন। এর মধ্যে প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছেন মাত্র ৫ হাজার ৭২ জন। অংশগ্রহণের হার ২ দশমিক ০৩ শতাংশ। এর মধ্যে মাদ্রাসায় মোট শিক্ষক ১ লাখ ২৭ হাজার ৫৭৭ জন। প্রশিক্ষণ নিয়েছেন মাত্র ৬ হাজার ৯৭৯ জন। এর হার ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ।
বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মিজানুর রহমান সরকার বলেন, অনেক কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষক এই প্রশিক্ষণে অংশ নিচ্ছেন না। এটা তদারকির অভাবে হতে পারে। থানা শিক্ষা অফিস থেকে সব কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষককে হয়তো জানানো হয়নি।
এ বিষয়ে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হাবিবুর রহমান বলেন, আমাদের শিক্ষকদের পর্যায়ক্রমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। তার পরও প্রশিক্ষণের বিষয়ে শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হবে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশিক্ষণ) উত্তম কুমার দাশ বলেন, বেসরকারি শিক্ষকরা আসলে উৎসাহী নয়। তাদের সঙ্গে আমরা মাঠপর্যায়ে সভা করেছি; কিন্তু তেমন কোনো সাড়া পাইনি। তারা মুক্তপাঠে প্রবেশ করতে পারছে না। অনেকে ঢুকছেই না। তাদের নির্দিষ্ট কোনো সংগঠন নেই। একেকটা প্রতিষ্ঠান মানে একেকটা সংগঠন। উপজেলা পর্যায়ে কথা বলেছি, যারা এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের নিয়ন্ত্রণ করে তাদের ডাকতে বলেছি; কিন্তু আমাকে বলা হয়েছে—তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ নেই। তাদের কারণে আমরা এগোতে পারছি না।
তিনি আরও বলেন, নির্দেশনা এটাই যে, তারা যেন প্রশিক্ষণ নেয়। আর সরাসরি প্রশিক্ষণও দেওয়া হবে। আমরা সে প্রস্তুতি নিচ্ছি। আগামী জুনের মধ্যে শেষ করতে চাচ্ছি।
এ বিষয়ে জানতে চেয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াতের মোবাইল ফোনে কল দেওয়া হলে তিনি মিটিংয়ে আছেন এবং পরে কথা বলবেন জানান। পরে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।
মূল্যায়ন বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এস এম হাফিজুর রহমান বলেন, এর প্রভাব ভালো হবে না। কারণ, যারা কারিকুলাম বাস্তবায়ন করবেন, তাদের আগে সেটি বুঝতে হবে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ গ্রহণ না করার পেছনে আমাদের সংস্কৃতি একটি কারণ হতে পারে। বিগত সময়ে সরকারি প্রাথমিকের শিক্ষকরা বিভিন্ন প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা সেটি পাননি। তারা আবার এমনটি মনে করছেন না তো যে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা তো এমন প্রশিক্ষণ পায় না। এটা তাদের জন্য নয়।