আমেরিকার সমালোচনায় ব্যাপক কৌতুহল
প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ মে ২০২৩, ৮:২০:২৩ অপরাহ্ন
জালালাবাদ ডেস্ক : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বেশ কিছুদিন যাবত আমেরিকার সমালোনায় সরব হয়েছেন। শেখ হাসিনা যেভাবে দৃঢ় কন্ঠে ক্রমাগত আমেরিকার সমালোচনা করছেন, তাতে অনেকে বেশ অবাক হচ্ছেন। প্রকাশ্যে এই সমালোচনার সূত্রপাত হয়েছিল এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে সংসদের বিশেষ অধিবেশনে ভাষণ দেবার সময়। সর্বশেষ লন্ডনে বিবিসির সাথে এক সাক্ষাৎকারেও তিনি আমেরিকার সমালোচনা করতে পিছপা হননি। আমেরিকার বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ধারাবাহিক সমালোচনা দেশে-বিদেশে অনেকের মাঝে ব্যাপক কৌতুহল তৈরি করেছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমেরিকার বিরুদ্ধে প্রকাশ্য এবং সরাসরি সমালোচনার বেশ কয়েকমাস আগে থেকেই আঁচ পাওয়া যাচ্ছিল যে দুই দেশের মধ্যে হয়তো কিছু ‘অস্বস্তি’ তৈরি হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বর্তমান সরকারের এই টানাপোড়েন শুরু হয় ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে, যখন বাংলাদেশের এলিট ফোর্স র্যাব ও তার কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আমেরিকা।
শেখ হাসিনা আমেরিকার সমালোচনায় মুখর হবার আগেও ক্ষমতাসীন দলের কিছু সিনিয়র নেতাদের বক্তব্যে যুক্তরাষ্ট্র বিরোধী মনোভাব প্রকাশিত হয়েছে।
ঢাকার নিযুক্ত আমেরিকার রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের নানা তৎপরতা নিয়ে ক্ষমতাসীনদের মাঝে অসন্তুষ্টি তৈরি হয়েছিল আগেই। হাস যখন নিখোঁজ বিএনপি নেতা সাজেদুল হক সুমনের ঢাকার শাহীনবাগের বাসায় যান তখন ক্ষোভ চেপে রাখেননি আওয়ামী লীগ নেতারা।
র্যাবের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আর নির্বাচন ঘিরে চাপ- এই দুটা বিষয় মূলত বাংলাদেশ সরকারকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। এমনটাই মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। যদিও নির্বাচন নিয়ে চাপ থাকার বিষয়টি সরকার কিংবা আওয়ামী লীগের নেতারা কখনোই স্বীকার করেন না।
র্যাবের উপর নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ থাকার বিষয়টি প্রতীয়মান হয় আওয়ামী লীগ নেতাদের কথায়। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বিবিসিকে বলেন, ‘’হঠাৎ করে আমরা দেখলাম, আমাদের প্রশাসনের ছয়জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হলো। কেন? তারা নাকি মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে। অথচ এই বাংলাদেশে একসময় জঙ্গিদের, সর্বহারাদের অনেক তৎপরতা ছিল। এই র্যাবকে দিয়েই তাদের দমন করে বাংলাদেশে শান্তি আনা সম্ভব হয়েছে।‘’
যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বিবিসি বাংলাকে বলেন, প্রথম দিকে ভাবা হয়েছিল, এটা হয়তো খুব তাড়াতাড়ি কথাবার্তা বলে সমাধান করা যাবে। কিন্তু প্রক্রিয়া সম্পর্কে আমাদের যথেষ্ট ভালো ধারণা না থাকার কারণে এখন হয়তো তারা একটু হতাশ হয়ে যাচ্ছে। সেই কারণেই তারা অস্বস্তিতে ভুগছে । ক্ষোভের আরেকটি কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশের আগামী সাধারণ নির্বাচন ইস্যু।
সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য বারবার তাগাদা দিচ্ছে আমেরিকা। এর বড় কারণ হচ্ছে, ২০১৪ সাল এবং ২০১৮ সালের বিতর্কিত সাধারণ নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে জোরালো সমালোচনা আছে।
গত কয়েকমাসে আমেরিকা এবং বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের মধ্যে যতগুলো বৈঠক হয়েছে তার প্রায় সবকটিতে আমেরিকার তরফ থেকে সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করা হয়েছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবর থেকে এ ধারণা পাওয়া যায়। এপ্রিল মাসের ১০ তারিখে ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের সঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের মধ্যে যখন বৈঠক হয়, সেখানে বাংলাদেশে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন, মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতির নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে বিশেষ তাগিদ দেয়া হয়।
ব্লিঙ্কেন সে বৈঠকে বেশ পরিষ্কার করেই বলেছেন, বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনের দিকে আমেরিকা এবং পুরো বিশ্ব তাকিয়ে আছে।
নির্বাচন নিয়ে আমেরিকার ক্রমাগত চাপের কারণে ক্ষোভ থাকতে পারে বলে মনে করেন সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির।
তিনি বলেন, দুই পক্ষের দৃষ্টিভঙ্গির বেশ পার্থক্য আছে। এখানে যারা ক্ষমতায় আছেন, তারা এই চাপকে ভালো চোখে দেখছেন না। ফলে সেটা তাদের মধ্যে অসন্তুষ্টি তৈরি করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পাবলিক ইউনিভার্সিটি সিস্টেমের শিক্ষক সাঈদ ইফতেখার আহমেদ মনে করেন, বাংলাদেশের সরকারকে অসাংবিধানিকভাবে সরানোর কোন অভিপ্রায় আসলে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের নেই।
কারণ সম্প্রতি পাস হওয়া বার্মা অ্যাক্টের কারণে সেটা এখন তাদের পক্ষে সম্ভবও না। কারণ বার্মা অ্যাক্টে পরিষ্কার করে দেয়া হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র এখন থেকে কোন অবৈধ শাসক বা সামরিক শাসকদের সমর্থন দেবে না। একসময় যুক্তরাষ্ট্র এরকম অবৈধ শাসকদের সমর্থন দিয়েছে, এই ইতিহাসেরে কারণে হয়তো বাংলাদেশের অনেকের ভেতর শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মূল উদ্বেগের বিষয় হলো, বাংলাদেশে চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি। এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের মূল পররাষ্ট্রনীতি হলো, চীন এবং রাশিয়ার বিশ্বে ক্রমবর্ধমান অর্থনীতিক, সামরিক বা রাজনৈতিক প্রভাব খর্ব করা। গত আট থেকে ১০ বছরে গণচীনের অনেক প্রভাব বেড়েছে বাংলাদেশে। এটাই হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের মূল মাথাব্যথা।
অতীতের উদাহরণ টেনে সাঈদ ইফতেখার আহমেদ বলছেন, কোন রাষ্ট্রের সঙ্গে টানাপড়েন তৈরি হলে যুক্তরাষ্ট্র কতগুলো বিষয় সামনে নিয়ে আসে। যেমন গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ড, সুষ্ঠু নির্বাচন ইত্যাদি। এই সবগুলো জায়গাতেই প্রতিটা বিচারেই বাংলাদেশের অবস্থান কিন্তু দুর্বল।
সাঈদ ইফতেখার বলেন, মানবাধিকার, নির্বাচন, মতপ্রকাশ- এই বিষয়গুলো নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরব তখনি হবে, যদি বাংলাদেশ যদি ক্রমাগত চীনের দিকে হেলতে থাকে, রাশিয়ার ভূমিকা বাড়তে থাকে।