এত উন্নয়ন, তবু জলাবদ্ধতা!
প্রকাশিত হয়েছে : ১৮ মে ২০২৩, ৩:০০:৪৫ অপরাহ্ন
পানি নিষ্কাশনে কৃত্রিম প্রতিবন্ধকতা মূল কারণ: সিসিক প্রধান প্রকৌশলী –

ফাইল ছবি:
মুনশী ইকবাল: প্রকল্পের পর প্রকল্প, মাঝেমধ্যে ছড়া-খাল উদ্ধার অভিযান তবুও নগরীর জলাবদ্ধতা সমস্যা নিরসন হচ্ছেনা। একসময় কেবল নগরীর অপেক্ষাকৃত নিচু এলাকায় বৃষ্টির পানি জমতো। কিন্তু বর্তমানে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে অল্প কিছুসময় বৃষ্টি হলেই তলিয়ে যাচ্ছে নগরীর বিভিন্ন রাস্তা ও বাড়িঘর। গত মঙ্গলবার বিকেলে সিলেটে কালবোশেখীর সময় মাত্র আধাঘণ্টার মতো বৃষ্টিপাত হয়। এই অল্প সময়েই তলিয়ে যায় নগরীর অনেক রাস্তাঘাট। এরপর থেকে বিষয়টি আবারও নতুন করে আলোচনায় এসেছে। সিসিকের পক্ষ থেকে যদিও বারবার দাবি করা হয় পানি এখন জমে না নেমে যায়। কিন্তু নগরবাসীর প্রশ্ন আগে তো অনেক জায়গায় পানিই উঠতো না তাহলে এখন উঠে কেন? আর পানি বাড়িঘরে উঠে সব নষ্ট করে দেওয়ার পর নেমে গিয়ে কী হবে ? বিশেষজ্ঞদের অনেকে জানিয়েছেন নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনের সবচেয়ে বড়ো কার্যকর পদক্ষেপ হলো পানি যাতে দ্রুত প্রবাহিত হয়ে সরে যেতে পারে এই ব্যবস্থা করা। এজন্য ছড়া-খাল দখলমুক্ত রাখা এবং ছড়ার পানি যাতে বের হয়ে যেতে পারে সেজন্য সুরমায় পানি নিষ্কাশন নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য সিলেট সিটি কর্পোরেশন আলাদা প্রকল্প নিয়ে কাজও করেছে তবে তারা মনে করেন সিসিক নির্ধারিত অ্যাকশন প্ল্যান না থাকায় প্রকল্পগুলো থেকে দৃশ্যমান অগ্রগতি চোখে পরেনি। যার ফলে দুর্ভোগ আরও বেড়েছে বরং কমেনি।
সিলেট নগরীর উন্নয়নের মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও পুর প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. জহির বিন আলম জানান, সুরমা নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। এর কারণে নগরের পানি নিষ্কাশন হতে পারে না। নগরকে জলাবদ্ধতামুক্ত করতে হলে সুরমা নদী খনন করতে হবে। তা না হলে কেবল ছড়া উদ্ধার করে কোন সুফল মিলবে না।
এ ব্যাপারে সিলেট শহর জলাবদ্ধতা থেকে মুক্ত রাখতে কয়েকটি পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। তাদের মতে পানির অবাধ প্রবাহ রায় ছড়া-খালকে অবৈধ দখলবাজদের কবল থেকে রা করতে হবে। ছড়াগুলো বিভিন্ন পাহাড় থেকে নেমে আসে। এর সাথে জীববৈচিত্রেরও সম্পর্ক গভীর। এতে ছড়াগুলো প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য হারায়। ছড়ার দুই পাশে গার্ডওয়াল নির্মাণ প্রাকৃতিক ছড়ার বৈশিষ্ট্য নষ্ট করে, তাই দুই পাশে গার্ডওয়াল নির্মাণ করে পাহাড় থেকে নেমে আসা পানির এই প্রবাহকে ড্রেনের মতো বানানো বন্ধ করতে হবে। এসব ছড়ার ছিল নিজস্ব বাস্তুতন্ত্র। বিভিন্ন বন্যপ্রাণী ও জলজ প্রাণের উপস্থিতি ছিল এই ছড়াগুলোতে। গার্ডওয়ালের জন্য ছড়ার এই বৈশিষ্ট্য নষ্ট হয়ে গেছে। তা ছাড়াও পয়: নিষ্কাশনের পানি ও নাগরিক বর্জ্য ছড়া বা খালে নিপে অব্যাহত আছে। এর কারণ যে পরিমাণ অর্থ দখল-দূষণ থেকে বাঁচানোর জন্য ছড়ার পেছনে ব্যয় হয়েছে এর সামান্য অংশ দূষণবিরোধী সচেতনতামূলক কার্যক্রমে ব্যয় করা হয়নি। দখলদারদের বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ে একটি বড়ো অংকের অর্থ বরাদ্দ রাখাও প্রাসঙ্গিক।
সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা যায়, সিলেট নগরীর ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে ছোটো বড়ো প্রায় ২৫টি ছড়া। তবে দখল-দূষণে এখন অনেক স্থানে ছড়ার অস্তিত্বই হারিয়ে গেছে। নগরের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া ১৩টি বড়ো ছড়ার দৈর্ঘ্য প্রায় ৭৩ কিলোমিটার। দীর্ঘদিন ধরে এসব ছড়ার দুই পাশ দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করেছেন অবৈধ দখলদাররা। এই ছড়াগুলো উদ্ধারে ৩টি প্রকল্পে এখন পর্যন্ত প্রায় ৪০০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে সিলেট সিটি করপোরেশন। সর্বশেষ ২০১৬ সালে ছড়া-খাল দখলমুক্ত করতে ২৩৬ কোটি ৪০ লাখ টাকার বৃহৎ একটি প্রকল্প নেওয়া হয়। প্রকল্পের আওতাভুক্ত ছড়া ও খালগুলো ছিল মালনীছড়া, গোয়ালীছড়া, গাভীয়ার খাল, মুগনীছড়া, কালীবাড়ী ছড়া, হলদিছড়া, যুগনীছড়া, ধোপাছড়া, বুবিছড়া, বাবুছড়া, রত্নার খাল, জৈন্তার খাল ও বসুর খাল।
২০০৯ সালে এই প্রকল্পের আওতায় নগরীর ছড়াগুলো উদ্ধার কার্যক্রম চালায় সিটি কর্পোরেশন। এরপর ২০১৩ সালে একই ল্েয গ্রহণ করা হয় ২০ কোটি টাকার আরেকটি প্রকল্প। এরপর ২০১৬ সালে নেওয়া হয় ২৩৬ কোটি ৪০ লাখ টাকার প্রকল্প। এরমধ্যে এই ৩টি প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। সর্বশেষ ২০২০ সালের ডিসেম্বেরে জলাবদ্ধতা নিরসন, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ও অবকাঠামো নির্মাণের জন্য ১ হাজার ২২৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় সরকার।
এদিকে ২০১৬ সালে ছড়া-খাল দখলদারদের একটি তালিকা করে সিটি কর্পোরেশন। এতে ২৬৮ জনকে দখলদার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। দখলদারদের বেশিরভাগই প্রভাবশালী। এ ছাড়াও কয়েকটি সরকারি প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। ছড়া-খাল দখল করে এরা গড়ে তুলেছেন বহুতল ভবন। অনেকে পরিবর্তন করে ফেলেছেন ছড়ার গতি। ফলে বন্ধ হয়ে গেছে পানি নিষ্কাশনের পথ। এতে বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এ ছাড়াও এই সময়ে নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে আরও কয়েকটি ছোটো ছোটো প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়। তবে এত প্রকল্প, এত অর্থব্যয় সত্বেও প্রভাবশালী দখলদারদের উচ্ছেদ করতে না পারায় এসব প্রকল্পে তেমন সাফল্য আসেনি। মুক্তি মেলেনি জলাবদ্ধতা থেকে।
সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নুর আজিজুর রহমান বলেন, অধিক বৃষ্টিতে নগরীর কিছু এলাকায় পানি জমলেও অল্প সময়ের মধ্যে তা নেমে যায়। তিনি বলেন, অনেক েেত্র আমরা দখলদারদের উচ্ছেদ করার পর ফের ছড়া দখল হয়ে যায়। এ ছাড়াও ময়লা-আবর্জনা ফেলেও ছড়ার পানি নিষ্কাশনে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা হয়। এজন্য সমন্বিত উদ্যোগ দরকার। এটা কোনোভাবেই সিটি কর্পোরেশনের একার পে সম্ভব নয়।