ওষুধের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি
প্রকাশিত হয়েছে : ২১ মে ২০২৩, ১:০০:০৭ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট: গ্যাস, বিদ্যুৎসহ নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতিতে এমনিতেই থমকে যাচ্ছে নিম্নআয়ের মানুষের জীবনযাত্রা। এর মধ্যেই ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’র মতো অস্বাভাবিকহারে বেড়েছে ওষুধের দাম। সিলেট তথা দেশের ফার্মেসিগুলোতে অ্যান্টিবায়োটিক, ভিটামিন, ক্যালসিয়াম, অ্যালার্জি, গ্যাস্ট্রিক, উচ্চ রক্তচাপ, জ্বর ও ডায়াবেটিসের ওষুধের দাম বেড়েছে প্রায় ৯০ শতাংশ পর্যন্ত। একই সাথে অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে সবধরণের ওষুধের দাম।
এমন পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে জরুরী নিত্যপণ্যের চাহিদা মেটাতে গিয়ে ওষুধ ব্যবহারেও কাটছাঁট করছেন সাধারণ মানুষ। সাধ-সাধ্যের সমন্বয় করে অনেকে ৭ দিনের জায়গায় ৪ দিনের ওষুধ কিনছেন। কেউ কিনছেন প্রেসক্রিপশনের অর্ধেক ওষুধ। একই সাথে সামান্য সুস্থবোধ করলেই ছেড়ে দিচ্ছেন ওষুধ সেবন। ফলে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি।
ওষুধের দাম বাড়ানোর কারণ হিসেবে ডলার বিনিময়মূল্য বৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতিকে দায়ী করছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। তবে একে দাম বৃদ্ধি নয়, বরং মূল্য সমন্বয় বলছেন ওষুধশিল্প-সংশ্লিষ্টরা। তারা জানান, ডলারের বিনিময়মূল্য ও মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। ওষুধ উৎপাদনে ব্যবহৃত কাঁচামাল আমদানি ব্যয় বেড়েছে। প্যাকেজিং ম্যাটেরিয়াল, পরিবহন ও সরবরাহ ব্যয় এবং জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় ওষুধের মূল্য সমন্বয় করা হচ্ছে। এসব খরচ কমে এলে আবার মূল্য সমন্বয় করে কমিয়ে আনা হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার ১১৭টি ওষুধের মূল্য নির্ধারণ করে সরকার। বাকি প্রায় দেড় হাজার কোম্পানির ৩৭ থেকে ৪২ হাজার ব্র্যান্ডের ওষুধের মূল্য নির্ধারণ করে আমদানিকারক ও প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান। এ ক্ষেত্রে একেবারেই নির্বিকার ঔষধ প্রশাসন। অথচ বিশ্বের অন্যান্য দেশে সব ওষুধের দাম নির্ধারণ করে সরকার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়মও এমনটাই নির্দেশ করে। দেশের ১৯৮২ সালের ওষুধনীতিতেও তা ছিল। কিন্তু ১৯৯৪ সালে ওষুধ কোম্পানির দাবির মুখে বলা হয়, ১৭ শতাংশ ওষুধের দাম সরকার নির্ধারণ করবে। বাকিটা নির্ধারণ করবে উৎপাদক প্রতিষ্ঠান। তখন এটিকে বলা হলো ইন্ডিকেটিভ প্রাইস।
সিলেট নগরীর বিভিন্ন ফার্মেসিতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সম্প্রতি ওষুধের দাম ২০ থেকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের তৈরি ১২টি ট্যাবলেটের একপাতা অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ সেফোটিল প্লাস (৫০০ এমজি) ৫০ থেকে বেড়ে ৬০ ও মোক্সাসিলিন (১০০ মিলি) সিরাপ ৪৭ থেকে ৭০ টাকা হয়েছে। একইভাবে উচ্চ রক্তচাপের প্রতি পিস বিসকোর (২.৫ এমজি) ট্যাবলেট ৬ থেকে ৭ টাকা হয়েছে। অ্যালার্জির প্রতি পিস ফেক্সো (১২০ এমজি) ট্যাবলেট ৮ থেকে ৯ টাকা হয়েছে। শিশুদের নাকের এন্টাজল ০.৫% ড্রপ ১১ থেকে ১৮ টাকা ও প্রাপ্তবয়স্কদের নাকের এন্টাজল ০.১% ড্রপ ১১ থেকে ২০ টাকা করা হয়েছে। আমাশয় রোগীদের পেটের সমস্যায় ব্যবহৃত প্রতি পিস প্রোবায়ো ক্যাপসুল ১৪ থেকে ২৫ টাকা হয়েছে। ডায়াবেটিসের প্রতিটি কমপ্রিট (৮০ এমজি) ট্যাবলেট ৭ থেকে ৮ টাকা হয়েছে। কাশির তুসকা প্লাস (১০০ মিলি) সিরাপ ৮০ থেকে ৮৫ এবং ফেক্সো (৫০ মিলি) সিরাপ ৪৮ থেকে ৫৫ টাকা করা হয়েছে। ক্যালসিয়ামের এক কৌটা নিউরো-বি ট্যাবলেটের দাম ২৭০ থেকে বেড়ে ৩০০ টাকা হয়েছে। বেক্সিমকোর তৈরি শিশুদের জ্বরের চিকিৎসায় ব্যবহৃত নাপা ড্রপ ১৫ থেকে বাড়িয়ে ২০ টাকা করা হয়েছে। নাপা সিরাপ (৬০ মিলি) ২০ থেকে ৩৫ টাকা করা হয়েছে।
অপসোনিন ফার্মার তৈরি উচ্চ রক্তচাপের প্রতি পিস বিসলল-ম্যাক্স (২.৫ এমজি) ৬ থেকে ৮ টাকা হয়েছে। ১৪টির একপাতা বিসলল (৫ এমজি) ট্যাবলেট ১৪০ থেকে ১৬০ টাকা হয়েছে। এ ছাড়া গ্যাস্ট্রিকের প্রতিটি ফিনিক্স (২০ এমজি) ট্যাবলেট ৫ থেকে ৭ টাকা হয়েছে। ইনসেপটার তৈরি উচ্চ রক্তচাপের প্রতি পিস ওসারটিল (৫০ এমজি) ৮ থেকে ১০ টাকা করা হয়েছে। গ্যাস্ট্রিকের চিকিৎসায় ব্যবহৃত প্রতি পিস ওমিডন (১০ এমজি) ট্যাবলেট ৩ থেকে ৪ টাকা হয়েছে। রেনেটার তৈরি অ্যালার্জির প্রতি পিস ফেনাডিন (১২০ এমজি) ট্যাবলেট ৮ থেকে ৯ টাকা করা হয়েছে।
এসকেএফের তৈরি শিশুদের জিংক সিরাপ (১০০ মিলি) ৩৫ থেকে ৫০ টাকা হয়েছে। হামদর্দের তৈরি শিশুদের পেটফাঁপা ও হজমশক্তির চিকিৎসায় ব্যবহৃত নওনেহাল সিরাপ ৬০ থেকে ৭৫ টাকা হয়েছে। একমি কোম্পানির তৈরি শ্বাসকষ্টের চিকিৎসায় মোনাস ১০ মিলি ট্যাবলেট ১২ থেকে ১৬ টাকা হয়েছে। রেডিয়েন্ট ফার্মার তৈরি ব্যথা ও গ্যাস্ট্রিকের চিকিৎসায় ন্যাপ্রোসিন প্লাস ২০ এমজি+ ৩৭৫ এমজি ট্যাবলেট ১৬ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ২০ টাকা হয়েছে। এরিস্টোফার্মার তৈরি মাল্টি ভিটামিন ১৫ পিস ট্যাবলেটের কৌটা ১০৫ থেকে বাড়িয়ে ১৩৫ টাকা করা হয়েছে। ৩০ পিস ট্যাবলেটের একটি মাল্টি ভিটামিনের কৌটা ২১০ থেকে ২৭০ টাকা হয়েছে। টাইপ-২ ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ৩০টির এক বক্স লিনাগ্লিপ (৫ এমজি) ট্যাবলেটের দাম ৬০০ থেকে ৬৬০ টাকা করা হয়েছে। উচ্চ রক্তচাপের জন্য ৩০টির এক বক্স রুভাসটিন (৫ এমজি) ট্যাবলেট ৩০০ থেকে ৩৬০ টাকা করা হয়েছে। এ ছাড়া ৩০টির এক বক্স রুভাসটিন (১০ এমজি) ট্যাবলেট ৬০০ থেকে ৭২০ টাকা করা হয়েছে। প্রেশারের চিকিৎসায় ৩০ পিসের একপাতা ওসারটিন (৫০ এমজি) ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা হয়েছে।
নগরীর ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাপাল সংলগ্ন এক ফার্মেসী ব্যবসায়ী জানান, একদিকে ওষুধের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। অপরদিকে মেডিকেল এলাকায় ওষুধ ব্যবসার কঠিন প্রতিযোগিতা। এই পরিস্থিতিতে আমাদের মুনাফা অনেক কমেছে। আগে ৩জন কর্মচারী ছিল। এখন কমিয়ে ২ জন রেখেছি। ওষুধের দাম বাড়ার কারণে অনেক মানুষ প্রেসক্রিপশনের ৪ ভাগের ১ ভাগ ওষুধ কিনেন। পরবর্তীতে এই অসুস্থ মানুষগুলো ওষুধ কিনে খাবে বলে মনে হয়না। তাই নিশ্চিত স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পরে ফের হাসপাতালে আসার আশঙ্কা বাড়ছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, দাম বাড়ায় ঠিকমতো ওষুধ কিনে খাচ্ছেন না নি¤œ আয়ের মানুষ। চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার না করলে ব্যাকটেরিয়াগুলো পুরোপুরি ধ্বংস না হয়ে আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তখন সেই ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে ওই অ্যান্টিবায়োটিকের আর কোনো প্রভাব থাকে না। এ অবস্থায় অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, আমাদের দেশের ওষুধশিল্প বিদেশি কাঁচামালের ওপর নির্ভরশীল। ডলারের মূল্য ও কাঁচামালের দাম বাড়ায় ওষুধের দামও বাড়ছে। যদি কাঁচামাল দেশে উৎপাদন করা সম্ভব হতো, তাহলে খরচও অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হতো। সেইসঙ্গে ১৯৮২ সালের ওষুধ আইন অনুসারে যদি সব ধরনের ওষুধের মূল্য নির্ধারণ করা হতো, তাহলে দেশের ওষুধের বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতো।
বাংলাদেশ ওষুধশিল্প সমিতির মহাসচিব ও হাডসন ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম শফিউজ্জামান বলেন, ডলারের দাম বাড়ায় টাকার ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ অবমূল্যায়ন হয়েছে। আবার ওষুধের কাঁচামাল আমদানি ও উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। তাই এটাকে দাম বাড়ানো বলা যাবে না, বরং সমন্বয় করা হয়েছে। ডলারের দাম স্বাভাবিক হলে ওষুধের মূল্যও সমন্বয় করা হবে। আর দেশে ওষুধের কাঁচামাল উৎপাদন সম্ভব হলে আরও কম দামে ওষুধ সরবরাহ সম্ভব হবে। তা ছাড়া মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় স্থাপিত ওষুধশিল্প পার্কে ২৭টি প্রতিষ্ঠান কাঁচামাল তৈরির প্লট বরাদ্দ পেয়েছে। এরই মধ্যে স্কয়ার, বেক্সিমকো, হেলথকেয়ারসহ অন্তত ৭-৮টি প্রতিষ্ঠান উৎপাদনের জন্য প্রস্তুত। গ্যাস সংযোগ পেলে তারা উৎপাদনে যেতে পারবে।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আইয়ুব হোসেন বলেন, দেশের ওষুধশিল্প কাঁচামাল আমদানির ওপর নির্ভরশীল। ডলার ও গ্লোবাল মার্কেটে কাঁচামালের দাম বাড়ায় ওষুধের দাম বেড়েছে। যদি চাহিদার সিংহভাগ কাঁচামাল দেশে উৎপাদন সম্ভব হয়, তাহলে এ সমস্যা থাকবে না।