আতঙ্ক বাড়াচ্ছে উষ্ণতা ও বজ্রপাত
প্রকাশিত হয়েছে : ২১ মে ২০২৩, ৩:৫১:৩৯ অপরাহ্ন
সিলেট ও খুলনা ঘুরে জাতিসংঘের বিশেষ র্যাপোর্টিয়ারের প্রতিবেদন
জালালাবাদ রিপোর্ট : ২০২২ সালের প্রায় পুরোটা সময় বাংলাদেশে হানা দিয়েছিল একের পর এক দুর্যোগ। সিলেটে হয়েছিলো স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা। আর এ বছর শীত না যেতেই শুরু হয়েছিল তাপপ্রবাহ, যা পরে রেকর্ড ভাঙল। এরপর এল ঘূর্ণিঝড় মোখার আঘাত। এখন চলছে কালবৈশাখী আর বজ্রপাতে একের পর এক মৃত্যু। এতে মানুষের জীবনযাত্রা ও সম্পদের ক্ষতি বাড়ছে। সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধীরা সবচেয়ে বেশি বিপদে আছেন।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের মানুষের দুর্যোগ পরিস্থিতি বেড়ে যাওয়ার এই তথ্য উঠে এসেছে জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক বিশেষ র্যাপোর্টিয়ারের (প্রতিবেদক) প্রতিবেদনে। ৯ মে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ে মৃত্যুর সংখ্যা তুলনামূলক কমে এসেছে। কিন্তু অতি উষ্ণতা ও বজ্রপাতের মতো নতুন ধরনের দুর্যোগে মৃত্যু ও বিপদ বাড়ছে। বাংলাদেশের ৮৩ শতাংশ মানুষ সারা বছর এ ধরনের কোনো না কোনো জলবায়ু দুর্যোগের শিকার। কেবল ঘূর্ণিঝড়ের কারণে বছরে ক্ষতি ১০ হাজার কোটি টাকার ওপরে।
প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক বিশেষ র্যাপোর্টিয়ারের ইয়ান ফ্রাই। এ উপলক্ষে গত বছরের ৪ থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর তিনি বাংলাদেশে এসে সিলেট ও খুলনা সরেজমিনে পরিদর্শন করেন। এছাড়া বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট গবেষণাগুলোকে আমলে নিয়ে তিনি প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন।
প্রতিবেদনে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশের বিভিন্ন উদ্যোগ তুলে ধরে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাজেটের ৭ শতাংশ অর্থ ব্যয় করছে। জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা তৈরি করে তা বাস্তবায়নে কাজ করছে।
প্রতিবেদনটি জমা দেওয়া হয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদে। এ বছরের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘে জলবায়ুবিষয়ক বিশেষ অধিবেশনে প্রতিবেদনটি তুলে ধরা হবে। একই সঙ্গে জলবায়ুর বিষয়টিকে বাংলাদেশের মানবাধিকারের আওতাভুক্ত করা হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট-আইআইইডির একটি গবেষণার বরাত দিয়ে জাতিসংঘের বিশেষ র্যাপোর্টিয়ারের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের প্রায় ৪৩ শতাংশ গ্রামীণ বসতি বন্যার কবলে পড়ে। আর প্রায় ৪১ শতাংশ বসতি ঝড়ের আঘাতের শিকার হয়।
প্রায় ৮৩ শতাংশ মানুষ দাবদাহ, বজ্রপাত ও শৈত্যপ্রবাহের মতো দীর্ঘমেয়াদি দুর্যোগের কারণে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সমুদ্রসীমা থেকে প্রায় ৩ মিটার উঁচুতে থাকা হাওর এলাকায় কয়েক বছর পরপর হঠাৎ বন্যা হয়। এর বাইরে খরা ও উপকূলে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার সমস্যাও বাড়ছে। দেশের খুলনা এলাকাটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ১ মিটার উঁচুতে হওয়ায় ঝড়ুবৃষ্টি হলে সেখানে জোয়ারের পানি উঠে যায়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে বজ্রপাতে মৃত্যু বেড়ে গেছে। প্রতিবছর তিন শতাধিক মানুষ বজ্রপাতে মারা যায়। নতুন এ দুর্যোগ পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে। বাংলাদেশে অবনতি হচ্ছে দাবদাহ পরিস্থিতিরও। গত বছর, মানে ২০২২ সালটি বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম উষ্ণতম বছর ছিল।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে অবশ্য বলা হয়েছে, দেশের বজ্রপাতপ্রবণ এলাকাগুলোতে বজ্রপাত নিরোধক যন্ত্র (লাইটেনিং অ্যারেস্টার) এবং আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রতিটি এলাকায় বজ্রপাত শুরুর আধা ঘণ্টা আগে পূর্বাভাস দেওয়া হবে, যাতে স্থানীয় লোকজন ওই আশ্রয়কেন্দ্র যেতে পারে।
ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতি সবচেয়ে বেশি : বিশ্বব্যাংকের একটি সমীক্ষার বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে বছরে ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ১০০ কোটি ডলারের (১০ হাজার কোটি টাকা) সমপরিমাণ সম্পদের ক্ষতি হয়। বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড় বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে বিশ্বে গ্রিনহাউস গ্যাস বেড়ে যাওয়াকে দায়ী করেন জাতিসংঘের বিশেষ র্যাপোর্টিয়ার। তিনি বলেন, শিল্পোন্নত দেশগুলোকে বাংলাদেশের ওই ক্ষয়ক্ষতির জন্য সহায়তা করা দরকার।
বিশেষ র্যাপোর্টিয়ার বাংলাদেশের সিলেট ও খুলনা জেলার বিভিন্ন স্থান পরিদর্শনের সময় ওই ক্ষয়ক্ষতির বাস্তব চিত্র দেখতে পান।
প্রতিবেদনে ২০০৭ সালে হওয়া সিডর থেকে ২০২০ সালে আম্পান পর্যন্ত চারটি ঘূর্ণিঝড়ে মৃত্যু ধারাবাহিকভাবে কমার তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশ সরকার একটি প্রকল্পের আওতায় সাড়ে চার লাখ পরিবার আশ্রয় নিতে পারে, এমন ২২ হাজার ৬৪০টি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করছে।