ক্যান্সারের আর্থিক ব্যয় ভয়াবহতা
প্রকাশিত হয়েছে : ২১ মে ২০২৩, ১২:৩০:২৯ অপরাহ্ন
সম্প্রতি বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর ২ লাখ মানুষ নতুন করে ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন। দেশে বর্তমানে প্রায় ১৫ লাখ ক্যান্সার রোগী আছেন। জটিল এ রোগের চিকিৎসায় প্রত্যেক রোগীর জন্য বছরে ব্যয় হচ্ছে ৩ থেকে ৭ লাখ টাকা। এতে এসব পরিবার ঋণগ্রস্ত হয়ে খাদ্য সংকটে পড়ছে এবং দারিদ্র্যসীমার নীচে নেমে যাচ্ছে। দেশের ১৫ লাখ ক্যন্সার রোগীর ৯০ শতাংশই চিকিৎসা পেতে অর্থ সংকটে পড়েন। প্রাথমিক পর্যায়ে সেবা নিতে বছরে ৩ লাখ ৩১ হাজার টাকা ব্যয় হয়। আর মারাত্মক আকারে ব্যয় হয় ৬ লাখ ৯৯ হাজার টাকার মতো।
পরিসংখ্যানে আরো দেখা গেছে, ক্যান্সারের সেবা গ্রহণের জন্য ৭৭ শতাংশ পরিবার ঋণ করে থাকেন। আর ৩৯ শতাংশ পরিবার তাদের সম্পদ বিক্রি করতে বাধ্য হন। ৮৮ শতাংশ পরিবার এ ব্যয় বহন করতে গিয়ে খাদ্য সংকটে পড়েন।
গবেষকদের মতে, এদেশে ১৩-১৪ শতাংশ পরিবার ক্যান্সারের কারণে দারিদ্রসীমার নীচে যাচ্ছেন। এদেশে ক্যান্সারের মতো ভয়াবহ রোগের দাপট বহুকাল আগে থেকেই। কিন্তু এ রোগ নিয়ে তেমন কোন জরীপ কিংবা কোন ধরনের দীর্ঘমেয়াদী প্রতিরোধ ও প্রতিকারমূলক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি সরকারী উদ্যোগে। ফলে এই রোগ নিয়ে হাহাকার, আহাজারি ও হতাশাই শুধু দৃশ্যমান। দেশে ক্যান্সারের এতো বিস্তার এবং এতো রোগী থাকা সত্বেও আজো দু’একটি ভালো ক্যান্সার হাসপাতাল গড়ে ওঠেনি বিভাগীয় নগরীগুলোতে। যে ক’টি ক্যান্সার হাসপাতাল বা ক্যান্সার চিকিৎসা কেন্দ্র আছে দেশে, এর প্রায় সবগুলোই রাজধানীতে। তাই বিভিন্ন জেলা ও জেলার প্রত্যন্ত এলাকার রোগীদের চিকিৎসার জন্য রাজধানীতে না এসে উপায় নেই। আর এতে যাতায়াত ও থাকার জন্য যে ব্যয় হচ্ছে, তা চিকিৎসা ব্যয়কে অনেক বাড়িয়ে দিচ্ছে। অথচ প্রতিটি জেলায় না হোক, প্রতিটি বিভাগে একটি ভালো ও উন্নতমানের ক্যান্সার হাসপাতাল থাকলে, রোগী ও তার স্বজনদের অর্থ ও সময়ের অনেক সাশ্রয় হতো। সামগ্রিক চিকিৎসা ব্যয় অনেক কমে আসতো। যাদের যথেষ্ট আর্থিক সক্ষমতা নেই, সেই সব রোগীদের ভালো ও উন্নত চিকিৎসার আশা বাদ দিয়ে স্থানীয়ভাবে চিকিৎসার ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে কিংবা প্রায় বিনা চিকিৎসায় ধুঁকে ধুঁকে প্রাণ হারাতে হচ্ছে।
একথা অনস্বীকার্য যে, ক্যান্সার যেমন একটি জটিল রোগ তেমনি এর চিকিৎসাও অত্যন্ত ব্যয়বহুল। দেখা গেছে, অতীতে কারো ক্যান্সার ধরা পড়লে নিকটজনরা রোগীর মায়ায় কেঁদে কেটে হয়রান হতেন। এখন রোগীর মায়ায় যতোটা কাঁদেন, তার চেয়ে বেশী কাঁদেন কীভাবে চিকিৎসা করাবেন, সে কথা ভেবে। কারণ ক্যান্সারের ব্যয়বহুল চিকিৎসা করাতে গিয়ে অনেক পরিবার সহায় সম্পদ এমনকি ভিটেমাটি পর্যন্ত বিক্রয় করতে হচ্ছে। অনেককে ভিটে মাটি হারানোর পর হাত পাততে হচ্ছে মানুষের কাছে। পরিবারের একজনের এই রোগ হলে তার চিকিৎসা ও পথ্যের ব্যয় মেটাতে গিয়ে বাকী সদস্যদের খাদ্যাভাব দেখা দিতে দেখা যাচ্ছে। বর্তমানে সীমিত আয়ের পরিবারগুলো এমনিতেই মারাত্মক খাদ্য সংকটে আছে। এ অবস্থায় কোন সদস্যের ক্যান্সার হলে, তাদেরকে দ্রুত দারিদ্র্যসীমার নীচে চলে যেতে দেখা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে পরনির্ভরশীল হয়ে পড়তে, হয়ে পড়তে ঋণগ্রস্ত।
এ অবস্থায় সবচেয়ে জরুরী হচ্ছে, ক্যান্সার প্রতিরোধে যথাসম্ভব সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ। প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ অধিক গুরুতত্বপূর্ণ ও কার্যকর এক্ষেত্রে। এজন্য খাবার দাবার ও জীবনযাপন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা জরুরী। ধূমপান, জর্দা ও সাদাপাতা সেবন থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। রোগ ধরা পড়লে বিলম্ব না করে চিকিৎসার চেষ্টা করা উচিত। ব্যয়বহুল এলোপ্যাথিক চিকিৎসা সম্ভব না হলে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাসহ অন্যান্য বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতির আশ্রয় নেয়া উচিত। এতে ব্যয় যেমন কম হবে, তেমনি দীর্ঘকাল রোগকে প্রতিরোধ ও প্রশমিত করা সম্ভব হবে। উপযুক্ত বিকল্প চিকিৎসা পেলে রোগীও সক্ষম অবস্থায় দীর্ঘায়ু হতে পারবেন।
অনেকে ক্যান্সার রোগীদের সহায়তার জন্য সরকারী উদ্যোগে একটি ফান্ড গঠনের পরামর্শ দিয়েছেন। আমরা এ প্রসঙ্গে ক্যান্সারের অন্যতম প্রধান কারণ ধূমপানসহ সব ধরনের ট্যোবাকো গ্রহণ ও মদ্যপান থেকে বিরত থাকার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আহবান জানাচ্ছি। একই সঙ্গে এ বিষয়ে সরকারী পর্যায়ে একটি দীর্ঘমেয়াদী ক্যান্সার প্রতিরোধক ও প্রতিকারমূলক পরিকল্পনা গ্রহণের আহবান জানাচ্ছি, যার মধ্যে ট্যোবাকো ও মদ্য বিপণন ও বিক্রয়ে নিষেধাজ্ঞা থাকা অতীব গুরুত্বপূর্ণ বলে আমরা মনে করি।