ডিজিটাল হুন্ডির মাধ্যমে হাজার কোটি টাকা পাচার
প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ মে ২০২৩, ৮:৩০:৪৪ অপরাহ্ন
জালালাবাদ ডেস্ক: মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) বা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের এজেন্ট ব্যবসার আড়ালে বিদেশে অর্থ পাচার হচ্ছে। এক্ষেত্রে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে বিকাশ, নগদ, রকেটের মতো মোবাইল ব্যাংকিং। এই চ্যানেল ব্যবহার করে ডিজিটাল হুন্ডির মাধ্যমে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে বিদেশে।
দেশে বর্তমানে বিকাশ, নগদ, রকেট, উপায়, ইউক্যাশ, মাইক্যাশ, এমক্যাশ, শিওরক্যাশসহ ১৩টি এমএফএস প্রতিষ্ঠান সেবা দিচ্ছে। গ্রাহক সংখ্যা ১১ কোটির বেশি। আর ১১ লাখের বেশি এসব এমএফএস প্রতিষ্ঠানের এজেন্ট সংখ্যা। বর্তমানে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে গড়ে দৈনিক ২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা লেনদেন হয়।
২০১০ সালে মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। পরের বছরের ৩১ মার্চ ডাচ-বাংলা ব্যাংকের ‘রকেট’ দিয়ে এমএফএস সেবা শুরু হয়। এরপর ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ‘বিকাশ’ চালু হয়। বর্তমানে এমএফএস সেবার বড় অংশই বিকাশের দখলে।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) বলছে, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের এজেন্ট ব্যবসার আড়ালে বিদেশে অর্থপাচার হচ্ছে। বিকাশ, নগদ, রকেট ও উপায়সহ বিভিন্ন এমএফএসের অন্তত পাঁচ হাজার এজেন্ট হুন্ডি চক্রে জড়িত।
মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহার করে হুন্ডির আড়ালে অর্থ পাচারের অভিযোগে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ১৬ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। তখন সংবাদ সম্মেলন করে সিআইডি জানায়, বিকাশ, নগদ, রকেট ও উপায় ব্যবহার করে এক বছরে ৭৫ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ ৭ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার পাচার করেছে হুন্ডি ব্যবসায়ীরা।
সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখন নানান পন্থায় বিদেশে অর্থপাচার হচ্ছে। এরই মধ্যে কিছু মাধ্যম শনাক্তও করেছে সিআইডি। বর্তমানে অর্থপাচারের একটি মাধ্যম হুন্ডি। এমএফএস বা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের এজেন্ট ব্যবসার মাধ্যমে বিদেশে বিপুল টাকা পাচার হচ্ছে।
সিআইডির একজন কর্মকর্তা বলেন, মোবাইল ব্যাংকিং বিদেশে অর্থ পাচারে একটি মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে হুন্ডির মাধ্যমে পাঠানো টাকার অঙ্ক খুব বেশি না হলেও মোট হিসাবে তা অনেক বড়ো অঙ্ক। গড়ে উঠেছে অনেক সিন্ডিকেট। আর তা নিয়ন্ত্রণ করছে দেশের বাইরে থাকা অবৈধ কারবারিরা।
সিআইডি’র অর্গানাইজড ক্রাইমের ডিআইজি কুসুম দেওয়ান বলেন, ‘মানি লন্ডারিংয়ের কোনো অভিযোগ পেলেই আমরা তা জোরালোভাবে অনুসন্ধান করি। যাদের বিরুদ্ধেই অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যাচ্ছে, আমরা মামলা করছি। যেসব বিষয় আমাদের নজরে আসছে আমরা অনুসন্ধান করছি। এতে সত্যতা বা সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া গেলে আমরা নিয়মিত মামলা করছি। এক্ষেত্রে কাউকে ছাড় দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক, সিআইডি, বিএফআইইউ প্রতিনিয়ত নজরদারি করছে। বিকাশসহ কারও বিরুদ্ধে অনিয়ম পেলে আমরা অনুসন্ধান করি। যদি ঘটনা সত্য হয় আমরা সরাসরি মামলা করি এবং আইনানুগ ব্যবস্থা নিই।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে পাঠানো কিছু এমএফএস গ্রাহকের অনিয়ম নিয়ে কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন সিআইডির ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিটের বিশেষ পুলিশ সুপার বাছির উদ্দিন।
তিনি বলেন, ‘হুন্ডি, অর্থ পাচারসহ বিধিবহির্ভূত লেনদেনে জড়িত মার্চেন্ট হিসাব ও এজেন্ট অসংখ্য। বিকাশের বেশকিছু গ্রাহকের বিধিবহির্ভূত লেনদেনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এসব হিসাব খোলার ক্ষেত্রে যাদের সংশ্লিষ্টতা ছিল, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো এক প্রতিবেদনে সিআইডি বলেছে, এমএফএস নিয়মের বাইরে বিকাশের কিছু মার্চেন্ট এজেন্ট খোলা হয়েছে। এসব হিসাব বিকাশ এজেন্ট পয়েন্টে চালু রেখে তাতে বিধিবহির্ভূত লেনদেন করা হয়েছে। বিকাশ কর্তৃপক্ষ অর্থ পাচার বিধিমালা অনুযায়ী গ্রাহকের বিষয়ে যথাযথ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। বিকাশের কিছু মার্চেন্ট হিসাবে লেনদেনে ব্যাপক অসঙ্গতি পাওয়া গেছে। সিআইডি ওইসব মার্চেন্ট হিসাব ও এজেন্টের নিবন্ধন বাতিলের সুপারিশ করে।
পাশাপাশি যেসব ডেইলি সেলস অফিসার (ডিএসও) অভিযুক্ত মার্চেন্ট হিসাবগুলো খুলে দিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধেও বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করে। একই সঙ্গে যেসব এজেন্ট পয়েন্ট ওই মার্চেন্ট হিসাবগুলো রেখে বিধিবহির্ভূতভাবে লেনদেন করেছে, তাদের এজেন্টশিপ বাতিল, নিবন্ধনদাতা ডিস্ট্রিবিউটরের ডিস্ট্রিবিউটরশিপ বাতিলের কথা বলা হয়। অর্থ পাচার বিধিমালা অনুযায়ী গ্রাহকের বিরুদ্ধে যথাযথ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে সিআইডি।
এই প্রতিবেদনে উদাহরণ হিসেবে বলা হয়, ঢাকার আশুলিয়ায় মোল্লা ডেকোরেটর অ্যান্ড টেলিকমের নামে খোলা মার্চেন্ট হিসাবটি ব্যবহার করেন বিকাশ এজেন্ট মো. রাজু আহম্মেদ। নিজের এজেন্ট পয়েন্টে মার্চেন্ট হিসাবে লেনদেন করেন তিনি। অপর একটি মার্চেন্ট অ্যাকাউন্ট খোলা হয় চট্টগ্রামের প্রতিষ্ঠান টু স্টার পোল্ট্রি অ্যান্ড সেলস সেন্টারের নামে। সেই মার্চেন্ট হিসাবটি উদ্ধার করা হয়েছে পার্শ্ববর্তী বিকাশ এজেন্ট পয়েন্ট বায়েজিদ কুলিং কর্নার অ্যান্ড টেলিকম থেকে। সেখানে ক্যাশ আউট করতে আসা গ্রাহকদের কাছ থেকে মার্চেন্ট হিসাবে পেমেন্ট নেওয়া হতো, যা বিধিসম্মত নয়।
এমএফএস বা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের আড়ালে অর্থ পাচারের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, ‘মানি লন্ডারিং আইন অনুযায়ী মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়মিত আমাদের কাছে অস্বাভাবিক লেনদেনের রিপোর্ট করে থাকে। কেউ যদি বৈধ জিনিসকে অবৈধভাবে ব্যবহার করে সেটা ওই ব্যক্তির সমস্যা; সিস্টেমের না।’
উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘ব্যাংক অ্যাকাউন্টের চেক কেটেও তো অনেকে অবৈধ লেনদেন করতে পারেন। সেক্ষেত্রে ওই ব্যক্তিকে আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হয়।’
‘মোবাইল ব্যাংকিংয়ে হঠাৎ যদি কোনো অ্যাকাউন্টে অতিমাত্রায় লেনদেন দেখা যায় তাৎক্ষণিক বিএফআইইউকে অবহিত করা হয়। এরপর তারা সিআইডিকে অনুসন্ধান করতে বলে। এরপরই আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’
বিকাশের হেড অব করপোরেট কমিউনিকেশনস বিভাগের প্রধান শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম বলেন, ‘আমরা কোনোভাবেই চাই না আমাদের নেটওয়ার্ক মানি লন্ডারিং বা কোনো অবৈধ কাজে ব্যবহৃত হোক। বিকাশের বিশেষ একটি বিভাগ রয়েছে, যারা এরকম সন্দেহজনক লেনদেন মনিটরিং করে কোনো তথ্য পেলে বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত করে। তারা সে অনুযায়ী তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেসব অভিযান চালায়, সেগুলো আমাদের দেওয়া তথ্য এবং সহযোগিতায় চালানো হয়।’