সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ তলানিতে
প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ মে ২০২৩, ১২:৩১:০১ অপরাহ্ন
জালালাবাদ ডেস্ক: নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে জীবনযাত্রার মান ঠিক রাখতে হিমশিম খাচ্ছে স্বল্প ও মধ্য আয়ের মানুষ। সবচেয়ে বেশি বিপাকে সীমিত আয়ের মানুষেরা। খরচ বাড়ায় সঞ্চয়ে টান পড়েছে সাধারণ মানুষের। অনেকেই এখন সঞ্চয় ভেঙে সংসার খরচ মেটাচ্ছেন। ফলে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ তলানিতে ঠেকেছে। এ অবস্থায় যারা সঞ্চয়পত্র ভাঙছেন তাদের সুদ আসল পরিশোধেই বাড়তি চাপে পড়েছে সরকার।
জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) ৬২ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। আর সরকার এ খাতে মোট পরিশোধ করেছে ৬৬ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ, নয় মাসে আরও চার হাজার ১৬১ কোটি টাকা সরকারি কোষাগার বা ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে অতিরিক্ত পরিশোধ করতে হয়েছে সরকারকে। এই সময়ে সঞ্চয়পত্র বিক্রির টাকা দিয়ে গ্রাহকদের আগে বিনিয়োগ করা সঞ্চয়পত্রের সুদাসল পরিশোধ করাও সম্ভব হয়নি।
গত মার্চ মাসে মোট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয় ছয় হাজার ৭৯৫ কোটি টাকার। তবে সরকারকে মূল ও মুনাফা বাবদ পরিশোধ করতে হয়েছে সাত হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ, সঞ্চয়পত্র বিক্রির চেয়ে পরিশোধ হয়েছে ৬৫২ কোটি টাকার বেশি। গত বছরের একই সময়ে (২০২২ সালের মার্চ) নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ ছিল এক হাজার ৮১৫ কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘাটতি মেটাতে সঞ্চয়পত্র থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল সরকার। এ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে প্রথম ছয় মাসে এ খাত থেকে কোনো ঋণ পায়নি।
চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে ৫০ হাজার ৩৮০ কোটি টাকার বেশি এবং বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের পরিমাণ এক হাজার ৯৮০ কোটি টাকা। উক্ত সময়ে সরকারের নিট ব্যাংকঋণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫২ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা। গত অর্থবছরেও ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে বড় অংকের ঋণ ছিল। গত ২০২১-২০২২ অর্থবছরে সরকারের ব্যাংকঋণ নেওয়ার পরিমাণ ছিল ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা।
মূলত সঞ্চয়পত্র বিক্রির চাপ কমাতে ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে মুনাফার ওপর উৎসে কর ৫ থেকে বাড়িয়ে করা হয় ১০ শতাংশ। সঙ্গে এক লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে টিআইএন সনদ বাধ্যতামূলক, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট না থাকলে সঞ্চয়পত্র বিক্রি না করার শর্তসহ বেশ কিছু শর্ত দেওয়া হয়। এরপরও বিক্রি বাড়ছিল। তবে সবশেষ ২০২১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ২ শতাংশ কমিয়ে দেওয়া হয়। এরপরই ভাটা পড়তে থাকে বিক্রিতে।
সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ না পাওয়ায় ব্যাংকমুখী হয়েছে সরকার। ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের পরিমাণ বেড়েছে। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের বাজেট ঘাটতি পূরণে এক লাখ ছয় হাজার ৩৩৪ কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য রয়েছে। আগের অর্থবছরে সরকারের ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ছিল ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা। অর্থাৎ, চলতি অর্থবছরে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা বেশি ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য রয়েছে।
সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকরা বলছেন, একসময় মধ্যবিত্ত পরিবারের আস্থার জায়গা ছিল সঞ্চয়পত্র। চাকরি থেকে অবসরের পর পাওয়া অর্থ বা বাড়তি টাকা থাকলে সেগুলো সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করতেন। এখন সঞ্চয়পত্রে কিছুটা কড়াকড়ি রয়েছে। সরকার সুদহারও কমিয়েছে। এসব কারণে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে নেমেছে ধস।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সীমিত আয় ও প্রান্তিক আয়ের মানুষ মূলত সঞ্চয় করেন। সংকটকালীন সময়ে নিরাপত্তার কথা ভেবেই নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ সঞ্চয় করেন। কিন্তু এখন যাদের সঞ্চয়পত্রের মেয়াদ শেষ হচ্ছে তারা আর নতুন করে বিনিয়োগ বা ক্রয় করছেন না। এর কারণ উচ্চ মূল্যস্ফীতির জন্য জনগণের ব্যয় বেড়েছে। এর বিপরীতে আয় বাড়েনি। মূল্যস্ফীতির কারণে আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছে। ফলে এই কঠিন অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকার জন্য মানুষ তাদের জমানো অর্থ ব্যয় করছে। এগুলো সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে যাওয়ার বড় কারণ।
এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, কয়েকটি কারণে সঞ্চয়পত্র থেকে আগ্রহ হারাচ্ছে মানুষ। এর মধ্যে রয়েছে শর্তারোপ করা। এখন পাঁচ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে আয়কর রিটার্নের স্লিপ জমা দিতে হয়। এতে অনেকেই এ ঝামেলায় যেতে চাচ্ছেন না। আবার মানুষের হাতে এখন টাকা কমেছে। সংসার চালাতে তারা সঞ্চয়ে হাত দিচ্ছেন। আবার সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ সীমা কমিয়ে আনা হয়েছে, এটাও একটি কারণ। এসব কারণে সঞ্চয়পত্র থেকে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।