শ্রম আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে শ্রমিক নিয়োগের অভিযোগ
প্রকাশিত হয়েছে : ২৭ মে ২০২৩, ১০:০৫:৫৩ অপরাহ্ন
স্টাফ রিপোর্টার: ঢাকার প্রথম শ্রম আদালত কর্তৃক ইস্যুকৃত শোকজ (কারণ-দর্শানোর) নোটিশের জবাব না দিয়ে এবং সংশ্লিষ্ট অন্তর্র্বতীকালীন নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে নতুন করে শ্রমিক নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে বহুজাতিক গ্যাস উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠান শেভরন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। যে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তাদের বিরুদ্ধেও একই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ রয়েছে। শেভরন বাংলাদেশ ব্লক টুয়েলভ লিমিটেড এবং শেভরন বাংলাদেশ ব্লকস থার্টিন এন্ড ফরটিন লিমিটেড নামে বাংলাদেশে এর কার্যক্রম। কোম্পানির উৎস দেশ হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
আদালতের স্থগিতাদেশ অমান্যকরে যে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তা গত ২৩ ও ২৫ মে ঘটেছে বলে সংশ্লিষ্ট প্রত্যক্ষদর্শী এবং প্রাপ্ত কিছু নিয়োগপত্রের কপি পর্যালোচনায় দেখা গেছে। এভাবে ড্রাইভার এবং কুক ও সহকারী কুক পদে ২২ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান প্রপার্টি কেয়ার বাংলাদেশ প্রাইভেট লিমিটেডের (পিসিএস) মাধ্যমে এই নিয়োগ দেওয়া হয়। নিয়োগ প্রাপ্তরা গত ২৫ মে বিকালে বিবিয়ানা ও সিলেট গ্যাসফিল্ডে কাজে যোগদান করেছে। শেভরন এবং পিসিএস-উভয়ের বিরুদ্ধে আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, যা গত ১৬ মে আদালত ঘোষণা দেন। তখন উভয় কোম্পানির আইনজীবীরা আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
সংশ্লিষ্ট মামলার বাদী-শ্রমিক সূত্রে জানা গেছে, ঢাকার প্রথম শ্রম আদালতের চেয়ারম্যান (বিচারক) মো: শওকত আলী গত ১৬ মে ছয়টি চলমান মামলায় দাখিল করা পৃথক-পৃথক দরখাস্ত শুনানি শেষে শেভরন বাংলাদেশ ব্লকস থার্টিন এন্ড ফরটিন লিমিটেড এবং প্রপার্টি কেয়ার বাংলাদেশ প্রাইভেট লিমিটেড (পিসিএস) নামক ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এই মর্মে কারণ-দর্শাতে আদেশ দেন যে মামলার বাদী-শ্রমিকদের সংশ্লিষ্ট দরখাস্ত নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত পিসিএস সহ সকল ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কিংবা সরাসরি শেভরন কর্তৃক ড্রাইভার কিংবা সংশ্লিষ্ট অন্যপদে শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া কেন বে-আইনি ঘোষণা করা হবে না। একই সঙ্গে উক্ত কারণ-দর্শানো নোটিশের জবাব প্রাপ্তি এবং সংশ্লিষ্ট দরখাস্ত শুনানি না হওয়া পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট সকল পদে নিয়োগ কার্যক্রমের উপর স্থগিতাদেশ বজায় থাকবে বলে আদালত আদেশ দেন। ৩০ এপ্রিল কোম্পানি শতাধিক শ্রমিককে বে-আইনিভাবে টার্মিনেট করার পর ৩ মে আবার একাধিক নতুন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। এটি ১৬ মে আদালতের নজরে আনা হলে স্থগিতাদেশ জারী হয়। ওইদিন বাদী-শ্রমিকদের পক্ষে দাখিলকৃত দরখাস্তের উপর শুনানি করেন বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের এডভোকেট ড. উত্তম কুমার দাস। শুনানিতে শেভরন নিযুক্ত আইনজীবী নাইম আহমেদ ও মামুন চৌধুরী এবং পিসিএস নিযুক্ত আইনজীবী মোহাম্মদ সিরাজ প্রমুখ অংশ নেন। এছাড়া শুনানিকালে কোম্পানির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
১৬ মে’র নিষেধাজ্ঞা-আদেশের সার্টিফাইডকপি ও নোটিশ শেভরন এবং পিসিএস দপ্তরে বিগত ২১ মে সকালে সংশ্লিষ্ট আদালতের রেজিস্ট্রি শাখা থেকে বিতরণ করা হয় এবং পরে তা কার্যকর হয়। গত ২৩ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল সময়ে শেভরন বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ পিসিএস নামক ঠিকাদারের মাধ্যমে ১২৭ জন ড্রাইভার ওয়েটার, কুক, সহকারী কুক-কে বে-আইনিভাবে টার্মিনেট করেছে তাদের চলমান যে মামলা তার মধ্যে ছয়টিতে দরখাস্ত দাখিল করা হয়। যার কারণ-দর্শানোর কোন জবাব শেভরন কিংবা পিসিএস গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট আদালতে দাখিল করেনি।
একই সঙ্গে চাকুরীচ্যুতদের মধ্যে ৯৫ জন শ্রমিকের পক্ষে তাদের চলমান মামলায় গত ২৩ মে যে সকল দরখাস্তদাখিল করা হয় তার প্রেক্ষিতে শ্রমিকদের গণ-টার্মিনেশনকে কেনবে-আইনিও আইনগত কর্তৃত্ববিহীন বলে ঘোষণা করা হবে না ঢাকার প্রথম শ্রম আদালত সেই মর্মে শেভরন বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ এবং পিসিএসকে (অন্যঅন্যঠিকাদারকে) কারণ-দর্শাতে পৃথক-পৃথকভাবে নির্দেশ দিয়েছেন। এর জন্য সংশ্লিষ্টদের দু’সপ্তাহ সময় দেওয়া হয়েছে; যার পরবর্তী শুনানির ধার্যদিন হল আগামী ১৩ জুন। এছাড়া একই আদালত তাঁর ১৮ মে’র পৃথক অন্তর্র্বতীকালীন আদেশ বলে শেভরনে কুক ও সহকারী কুক পদে সরাসরি কিংবা কোন ঠিকাদারের মাধ্যমে নিয়োগের উপরও স্থগিতাদেশ দিয়েছেন।
এই বিষয়ে ভুক্তভোগী শ্রমিক ও সদ্যচাকরিচ্যুত মো. আতিয়ার রহমান জানান, দীর্ঘ ১২ থেকে ২৪ বছর ধরে শেভরনের অধীন এর ঢাকাস্থ প্রধান কার্যালয় এবং সিলেট, বিবিয়ানা ও মৌলভিবাজার গ্যাস ক্ষেত্রে (ফিল্ড) কর্মরত ড্রাইভার, ওয়েটার, কুক, সহকারীকুক ও অন্যান্য পদের প্রায় দু’ হাজার শ্রমিক-কর্মচারীর চাকরিকে দীর্ঘদিনেও শেভরন স্থায়ী করেনি। তাঁরা প্রায় একযুগ ধরে বেতন-ভাতা বৃদ্ধি থেকে বঞ্চিত এবং নানাভাবে নির্যাতিত ও নিগ্রহিত। শ্রমআইনের বিধানমতে সংশ্লিষ্টপদে চাকুরীর তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের চাকরিস্থায়ী হয়েছে। যার বাস্তবায়নে শেভরন আইনগত ভাবে বাধ্য বলে সংশ্লিষ্ট শ্রম আইন বিশেষজ্ঞরা জানান। তাঁরা কোম্পানির লভ্যাংশও পাবেন। কিন্তু শেভরন দীর্ঘসময়েও তাদের স্থায়ী শ্রমিক হিসেবে নিয়োগপত্র, সার্ভিস বুক কিংবা কোম্পানির মুনাফার কোন অংশ দেয়নি। একারণে প্রায় চারশ’ শ্রমিক পৃথক-পৃথক ভাবে ঢাকার প্রথম শ্রম আদালতে মামলা করেছেন বলে আরেক শ্রমিক মুসফেক উসসালেহীন (পাভেল) জানান। এতে শেভরন বাংলাদেশ এবং এর প্রেসিডেন্টকে ১ ও ২ নং বিবাদী করা হয়; এবং অন্যবিবাদীরা হলেন- কথিত ঠিকাদারপ্রতিষ্ঠান পিসিএস, অয়ন এন্টারপ্রাইজ কিংবা সেন্ট্রি সিকিউরিটি সার্ভিসেস লিঃ (এসএসএসএল) ইত্যাদি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এবং বাংলাদেশ শ্রম বিধিমালা ২০১৫ এর বিধান হলো- কোন প্রতিষ্ঠানে কোন স্থায়ী পদের বিপরীতে কোন ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শ্রমিককে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। আর কোন পদের বিপরীতে কোন শ্রমিক ১৮০ (একশত আশি) দিন কিংবা তার বেশী সময় ধরে নিয়োজিত থাকলে তা উক্ত প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে মূলকাজ ও স্থায়ীকাজ (চাকরি) বলে গণ্য হবে (বিধি ১৮, শ্রমবিধিমালা, ২০১৫, যা ২০২২ সনে সংশোধিত হয়)। কিন্তু শেভরন কর্তৃপক্ষ এই বিধানকে ক্রমাগত ভাবে লঙ্ঘন করে চলেছে; যা শ্রম আইনের আওতায় দ-নীয় অপরাধ। শেভরনে যারা কাজ করেছে তাদের চাকরির বয়স কোন প্রকার বিরতি ছাড়া এবং নিরবচ্ছিন্ন, যা ১২ থেকে ২৪ বছর পর্যন্ত।
জানা গেছে, শ্রম আইনে ঠিকাদারের মাধ্যমে শ্রমিক নিয়োগ করার যে বিধান তা চালু হয় ২০১৫ সনের ১৫ সেপ্টেম্বর। এর অন্যতম শর্ত হলো যে সরকার থেকে শ্রম আইনের আওতায় রেজিস্ট্রেশন ব্যতিত কোন ঠিকাদারপ্রতিষ্ঠান শ্রমিক সরবরাহ করতে পারবে না (৩ক ধারা)। কিন্তু উক্ত পিসিএস এবং এসএসএসএল’র সঙ্গে শেভরন যখন কথিত আউটসোর্সিং চুক্তি স্বাক্ষর করে তখন তাদের (ঠিকাদার) প্রয়োজনীয় রেজিস্ট্রেশন ছিলো না। ২০১৫ সনের ১৫ সেপ্টেম্বরের আগে শেভরনের মতো কোন বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কোন ঠিকাদার কিংবা তৃতীয়পক্ষের মাধ্যমে শ্রমিক নিয়োগ দেওয়ার কোন আইনি সুযোগ ছিলো না। আর আউটসোর্স প্রথা কেবলমাত্র সরকারী প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রযোজ্য।
অভিযোগ রয়েছে, ২০০৩/২০০৪ সালে শেভরনের পূর্বসূরি অক্সিডেন্টাল কিংবা ইউনোকল বাংলাদেশ কিংবা ২০০৫/২০০৬ সন থেকে শুরু করে ২০১৫ সনের পূর্বে এবং সরাসরি শেভরনের অধীন চাকরিতে যোগদানকরা শ্রমিকদেরকেও এখন ঠিকাদারের শ্রমিক বানানোর অপচেষ্টা চালাচ্ছে শেভরন কর্তৃপক্ষ। এ ব্যাপারে চাকরিচ্যুতও ভুক্তভোগী শ্রমিকরা প্রতিবাদ করেও কোন প্রতিকার পাননি বলে অভিযোগ করেছেন। এই বিষয়ে সরকারের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর, শ্রমমন্ত্রণালয়, জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ভুক্তভোগী শ্রমিকরা স্মারকলিপি দিয়েছেন।
জালালাবাদ গ্যাস ক্ষেত্রে চাকরিচ্যুত ড্রাইভার রাজু সিংহ। তিনি বলেন, শ্রম আদালতে তাঁর মামলা চলমান থাকাবস্থায় গত ৩০ এপ্রিল একটি ক্ষুদেবার্তার (এসএমএস) মাধ্যমে তাকে চাকুরি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার (টার্মিনেশন)কথা জানানো হয়। তবে এই আদেশ আইনসংগত নয় বলে জানা গেছে। কেন তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে (শেভরন) রাজু জানতে চাইলেও তাদের কাছ থেকে কোনো সদুত্তর পাননি তিনি।
রাজু সিংহ জানান, বৃহস্পতিবার (২৫ মে) বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে সিলেটের জালালাবাদ গ্যাস ফিল্ডে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পিসিএস’র (তৃতীয়পক্ষ) মাধ্যমে কয়েকজনকে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে বলে তিনি খবর পান। পরে তিনি গ্যাসফিল্ডের ফটকে গিয়ে কয়েকজনকে দেখতে পান। সেসময় তাদের হাতে ২৩ ও ২৫ মে ২০২৩ তারিখ ইস্যুকরা নিয়োগপত্র ছিল। যা পিসিএস থেকে ইস্যুকরা; স্বাক্ষর করেন সিনিয়র মানব সম্পদ ম্যানেজার। তবে উক্ত নিয়োগপত্রে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে যে নিযুক্তব্যক্তি শেভরন বাংলাদেশ ব্লকস থার্টিন এন্ড ফরটিন লিঃ এর জন্য নিযুক্ত হলেন।
তিনি আরো বলেন, আদালতের নির্দেশনা অমান্য করে তাদেরকে নতুন করে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তিনি বিষয়টি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি রাম বাহাদুরকে অবহিতকরেন। এ সময় আদালতের নির্দেশনার কপিও তিনি প্রদর্শনকরেন।
রাজুর মতো শেভরন বাংলাদেশের অধীন তিনটি গ্যাসপ্ল্যান্ট- জালালবাদ গ্যাসপ্ল্যান্ট, মৌলভীবাজার গ্যাসপ্ল্যান্ট এবং বিবিয়ানা গ্যাসপ্লান্টে বিভিন্ন পদে কর্মরত এবং সম্প্রতি অব্যাহতি প্রাপ্ত ১২৭ জন শ্রমিক-কর্মী পূর্বেই আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন। মোট মামলা দায়েরকারী শ্রমিকের সংখ্যা চারশ’র বেশী হবে বলে জানা গেছে।