কঠিন সময়ে ঘাটতির বাজেট
প্রকাশিত হয়েছে : ০১ জুন ২০২৩, ১১:০৬:৩৬ অপরাহ্ন
সংসদে ৭ লাখ ৬১ হাজার কোটির বাজেট পেশ
রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য ৫ লাখ কোটি
ঘাটতি ২ লাখ ৬১ হাজার কোটি
প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৭.৫ শতাংশ
এটি স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের বাজেট : অর্থমন্ত্রী
জালালাবাদ রিপোর্ট : দেশের অর্থনীতি নানামুখী চাপে। ডলারের সংকট এখনো কাটেনি। পণ্য আমদানির জন্য ঋণপত্র খুলতে গেলে কোনো কোনো ব্যাংক ফিরিয়ে দিচ্ছে। আবার রপ্তানি আয় তুলতে গেলেও সহজে দিচ্ছে না। শুধু তাই নয়, প্রায় প্রতিটি নিত্যপণ্যের দামই বাড়তি। এমন কঠিন অবস্থায় আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ ধরা হয়েছে ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫.২ শতাংশ।
গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে এ বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী। এবারের বাজেটের শ্লোগান হলো ‘উন্নয়নের অভিযাত্রায় দেড় দশক পেরিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের অভিমুখে’। এটি দেশের ৫২তম, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের ২৪তম ও অর্থমন্ত্রী হিসেবে আ হ ম মুস্তফা কামালের পঞ্চম বাজেট।
প্রস্তাবিত বাজেটের যে আকার ধরা হয়েছে, তা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১৫.২ শতংশ। পরিচালনসহ অন্যান্য খাতে ৪ লাখ ৩৬ হাজার ২৪৭ কোটি এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।
রাজস্ব আয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৫ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাধ্যমে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি এবং অন্যান্য উৎস হতে ৭০ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
প্রস্তাবিত বাজেটে মোট ঘাটতির মধ্যে ১ লক্ষ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ উৎস হতে এবং ১ লক্ষ ২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা বৈদেশিক উৎস হতে নির্বাহ করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে।
প্রস্তাবিত বাজেটে সরকারের ব্যাংক ঋণ নির্ভরতা আরও বাড়ছে। আসন্ন বাজেটের ঘাটতি পূরণে এক লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ নেবে বলে লক্ষ্য ঠিক করেছে সরকার। এ অঙ্ক চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২৬ হাজার ৬১ কোটি টাকার বেশি। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে এক লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য রয়েছে সরকারের। সে হিসাবে আগামী অর্থবছরে ব্যাংক-ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ চলতি বছরের চেয়ে ২৪ শতাংশ বেশি বাড়বে। অর্থাৎ বাজেটের অর্থের জোগান পেতে সরকার আগের চেয়ে বেশি ব্যাংকমুখী হচ্ছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ব্যাংক-ব্যবস্থা থেকে সরকারের বেশি ঋণ নেওয়া দুই কারণে খারাপ। বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে বেসরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা কমে যায়। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নিলে মূল্যস্ফীতির ওপর প্রভাব পড়ে, যার ভুক্তভোগী হন ভোক্তারা অর্থাৎ সাধারণ মানুষ।
প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৭.৫ শতাংশ, মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশ : আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ নির্ধারণ করেছে সরকার। গত বছরেও জিডিপির প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা একই ছিল। সংসদে অর্থমন্ত্রী জানান, আগামী অর্থবছরে (২০২৩-২৪) আমরা উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরে আসব এবং ৭ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারব বলে আশা করছি।’
চলতি অর্থবছরেও জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ। তবে সাময়িক হিসেবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার কমে ৬ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ হিসাব করা হয়।
এদিকে গত এপ্রিল মাসে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এক পূর্বাভাসে জানিয়েছিল, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৬ শতাংশ হতে পারে।
মাথাপিছু আয়ের লক্ষ্যমাত্রা সাড়ে ১২ হাজার ডলার : স্মার্ট বাংলাদেশে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মাথাপিছু আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১২ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার।
অর্থমন্ত্রী বলেন, “আমাদের ‘স্মার্ট বাংলাদেশে’ মাথাপিছু আয় হবে কমপক্ষে ১২ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার। দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকবে ৩ শতাংশের কম মানুষ আর চরম দারিদ্র্য নেমে আসবে শূন্যের কোঠায়।
বাজেট ঘাটতি থাকবে জিডিপির ৫ শতাংশের নিচে। রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত হবে ২০ শতাংশের ওপরে। বিনিয়োগ হবে জিডিপির ৪০ শতাংশ।
আয় সাড়ে ৩ লাখ হলেই কর : ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে করমুক্ত আয়সীমা ৫০ হাজার টাকা বাড়িয়ে সাড়ে তিন লাখ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। আগের বাজেটে করমুক্ত আয়সীমা ছিল ৩ লাখ টাকা, এবার তা ৩ লাখ ৫০ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়।
জিডিপির তুলনায় বরাদ্দ কমেছে শিক্ষাখাতে : বিগত বছরগুলোর মতো ধারাবাহিকভাবে টাকার অংকে বাড়ছে শিক্ষা খাতের বরাদ্দ (বাজেট) ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রস্তাবিত বরাদ্দ ৬ হাজার ৭১৬ কোটি টাকা বেড়েছে। এই অর্থবছরে শিক্ষাখাতে ৮৮,১৬৩ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। টাকার অংক বাড়লেও জিডিপির তুলনায় বরাদ্দ বিগত অর্থবছরের তুলনায় কমেছে।
প্রস্তাবিত বাজেটে জিডিপি ধরা হয়েছে ৫০ লাখ ৬ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা। অর্থাৎ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে জিডিপির মাত্র ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বরাদ্দের হার ছিল ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ ও এর আগের বছর বরাদ্দ ছিল ২ দশমিক ০৮ শতাংশ। যেখানে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী শিক্ষা খাতে ৬ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলা হয়েছে।
দ্বিগুণ হচ্ছে সম্পত্তি নিবন্ধন কর : নতুন অর্থবছরে সরকারের রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বাড়াতে সম্পত্তি নিবন্ধন কর দ্বিগুণ করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
এতদিন সম্পত্তি নিবন্ধন করতে একজন নাগরিককে ৪ শতাংশ দিলেও নতুন প্রস্তাবনা কার্যকর হলে ৮ শতাংশ হারে কর দিতে হবে।
বর্তমানে যে কোনো জেলার পৌর এলাকায় জমি হস্তান্তরে ৩ শতাংশ কর দেওয়ার নিয়ম থাকলেও বর্তমানে তা ৬ শতাংশে উন্নীত করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। এছাড়া অনির্দিষ্ট সময়সূচিতে কোনো এলাকার সম্পত্তি হস্তান্তরে ১ শতাংশ করের পরিবর্তে আগামী অর্থবছরে ২ শতাংশে উন্নীত করার প্রস্তাব করেছেন মুস্তফা কামাল।
ধনীদের জন্য সুখবর : বাজেটে ধনীদের জন্য স্বস্তির খবর দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। বর্তমানে ব্যক্তি করদাতার মোট পরিসম্পদের মূল্য তিন কোটি টাকা অতিক্রম করলেই নির্ধারিত হারে সারচার্জ দিতে হয়। অর্থাৎ, তিন কোটি টাকা পর্যন্ত সম্পদ সারচার্জমুক্ত। আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে এই সীমা এক কোটি টাকা বাড়িয়ে চার কোটি টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে। এই প্রস্তাব সংসদে পাশ হলে চার কোটি টাকা পর্যন্ত সম্পদের ক্ষেত্রে কোনো সারচার্জ দিতে হবে না।
সংসদে উপস্থাপিত বাজেট অনুসারে, নীট পরিসম্পদের মূল্য চার কোটি টাকা অতিক্রম করলে ১০ শতাংশ হারে এবং ৫০ কোটি টাকা অতিক্রম করলে ৩৫ শতাংশ হারে সারসার্জ দিতে হবে।
এদিকে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটকে অর্থমন্ত্রী তার বক্তৃতায় স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে প্রথম বাজেট বলে উল্লেখ করেন।
বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেন, প্রস্তাবিত বাজেট বাস্তবায়ন হলে সকলের দোড়গোরায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে যাবে। স্বয়ংক্রিয় যোগাযোগ ব্যবস্থা, টেকসই নগরায়নসহ নাগরিকদের প্রয়োজনীয় সকল সেবা থাকবে হাতের নাগালে। স্মার্ট বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হবে সাম্য ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা। অর্থমন্ত্রী বলেন, অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তির প্রচেষ্টাকে প্রসারিত ও ত্বরান্বিত করতে আগামী অর্থবছরের মধ্যে একটি ডিজিটাল ব্যাংক স্থাপন করা হবে। এতে তৈরি হবে পেপারলেস ও ক্যাশলেস সোসাইটি।
দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে যথেষ্ট বলে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জানিয়েছেন, এখন আমাদের রিজার্ভ ২৯ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার। এ রিজার্ভ দিয়ে যা সাড়ে চার মাসের বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে।