বাজেট যেনো শোষণের হাতিয়ার না হয়
প্রকাশিত হয়েছে : ০৩ জুন ২০২৩, ১২:৩০:৪৩ অপরাহ্ন
গত ১ জুন জাতীয় সংসদে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের বাজেট পেশ করা হয়েছে। ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার এই প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ ধরা হয়েছে ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। বাজেটের এই অর্থের মধ্যে পরিচালনসহ অন্যান্য খাতে ৪ লাখ ৩৬ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা এবং বার্ষিক কর্মসূচীতে (এডিপি) ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া রাজস্ব আয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৫ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাধ্যমে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য উৎস হতে ৭০ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করা হয়েছে।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দেশের অর্থনীতি যখন নানা ধরনের চাপের মধ্যে তখন এতো বড় অংকের উচ্চাভিলাসী বাজেট প্রস্তাব কতটুকু যৌক্তিক, এ নিয়ে চিন্তাভাবনার অবকাশ রয়েছে। গত বাজেটের তুলনায় এবারের বাজেটের অর্থের পরিমাণ প্রায় ১৩ শতাংশ বেশী। কিন্তু গত এক বছরে অর্থনীতির কোন সূচকেই অগ্রগতি সাধনে সক্ষম হতে দেখা যায়নি বাংলাদেশকে। এ অবস্থায় বাজেটে বিপুল পরিমাণ ঋণ প্রস্তাবকে অনেকে ঋণ করে ঘি খাওয়ার প্রচেষ্টার সাথে তুলনা করেছেন। ঋণের ফলে পণ্যমূল্য আরো বৃদ্ধি পাবে। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি বাড়বে। এবারের বাজেটে প্রত্যক্ষ কর থেকে রাজস্ব আদায়ের পরিকল্পনা ৩৬ শতাংশ ও পরোক্ষ কর থেকে ৬৪ শতাংশ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০২২-২৩ অর্থ বছরের প্রথম ১০ মাসে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি ছিলো ৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ এবং খাদ্যপণ্য বহির্ভুত মূল্যস্ফীতি ছিলো ৮ দশমিক ৬৬ শতাংশ। এর আগে ২০২১-২২ অর্থ বছরে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। কিন্তু বাস্তবে মূল্যস্ফীতি ছিলো ৬ দশমিক ১৫ শতাংশ। এর মধ্যে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি ছিলো ৬ দশমিক ৫ শতাংশ ও খাদ্যপণ্য বহির্ভুত মূল্যস্ফীতি ছিলো ৬ দশমিক ৩১ শতাংশ। অর্থনীতিবিদদের অভিমত, প্রতি মাসে যে মূল্যস্ফীতি দেখানো হয়, বাস্তব মূল্যস্ফীতি তার চেয়ে অনেক বেশী। ২০০৫-০৬ অর্থ বছরকে ভিত্তি ধরে বর্তমানে মূল্যস্ফীতি গণনা করা হচ্ছে, এটা সঠিক নয়।
২০২৩-২৪ অর্থ বছরের বাজেটে সরকার নতুন করে এলপিজি সিলিন্ডার তৈরীর স্টিল ও ওয়েল্ডিং আমদানিতে শুল্ক বসানোর প্রস্তাব করেছে। এছাড়া যারা চুলা বাদ দিয়ে ওভেনে রান্নার কথা ভাবছেন, সেখানে বিদেশী ওভেনের আমদানি শুল্ক ৩০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৮৯ দশমিক ৩২ শতাংশ করার পরিকল্পনা রয়েছে। সবচেয়ে মারাত্মক বিষয় হচ্ছে, বিদ্যুৎ খাতেও ভর্তুকি উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে আনার কথা বলা হচ্ছে। এর ফলে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশের মধ্যে বেঁধে রাখা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে।
অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, প্রকৃত অর্থেই মূল্যস্ফীতি কমাতে হলে আলাদা পদক্ষেপ নিতে হবে। এতোদিন যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তাতে তেমন কোন সুফল পাওয়া যায়নি। বাজার ব্যবস্থাপনায় রয়ে গেছে চিরাচরিত অনিয়মগুলো। নানা ধরনের অনিয়ম তথা দুর্নীতির কারণে বাজারে বিরাজ করছে অস্থিরতা। এ অবস্থায় ঐকান্তিক আগ্রহ ও উদ্যোগ নিয়ে ব্যতিক্রমধর্মী কিছু করতে না পারলে মূল্যস্ফীতি সামাল দেয়া যাবে না।
সর্বোপরি, শুধু শুল্ক বৃদ্ধি নয়, ডলারের বিনিময় হার থেকে শুরু করে ভর্তুকি কমিয়ে দেয়া-এ ধরনের যতো পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে এতে বাজার অস্থির হয়ে ওঠবে। এসব কারণে বাজারে বাড়বে পণ্যের দাম, যার পুরো প্রভাব পড়বে ভোক্তাদের ওপরে। পরোক্ষ কর বৃদ্ধি সাধারণ জনগণের আর্থিক দুর্ভোগ সৃষ্টি করে। প্রত্যক্ষ কর বাড়িয়ে পরোক্ষ কর কমানোর যে পদক্ষেপ জরুরী, সেদিকে নজর নেই সরকারের। অথচ পরোক্ষ কর, যা সাধারণ মানুষকেই মূলতঃ প্রদান করতে হয়, তা বিত্তবান শ্রেণীর ওপর আরোপিত প্রত্যক্ষ করের চেয়ে বেশী আদায়ের প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে। এতে আর্থিক বৈষম্য শুধুই বাড়বে।
এছাড়া করযোগ্য আয় না থাকলেও জনগণকে ২ হাজার টাকা কর দিতে হবে, অন্যথায় বহু সরকারী সুযোগ সুবিধা পেতে বা কর্ম সম্পাদনে সক্ষম হবেন না এমন একটি ‘কালো আয়কর আইন’ চালু করতে যাচ্ছে সরকার। এ নিয়ে ইতোমধ্যে সোচ্চার হয়ে ওঠেছেন সচেতন মহল। বর্তমানে সাধারণ সীমিত আয়ের মানুষ যখন আয়ের সাথে ব্যয়ের সংগতি বিধানে ব্যর্থ এমনকি ধারকর্জ করে একটি বড়ো জনগোষ্ঠীকে টিকে থাকার চেষ্টা করতে দেখা যাচ্ছে, তখন তাদের ওপর ২ হাজার টাকা আয়করের বোঝা চাপিয়ে দেয়া যেমন অমানবিক তেমনি নজীরবিহীন পদক্ষেপ। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সরকার জনগণের নিকট থেকে যে কোন উপায়ে অর্থ আদায়ে স্পষ্ট কথায় অর্থ শোষণে মরিয়া। লুটপাট ও শোষণ অব্যাহত রাখতে উন্নয়নের নামে অস্বাভাবিক ঋণ গ্রহণ এবং কর আদায়ে হণ্যে হয়ে ওঠেছে তারা। বর্তমান বাজেটে এই আলামত লক্ষণীয়। আমরা এসব বিষয় পুনর্বিবেচনাসহ একটি প্রকৃত জনহিতৈষী বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট মহলের প্রতি আহবান জানাচ্ছি।