নাজিরবাজারে ঝরলো ১৪ শ্রমিকের প্রাণ : স্বজনদের আহাজারী
প্রকাশিত হয়েছে : ০৭ জুন ২০২৩, ৯:০৮:০০ অপরাহ্ন
স্টাফ রিপোর্টার : দক্ষিণ সুরমার নাজিরবাজারে ট্রাক-পিকআপ ভয়াবহ সংঘর্ষে ঝরে গেলো ১৪ নির্মাণ শ্রমিকের প্রাণ। ভয়াবহ এ দুর্ঘটনাটি ঘটে বুধবার ভোরে নাজিরবাজার এলাকার কুতুবপুর নামক স্থানে। এ ঘটনায় নিহতদের স্বজনদের আহাজারীতে ভারী হয়ে উঠে ঘটনাস্থল ও ওসমানী হাসপাতাল এলাকা। তাদের গ্রামের বাড়িতেও চলছে শোকের মাতম।
পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, সিলেট নগরের আম্বরখানা থেকে পিকআপে (সিলেট-ন ১১-১৬৪৭) করে প্রায় ৩০ জন নারী-পুরুষ নির্মাণ শ্রমিক জেলার ওসমানীনগর উপজেলার গোয়ালাবাজার যাচ্ছিলেন। সকাল সাড়ে ৫টার দিকে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের দক্ষিণ সুরমার নাজিরবাজার এলাকার কুতুবপুর নামক স্থানে পৌঁছলে মুনশীগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা সিলেটমুখী বালুবাহী ট্রাকের (ঢাকা মেট্রো-ট ১৩-০৭৮০) সঙ্গে শ্রমিক বহনকারী পিকআপের সংঘর্ষ হয়। মুখোমুখি সংঘর্ষে দুই বাহনই দুমড়ে মুচড়ে যায়। এতে ঘটনাস্থলেই ১১ জনের মৃত্যু হয়। হাসপাতালে নেয়ার পর অঅরো ৩ জনের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় গুরুতর আহত হয়েছেন অন্তত ১০ জন। হতাহতদের উদ্ধার করে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
মৃতদের সবার নাম-পরিচয় পেয়েছে পুলিশ। নিহত ১৪ জনের মাঝে ৯ জনই হলেন দিরাই উপজেলার। তারা হলেন- সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার ভাটিপাড়া গ্রামের মৃত সজিব আলীর ছেলে রশিদ আলী (২৫), সিরাজ মিয়ার ছেলে সৌরভ মিয়া (২৭), শমসের নুরের মেয়ে মেহের (২৪), মৃত মফিজ মিয়ার ছেলে সায়েদ নূর (৫০), গচিয়া গ্রামের বারিক উল্লার ছেলে সিজিল মিয়া (৫৫), পাথারিয়া গ্রামের মৃত ছলিম উদ্দিনের ছেলে একলিম মিয়া (৫৫), কাইমা মধুপুর গ্রামের সোনা মিয়ার ছেলে দুদু মিয়া (৪০), একই গ্রামের শাহজাহানের ছেলে বাদশা (২২), আলীনগর গ্রামের মৃত শিশু মিয়ার ছেলে হারিস মিয়া (৬৫)।
এছাড়া অন্যান্য নিহতরা হলেন, শান্তিগঞ্জ উপজেলার মুরাদপুর গ্রামের মৃত হারুন মিয়ার ছেলে দুলাম মিয়া (২৬), একই উপজেলার বাবনগাঁ গ্রামের মৃত ওয়াহাব আলীর ছেলে শাহিন মিয়া (৪০), শান্তিগঞ্জ উপজেলার তলেরতন গ্রামের মৃত আওলাদ উল্লার ছেলে আওলাদ হোসেন (৬০), হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার হলদিউড়া গ্রামের আব্দুর রহিমের স্ত্রী আমিনা বেগম (৪৫), নেত্রকোনার ভারহাট্টা উপজেলার দশদার গ্রামের ইসলাম উদ্দিনের ছেলে আওলাদ মিয়া (৩০)।
দুর্ঘটনার পর লাশগুলো সড়কে, সড়কের পাশে ঝোপ-ঝাড়ের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল পড়ে ছিল। এমনটাই জানিয়েছেন উদ্ধারকাজে নেতৃত্ব দেয়া ওসমানীনগরের ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের এক কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, স্থানীয়দের সহযোগিতায় প্রথমে আহতদের উদ্ধার করে অ্যাম্বুলেন্স করে হাসপাতালে নিয়ে আসি। এরপর একে একে লাশগুলো উদ্ধার করি।
ওসমানী হাসপাতালে ভর্তি আহত একজন সাংবাদিকদের বলেন, ঢাকার দিক থেকে আসা ট্রাকটি যখন ডান পাশে এসে আমাদের পিকআপটিকে ধাক্কা দেয়। তখন খুব জোরে শব্দ হয়েছিল। ট্রাকটি দ্রুতবেগে আসছিল। মনে হয় চালক ঘুমিয়ে গিয়েছিলো। ধাক্কা খেয়ে আমাদের পিকআপটি উল্টে যায়। আমি মাথায় আঘাত পাই। এরপর আর কিছু মনে নেই।
এদিকে, সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের মরদেহ বুধবার দুপুরে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। নিহতদের পরিবারের আবেদনের প্রেক্ষিতে ময়না তদন্ত ছাড়াই মরদেহগুলো হস্তান্তর করা হয় বলে জানান সিলেটের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ইমরুল হাসান।
সিলেটের কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী মাহমুদ বলেন, স্বজনদের মাধ্যমে নিহত ব্যক্তিদের নাম-পরিচয় জানা গেছে। আইনি প্রক্রিয়া শেষে মরদেহগুলো পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
দুর্ঘটনার পর নাজিরবাজারের দুদিকে সিলেট-ঢাকা মহাসড়কে কয়েক কিলোমিটার দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। পরে পুলিশের তৎপরতায় ৩ ঘণ্টা পর সকাল সাড়ে ৮টার দিকে সিলেট-ঢাকা মহাসড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।
স্বজনদের আহাজারী : সকাল থেকে নিহত ব্যক্তিদের স্বজনদের আহাজারি আর আর্তনাদে সিলেটের এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল প্রাঙ্গণের পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। সময় যতই বাড়ছিল, ভিড় বাড়ছিল নিহত ও আহত ব্যক্তিদের স্বজনদের।
বুধবার সকাল সাড়ে আটটার দিকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে আহাজারি করছিলেন জোছনা বেগম (৩৫)। তাঁর স্বামী সাধু মিয়া (৫০) এই দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন ভাই রুবেল মিয়া।
সাধু মিয়া সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার মধুপুরের বাসিন্দা। তিনি স্ত্রী জোছনা বেগমসহ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নগরের আম্বরখানা এলাকায় বসবাস করতেন। শ্রমিক সাধু মিয়া ভোরে কাজের জন্য বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন। পরে সকাল সাড়ে ৬টার দিকে এক ব্যক্তি স্ত্রীর মুঠোফোনে ফোন দিয়ে দুর্ঘটনার বিষয়টি জানান।
রুবেল মিয়া বলেন, বোনের ফোন পেয়ে তিনি তড়িঘড়ি করে সিলেটের এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চলে এসেছিলেন। আসার পর বোনজামাই মারা যাওয়ার বিষয়টি তিনি জানতে পারেন। তবে সে সময় তিনি বোনকে বিষয়টি জানাননি। সকাল সাড়ে ৮টার দিকে বোনকে স্বামীর মরদেহ দেখিয়েছেন। এর পর থেকে বিলাপ থামছে না জোছনা বেগমের। তিনি বলেন, স্বামীর মরদেহ দেখার পর কয়েক দফা অচেতন হয়ে পড়েছেন বোন। এখন তাঁকে নিয়ে তিনি চিন্তিত।
হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে দাঁড়িয়ে কান্না করছিলেন মো. হৃদয়। তিনি দুর্ঘটনায় নিহত সৌরভ মিয়ার (২৭) ফুফাতো ভাই। হৃদয় বলেন, চার ভাইয়ের মধ্যে তৃতীয় সৌরভ। কাজ করার জন্য দিরাইয়ের ভাটিপাড়া থেকে সিলেটে এসে থাকছিলেন তিনি। সৌরভের মৃত্যুর বিষয়টি সকালে অপরিচিত এক ব্যক্তি মুঠোফোনে জানিয়েছেন। পরে তিনি তাঁর বাবা শাহ আলমকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছেন।
হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন নিহত দুলাল মিয়ার ফুপাতো ভাই মো. শাহীন। তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন পাশে থাকা স্বজনরা।
মো. শাহীন জানান, দুলালের বড় ভাই হেলাল আহমদ প্রায় তিন মাস আগে দুর্ঘটনায় মারা যান। তিনি স্ত্রী ও দুই সন্তান রেখে যান। মাসখানেক আগে পরিবারের লোকজন হেলালের স্ত্রী শারমিন বেগমকে (২৫) বিয়ে দেন দুলাল মিয়ার সঙ্গে। বিয়ের দুই সপ্তাহ পর কাজের জন্য সিলেটে আসেন দুলাল। থাকতেন আম্বরখানা সাপ্লাই এলাকার ভাড়া বাসায়।
হিমঘরের পাশে পাশে মাটিতে বসে আহাজহারি করছিলেন মেহের মিয়ার স্ত্রী চাঁদনী বেগম। আহাজারি করে তিনি বলেন, সকালে ডিম রান্না করে দিয়েছিলাম। কিন্তু সে না খেয়েই চলে যায়। এখন আমার বাচ্চাগুলো এতিম হয়ে গেলো। আমি টাকা চাই না। বাচ্চাদের বাবাকে চাই।
কাঁদতে কাঁদতেই চাঁদনী বলেন, গরমে রাতে ঘুম আসছিল না। রাত দুইটার দিকে সে আমারে ডাক দেয়। বলে- তোর জন্য একটা ফ্যান কিনে দেবো। আমারে আর ফ্যান কিনে দিতে পারলো না।
সিলেটের এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগ ও লাশঘরের সামনে হতাহত ব্যক্তিদের তিন শতাধিক স্বজন ভিড় করেন। অনেকে স্বজনদের খুঁজছিলেন। অনেকে ভিড়ের মধ্যে কান্না করছিলেন।
এদিকে, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহতদের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে ও আহতদের পরিবারে ১০ হাজার টাকা প্রদান করা হয়েছে বলে জানান তিনি। এছাড়া সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আওয়ামী লীগ দলীয় মেয়র প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা করে প্রদান করেন।