কোম্পানীগঞ্জে জাকির ডাক্তারের খপ্পরে নিঃস্ব অর্ধশত যুবক
প্রকাশিত হয়েছে : ১৫ জুন ২০২৩, ৯:২৮:৫৯ অপরাহ্ন
আব্দুল জলিল, কোম্পানীগঞ্জ : সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার প্রায় অর্ধশত যুবককে বিদেশে পাঠিয়ে প্রতারণা করেছে ‘জাকির ডাক্তার’ নামে এক আদম ব্যবসায়ী। পথ ভিসায় তাদেরকে সৌদি আরব পাঠিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন প্রায় ২ কোটি টাকা। এ নিয়ে কোম্পানীগঞ্জ থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন এক ভুক্তভোগীর পিতা। প্রতারণার এই মহাকৌশলে জড়িত রয়েছেন তারা ৪ ভাই। এদের মধ্যে সৌদি আরবে বসবাস করে আনোয়ার হোসেন। আর বাকী ৩ জনই দেশে রয়েছেন। জাকির ডাক্তারের ফার্মেসি ছিল উপজেলার পাড়ুয়া বাজারে। আর হাবিব ও নবী হোসেনের ফার্মেসি রয়েছে থানা বাজারে।
সৌদি আরবে এসব মানুষকে পাঠানোর পর তাদেরকে আকামা না দেওয়ায় কোন কাজকর্ম করতে পারছেন না। অনাহারে অর্ধাহারে কারো কাছে হাত পেতে কিংবা দেশ থেকে টাকা নিয়ে কোন মতে খেয়েপরে বেঁচে আছে প্রতারিত হওয়া এই মানুষগুলো। কাউকে তেল পাম্পে আবার কাউকে কোম্পানিতে কাজ দিবে বলে জনপ্রতি ৪-৫ লক্ষ টাকা করে হাতিয়ে নিয়ে জাকির ডাক্তার এখন নিরুদ্দেশ। ঢাকার সাবরিনা ট্রাভেলস ইন্টারন্যাশনাল এর মাধ্যমে ভিসা প্রসেসিং করে তাদেরকে পাঠানো হয় সৌদিতে।
ভুক্তভোগীর স্বজনরা জানান, জাকির ডাক্তার তার ভাই আনোয়ার এর মাধ্যমে সৌদি আরব থেকে ভিসা সংগ্রহ করতেন। আবার দেশ থেকে মানুষ পাঠানোর সময় আনোয়ারের সাথে সৌদি আরব গিয়ে যোগাযোগ করার কথাও বলে দিতেন। কয়েকদিন তাদের খোঁজখবর নিয়ে আকামা দেওয়ার আগেই যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় আনোয়ার।
এদিকে, দেশে থাকা তাদের ৩ ভাইয়ের প্রত্যেকেরই ফার্মেসির ব্যবসা রয়েছে। প্রথমে জাকিরের পাড়ুয়া বাজারের ফার্মেসিতে মৌখিক চুক্তি হতো বিদেশগামী যাত্রী কিংবা তার স্বজনদের সাথে। তার ফার্মেসিতে নিজে ৩ থেকে সাড়ে ৩ লক্ষ টাকা নিত। আর যাত্রীদের ফ্লাইটের আগে বাকি ১ থেকে দেড় লক্ষ টাকা তার ভাই হাবিব ডাক্তার ও নবী হোসেনের মাধ্যমে নেওয়া হতো। বেশ কিছুদিন থেকে তাদের ৩ ভাইয়ের ফার্মেসির ব্যবসা থাকায় লোকজন অনায়াসে তাদের বিশ্বাস করে।
তাদের প্রতারণার শিকার হয়েছে উপজেলার বাবুল নগরের তৈয়ব আলীর ছেলে সিজুল আহমদ, পাড়ুয়া মাঝ পাড়ার রঞ্জন মিয়ার ছেলে সেজু মিয়া, আহসান মিয়ার ছেলে মমিন, জাতির টুকের রইছ আলীর ছেলে কবির আহমদ, নারাইনপুর গ্রামের আনর আলী, মাসুম আহমদ, আব্দুল মান্নান, শামীম, আমির হোসেন, আল আমিন, সাজ্জাত, ইন্তাজ আলী, আয়না মিয়া, এবাদুল, সারওয়ার, জাবেদ, মকরম আলী সহ প্রায় অর্ধশত যুবক।
ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন জাকির ডাক্তার ঢাকার যাত্রাবাড়ী এলাকায় এই টাকা দিয়ে একটি বাড়ি কিনেছে। সে এখন সেখানেই বসবাস করে। ঢাকার ২টি ট্রাভেলসের সাথে শেয়ার রয়েছে তার। এ ছাড়াও সিলেট ও সুনামগঞ্জের বিভিন্ন জায়গায় তার অনেকগুলো ফার্মেসি রয়েছে।
ভুক্তভোগী সিজুল আহমদের বড় ভাই রাসেল আহমদ জানান, অনেক কষ্টে জমানো টাকা, শখের মোটরসাইকেল বিক্রি ও জমি বন্ধক রেখে সাড়ে ৪ লক্ষ টাকা জোগাড় করে জাকির ডাক্তারকে দিয়েছি। সে আমার ভাইকে সৌদিতে একটি তেল পাম্পে কাজ দিবে বলে নিয়েছিল। সৌদিতে যাওয়ার পর ১ বছরের আকামা দেওয়ার কথা থাকলেও মাত্র ৩ মাসের আকামা দেয়। এক রুমে ১৫-২০ জন লোক থাকে এমন একটি রুমে তাকে রেখে দেয় জাকির ডাক্তারের ভাই আনোয়ার। এর পর ৪ মাস রাজমিস্ত্রীর কাজ করায় আনোয়ার কিন্তু তাকে কোন টাকা দেয়নি। এখন জাকির ডাক্তারকে ফোন দিলেও সে ফোন ধরে না। রাসেল আরো জানান, জাকির ডাক্তার এর কাছে সাড়ে ৩ লক্ষ টাকা ও তার ভাই হাবিব ডাক্তারের কাছে ১ লক্ষ টাকা দেন। সৌদি আরব নিয়ে তার ভাইকে তেল পাম্পে কাজ না দেওয়ায় পাড়ুয়া গ্রামে তাদের নামে বিচার শালিস বসানো হয়। সে সময় তারা সমাধানের জন্য কিছুটা সময় চায়। কয়েকদিন সময় নিয়ে জাকির ডাক্তার কোম্পানীগঞ্জ থেকে পালিয়ে যায়। সৌদিতে তার ভাই যাওয়ার পর থেকে তার খাবার খরচের টাকা দেশ থেকে দিতে হচ্ছে। আকামা না থাকায় সেখানে কেউ তাদেরকে কাজও দেয় না।
কলেজ পড়ুয়া ভুক্তভোগী সেজু মিয়ার পিতা রঞ্জন মিয়া জানান, মেয়েদের স্বর্ণ ও ঘরের গরু বিক্রি এবং জমি বন্ধক দিয়ে ৫ লক্ষ টাকা দিয়েছিলাম জাকির ডাক্তার ও তাদের ভাইদের কাছে। ১ বছর পর ছেলেকে বাড়িতে নিয়ে আসতে বাধ্য হই। ইন্টারে পড়ুয়া ছেলেকে সৌদিতে যাওয়ার পর ৩ মাসের আকামা দেয় জাকিরের ভাই আনোয়ার। তেল পাম্পে কাজ দেওয়ার কথা বলে আমার ছেলেকে সৌদিতে নেয়। সেখানে তেল পাম্পে কাজ না দিয়ে ৮ মাস রাজ মিস্ত্রির কাজ করায়। হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রম করে কাজ করলেও কোন বেতন দেয় নি। আমি বাড়ি থেকে প্রতি মাসে টাকা পাঠাতাম। এই টাকা দিয়ে আমার ছেলে কোন মতে থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করত। কোন পথ খুঁজে না পেয়ে সব শেষে আমার মেয়ের স্বর্ণ বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে ছেলেকে দেশে নিয়ে আসি। দেশে আসার আগে সৌদিতে প্রায় ১০ দিন তাকে জেল খাটতে হয়েছে। এ বিষয়টি নিয়ে থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন রঞ্জন মিয়া।
ডাক্তার হাবিব ও নবী হোসেন জানান, তাদের কাছে যারাই টাকা দিয়েছেন তারা সেই টাকা জাকির ডাক্তারের ব্যাংক একাউন্টে জমা দিয়েছেন। এ ছাড়াও কাকুড়াইল ও ছনবাড়ীর ২ জনের টাকা ফেরত দিয়েছেন বলেও নবী হোসেন জানান।
এ ব্যাপারে জাকির ডাক্তার জানান, কফিলের সাথে ঝামেলার কারণে আকামা নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে দেশে চলে আসছে আবার অনেকেই সৌদিতে আছে। তবে কাউকে পথ ভিসায় পাঠানো হয়নি। সাবরিনা ট্রাভেলস ইন্টারন্যাশনাল এর মাধ্যমে ভিসা প্রসেসিং করে লোকজন পাঠানো হয়েছে। সৌদি আরব থেকে আনোয়ার হোসেন ভিসা দিয়েছে। আমি দেশ থেকে প্রসেসিং করে মানুষ পাঠিয়েছি। অনেককে টাকা রিটার্ন করা হচ্ছে।