বিপদসীমা ছাড়ালো সুরমা
প্রকাশিত হয়েছে : ১৮ জুন ২০২৩, ১২:১০:০৬ অপরাহ্ন
স্টাফ রিপোর্টার : গত বছরের ভয়াবহ বন্যার ধকল যেতে না যেতেই বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই সিলেটে আকস্মিক বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। গত তিন দিন ধরে সিলেটে টানা বৃষ্টি হচ্ছে। এই বৃষ্টি আরো ১৫ দিন অব্যাহত থাকবে বলে জানা গেছে। এরই মধ্যে গোয়াইনঘাট উপজেলার পাঁচ ইউনিয়নরে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, দেশের অধিকাংশ এলাকায় বেশি তাপমাত্রা দেখা গেলেও সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগে দেশের অভ্যন্তরে এবং ভারতের উজানে ভারী বৃষ্টিপাতের প্রভাবে বাড়তে শুরু করেছে নদ-নদীর পানি। এতে আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সিলেট অঞ্চলে আকস্মিক বন্যার শঙ্কা রয়েছে।
শনিবার সকালে সিলেটের নদ-নদীগুলোর পানি ছিলো বিপদসীমা ছুঁঁইছুঁঁই থাকলেও বিকালে সিলেটের প্রধান নদী সুরমায় সেই সীমা ছাড়িয়ে পানি উঠলো আরো উপরে। এছাড়া কুশিয়ারা, মনু, খোয়াই, সারিগোয়াইন, ঝালুখালি, ভোগাই-কংশ, সোমেশ্বরী, যদুকাটাসহ সিলেট অঞ্চলের নদ-নদীগুলোর পানি সমতলে দ্রæত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে বিপদসীমা অতিক্রম করে সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার কিছু নিম্নাঞ্চলে স্বল্পমেয়াদি আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে বলে বন্যা তথ্য কেন্দ্রের দেয়া বুলেটিনে বলা হয়েছে।
এ দিকে সিলেটে গত ২৪ ঘণ্টায় ১১৫.৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টির পানিতে ডুবেছে নগরীর নিচু এলাকাগুলো। টানা বৃষ্টিতে সিলেট নগরের ওপর দিয়ে বয়ে চলা খালের পানি উচ্চতা বাড়ছে। নগরের বিভিন্ন স্থানে ছড়া, খালউপচে বাসা-বাড়ি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকছে। উজানের বৃষ্টি আর নগরের জলাবদ্ধতার পানির কারণে বেড়েছে সুরমা নদীর পানির উচ্চতা। পাশাপাশি বিভিন্ন হাওরেও পানি বাড়ছে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী জুন মাসের প্রথমার্ধ থেকে মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের ওপর প্রভাব বিস্তার করায় দেশে ও উজানের অববাহিকার স্থানসমূহে বৃষ্টিপাতের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে চলতি সপ্তাহের শুরু থেকে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল উজানে ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে। এই সময় দেশের উত্তরাঞ্চল এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদ-নদীগুলোর পানি সমতলের উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধির কথা বলা হয়।
তাতে বলা হয়, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীর পানি সমতল বর্তমানে স্বাভাবিক গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ ও উজানের অববাহিকায় ভারতের অরুনাচল, আসাম, মেঘালয় ও হিমালয় পাদদেশীয় পশ্চিমবঙ্গের ওপর বর্তমানে মৌসুমি বায়ু সক্রিয় অবস্থায় থাকায় ভারী থেকে অতিভারী দৃষ্টিপাত প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে জুন মাসের দ্বিতীয়ার্ধে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীর পানি সমতল উল্লেখযোগ্যহারে বৃদ্ধি পেতে পারে এবং চলতি মাসের শেষ সপ্তাহে এই অববাহিকার পানি সমতলে বিপদসীমার কাছে পৌঁছাতে পারে। এছাড়া এই সময়ে দেশের উত্তরাঞ্চলের তিস্তা ধরলাসহ অন্যান্য প্রধান নদীগুলোর স্বাভাবিক প্রবাহ বিরাজমান থাকতে পারে।
সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আশিফ আহমেদ জানান, শনিবার ৩টার দিকে সুরমা নদীর কানাইঘাট পয়েন্টে পানি বিপদসীমা ছাড়িয়ে যায়। এ পয়েন্টে রেকর্ড করা হয় ১২.৯৫ পয়েন্ট। বিপদসীমা ছিলো ১২.২৬ পয়েন্ট।
সিলেট আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, শুক্রবার সকাল ৬টা থেকে শনিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত সিলেটে ১১৫.৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। আর সকাল ৬টা থেকে দুপুর ৯টা পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছে ৪৯ মিলিমিটার।
সহকারী আবহাওয়াবিদ শাহ মো: সজীব হোসাইন বলেন, আগামী ৪৮ ঘণ্টা সিলেটে ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। এজন্য সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে পাহাড়ি ঢল নামার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে।
আমাদের সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি জানান : উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে নদ-নদীর পানি বাড়ায় সুনামগঞ্জে আতংক আর উৎকণ্ঠা নিয়ে সময় পার করছেন ভাটি অঞ্চলের মানুষরা। শনিবার দুপুর পর্যন্ত সুনামগঞ্জের ষোলঘরস্থ সুরমা নদীর পানি বিপদ সীমার ১১৩ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে এবং গত ২৪ ঘন্টায় ৭৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। ভারতের চেরাপুঞ্জিতে ১৬১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে বলে সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মামুন হাওলাদার জানান, শুক্রবারের চেয়ে শনিবার নদীর পানি কিছুটা কম। তবে যেভাবে বৃষ্টিপাত অব্যাহত আছে এতে সুনামগঞ্জের সীমান্ত এলাকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হতে পারে।
জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী জানিয়েছেন, বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে বন্যার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে। এ কারণেই সরকারের তরফ থেকে পর্যাপ্ত খাদ্যসহায়তা মজুদ এবং আশ্রয়কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
আমাদের গোয়াইনঘাট প্রতিনিধি জানান : গোয়াইনঘাট উপজেলায় সার্বিক বন্যার পরিস্থিতি অবনতি হয়েছে। হাওরাঞ্চলে কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দী রয়েছেন। উপজেলা সদরের সাথে ৭টি ইউনিয়নের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এতে দুর্ভোগে পড়েছেন লক্ষাধিক মানুষ।
![](https://dailyjalalabad.com/files/uploads/2023/06/guainghat-4-1024x768.jpg)
টানা বর্ষণে গোয়াইনঘাটের নদ-নদীর পানি বাড়ছে। উনাই হাওর, বঙ্গবীর টার্ণিং ও তোয়াকুল ব্রীজ নির্মাণে ধীরগতি থাকায় তোয়াতুল, নন্দিরগাঁ, রুস্তমপুর, পশ্চিম জাফলং, সদর, পূর্ব ও মধ্য জাফলং ইউনিয়ন উপজেলার সাথে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। রাধানগর রাস্তা রয়েছে অনেকাংশ নিমজ্জিত। এতে বিভিন্ন ইউপির হাওরাঞ্চলের অর্ধ লক্ষ মানুষ রয়েছেন পানিবন্দী। উনাই হাওরে বাইপাস সড়ক পানিতে ঢুবে থাকায় উত্তর গোয়াইনঘাটবাসী জনসাধারণের চরম দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে। ওই এলাকার বাজারগুলোতে নিত্য পণ্যে সরবরাহ হচ্ছে বিঘিœত। দিন মজুর শ্রমিকরা বেকার থাকায় মানবেতর দিন কাটছে।
উপজেলার ত্রাণ ও দুর্যোগ শাখার কর্মকর্তা শীরষেন্দু পুরকায়স্থ বলেন, পর্যাপ্ত ত্রাণ রয়েছে, ৫৬টি আশ্রয়কেন্দ্রসহ বিপুলসংখ্যক উদ্ধারকারী দল রয়েছে। আমরা সতর্ক দৃষ্টি রাখছি। জনপ্রতিনিধিদের বার্তা দেয়া হয়েছে।
আমাদের জগন্নাথপুর প্রতিনিধি জানান : সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে নদ-নদীর পানি। সঙ্গে বেড়ে চলেছে মানুষের শঙ্কা। গত প্রায় এক সপ্তাহ ধরে টানা বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানি বেড়েই চলেছে। সারাক্ষণ আকাশ থাকে মেঘাচ্ছন্ন। আকাশে সূর্যের দেখা মিলছে না। অবিরাম চলছে বৃষ্টি। মাঝে মধ্যে থাকলেও কিছুক্ষণ পর আবার চলে আসে। সাথে রয়েছে ঝড়ো হাওয়া ও ঘনঘন বজ্রপাত। এর মধ্যে সিলেট ও সুনামগঞ্জে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় এসব পানি নেমে আসছে নিচু এলাকা জগন্নাথপুরে। তাই টানা বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা পানিতে জগন্নাথপুর পৌর শহরের নলজুর নদীসহ অন্যান্য নদ-নদী ভরে গেছে। যদিও এখনো বিপদজনক পরিস্থিতি হয়নি। তবে এভাবে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে আগামী কয়েক দিনের মধ্যে বড় ধরণের বন্যার আশঙ্কায় শঙ্কিত হয়ে হয়ে পড়েছেন মানুষ। তাছাড়া গত বছরের ভয়াবহ বন্যার স্মৃতি মানুষকে সারাক্ষণ তাড়া করে বেড়াচ্ছে।
শনিবার নলজুর নদীতে দেখা যায়, দ্রুত গতিতে পানি চলাচল করছে। এ সময় সুহেল মিয়া, কফিল উদ্দিন, জয়ন্ত দাস, আলী আকবর সহ স্থানীয়রা জানান, বর্তমানে নদীর পানি দ্রæত চলে যাচ্ছে হাওরে। হাওরগুলো ভরে গেলে নদীসহ উপজেলার সর্বত্র প্লাবিত হয়ে যাবে। তখন বন্যা পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হতে পারে। গত বছরের মতো এবারো বন্যা হলে বড় ধরণের ক্ষতি ও দুর্ভোগের শেষ থাকবে না মানুষের। এমন আশঙ্কা মানুষকে সারাক্ষণ তাড়া করে বেড়াচ্ছে।
উপজেলা পানি উন্নয়ন কর্মকর্তা মুহাম্মদ হাসান গাজী জানান, এখনো পানির স্বাভাবিক অবস্থা আছে। আপাতত বড় ধরণের বন্যার আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে না। তবে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত হলে কিংবা অতিরিক্ত পানি বৃদ্ধি পেলে পরিস্থিতি মোকাবেলায় উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনাক্রমে ব্যবস্থা নেয়া হবে।