সিলেটের নতুন মেয়র আনোয়ারুজ্জামান
প্রকাশিত হয়েছে : ২১ জুন ২০২৩, ১০:৫১:৪৭ অপরাহ্ন
আহবাব মোস্তফা খান :
শঙ্কা ছিলো বৃষ্টি হবে। কিন্তু বৃষ্টি হয়নি। তবে দিনভর আকাশ ছিলো মেঘলা। বিএনপি-জামায়াত সরাসরি নির্বাচনে না থাকায় ভোটের দিনের চিত্রও যেন ছিলো অন্যরকম ‘আঁধারে’ ঢাকা। নির্বাচনী আমেজ ছিলো অনেকটাই ফ্যাকাশে, নিস্প্রভ। ছিলোনা উত্তেজনা। যেমনটা ছিলো গত চারবার। এমন নিরুত্তাপ এক নির্বাচনে সিলেট পেলো নতুন নগর পিতা। চমক দেখিয়ে সিলেট সিটির মেয়র হলেন আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। শুধু মেয়রই হলেন না, ১০ বছর পর আওয়ামীলীগের হারানো চেয়ার পুনরুদ্ধার করলেন লন্ডন প্রবাসী এই নেতা।
মেয়র পদে মনোনয়ন প্রত্যাশী সিলেট আওয়ামী লীগের নয় নেতাকে ডিঙিয়ে দলের মনোনয়ন পেয়ে তিনি প্রথম দফা চমক দেখিয়েছিলেন। এবার ভোটে জিতে তিনি দ্বিতীয় চমক দেখালেন।
নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ৬৯ হাজার ১২৯ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। নৌকা প্রতীকে তিনি পেয়েছেন ১ লক্ষ ১৯ হাজার ৯৯১ ভোট। অন্যদিকে, প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বি লাঙ্গল প্রতীকের নজরুল ইসলাম বাবুল পেয়েছেন ৫০ হাজার ৮৬২ ভোট। আর বিস্ময়করভাবে ২৯ হাজার ৬৮৮ ভোট পেয়ে নজর কাড়লেন বাস প্রতিকের প্রার্থী শাহ জাহান মিয়া। এছাড়া নির্বাচন বর্জন করা ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী মাহমুদুল হাসান পেয়েছেন ১২ হাজার ৭৯৪ ভোট, স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুল হানিফ কুটু ঘোড়া প্রতিকে পেয়েছেন ৪ হাজার ২৯৬ ভোট, মো: জহিরুল আলম গোলাপ ফুল প্রতিকে পেয়েছেন ৩ হাজার ৪০৫ ভোট, মোশতাক আহমেদ রউফ মোস্তফা হরিণ প্রতিকে পেয়েছেন ২ হাজার ৯৫৯ ভোট এবং ছালাহ উদ্দিন রিমন ক্রিকেট ব্যাট প্রতিকে পেয়েছেন ২ হাজার ৬৪৮ ভোট।
প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা গেছে, নির্বাচনে মোট বৈধ ভোট পড়েছে ২ লক্ষ ২৬ হাজার ৬৪৩টি। ভোট প্রদানের শতকরা হার ৪৬ দশমিক ৭১।
সিলেট সিটিতে মেয়র পদে তেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস মেলেনি আগেই। ভোটের মাঠে ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের প্রার্থীর সামনে ছিল না শক্ত কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী। দৃশ্যত ক্ষমতাসীন দলের মেয়রপ্রার্থীদের সামনে মাঠ ছিলো অনেকটাই খালি। শেষ পর্যন্ত খালি মাঠেই ‘গোল’ দিলেন আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী।
সিলেট সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠার পর চারবার নির্বাচন হয়েছে। এরমাঝে প্রথম দুইবার আওয়ামীলীগের বদর উদ্দিন আহমদ কামরান ও পরের দুইবার বিএনপির আরিফুল হক চৌধুরী জয়মাল্য পরেন। টানা ১০ বছর সিলেট নগরের প্রধান চেয়ারটির জন্য আক্ষেপের আগুনে পুড়ছিলো ক্ষমতাসীন দল। দলীয় প্রধানও এটি গুরুত্বের সাথে নিয়েছিলেন বলে দলীয় সূত্রগুলো জানিয়েছিলো। তবে হারানো চেয়ারটি পুনরুদ্ধারের জন্য তিনি আস্থা রাখলেননা সিলেটের মাঠে ময়দানে রাজনীতি করে আসা দায়িত্বশীল কোন নেতাকে। বেছে নিলেন লন্ডন প্রবাসী নেতা আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীকে। তাকে টেনে আনলেন সিলেটে। করলেন প্রার্থী। আর তার মাধ্যমেই দীর্ঘ আক্ষেপের অবসান ঘটালেন।
সিলেটে এবার মেয়র পদে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বি না থাকায় ভোটার উপস্থিত করা ছিল চ্যালেঞ্জের। ভোট গ্রহণ সকাল ৮টায় শুরু হলেও বিকেল পর্যন্ত উপস্থিতি ছিল একেবারেই কম। তাই ভোট ছিলো উৎসবহীন কিন্তু শান্তিপূর্ণই। ভোট দেয়ার পর নৌকার প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী বিজয়ের আশাবাদ ব্যক্ত করলেও সংশয় প্রকাশ করেছিলেন লাঙলের প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাবুল। তার অভিযোগ ছিলো, তাদের এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত তার অভিযোগ ধোপে টিকেনি। আমলেও নেননি নির্বাচন সংশ্লিষ্টরা।
ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার পর সিলেটের অতিরিক্ত আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা ও গণমাধ্যম শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তারেক আহমদ গণমাধমে বলেন, প্রথম ৫ ঘণ্টায় ভোট পড়েছে প্রায় ২০ শতাংশ। এরপরের ৩ ঘণ্টায় ভোট পড়ার হার বেড়েছে।
অন্যদিকে, বুধবার বিকেলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৪৬ শতাংশ ভোট পড়েছে। তবে বিএনপিসহ অধিকাংশ দলের বর্জনের মধ্যে এই নির্বাচনে ভোটের হার নিয়েও অস্বস্তিতে নেই তিনি। তার মতে, স্থানীয় নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রে ৫০ শতাংশ ভোটার পাওয়াই যথেষ্ট।
অথচ সিলেটে ২০০৮ সালে ভোট পড়ার হার ছিল ৭৫ শতাংশ। ২০১৩ সালে এ সিটিতে ভোট পড়ে ৬২ শতাংশ এবং ২০১৮ সালেও ভোটের হার ছিল প্রায় ৬৩ শতাংশ।
এদিকে, ফলাফল ঘোষণার পর নবনির্বাচিত মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী নগরবাসীর কাছে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। নগরের মেয়র নয়, সেবক হিসেবে কাজ করবেন বলে জানান তিনি।
নতুন মেয়রের জীবন বৃত্তান্ত : ১৯৭০ সালের ১ জুন সিলেট জেলার ওসমানীনগর উপজেলার বুরুঙ্গা বাজার ইউনিয়নের পশ্চিম তিলাপাড়া গ্রামে আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর জন্ম। তার বাবার নাম নৌশা মিয়া চৌধুরী এবং মায়ের নাম মোছা. গহিনুন্নেছা চৌধুরী।
৬ ভাইয়ের মধ্যে আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী সবার ছোট। তিনি পশ্চিম তিলাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক, বুরুঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক, সিলেট সরকারি কলেজ থেকে এইচ.এস.সি. এবং পরবর্তী সময়ে যুক্তরাজ্য থেকে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন বলে নির্বাচনী হলফনামায় উল্লেখ করেন। পড়াশোনা ও রাজনীতির পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথেও তিনি জড়িত ছিলেন।
বালাগঞ্জ ছাত্রলীগের সমাজসেবা সম্পাদক হিসেবে তার রাজনৈতিক সাংগঠনিক দায়িত্বের হাতেখড়ি। সিলেট সরকারি কলেজ ছাত্রসংসদ’ নির্বাচনে ছাত্রলীগ থেকে ছাত্র-মিলনায়তন সম্পাদক পদে নির্বাচন করেন।
লন্ডন গিয়ে তিনি প্রথমে লন্ডন মহানগর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং পরবর্তী সময়ে যুক্তরাজ্য যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে কেন্দ্রীয় যুবলীগের সদস্য হিসেবেও মনোনীত হন। যুবলীগের রাজনীতি থেকে তিনি সরাসরি যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মনোনীত হন। এই দায়িত্বপালনকালীন অবস্থায়ই তাকে সিলেটের মেয়র পদে প্রার্থী হিসেবে বেছে নেয়া হয়।