বৃষ্টিতে পর্যটন ব্যবসায় ধস
প্রকাশিত হয়েছে : ০৩ জুলাই ২০২৩, ৭:৫৮:২৭ অপরাহ্ন
স্টাফ রিপোর্টার: সিলেটে এবার ঈদের আগেরদিন থেকেই শুরু হয়েছে বৃষ্টিপাত। আবহাওয়া অফিস আগেই পূর্বাভাস দিয়েছিল সিলেটে এবার ঈদে টানা বৃষ্টিপাত হতে পারে। টানা এই বৃষ্টিপাত অব্যহত আছে। সোমবার সকালে বৃষ্টি হলেও বিকেলে বৃষ্টি থেমে যায়, দেখা দেয় সূর্যের মুখ। কিছু সময়ের জন্য উজ¦ল রোদ আভা ছড়ায় পশ্চিম দিক থেকে। তবে টানা বৃষ্টির কারণে পর্যটন নগরী হিসেবে খ্যাতি পাওয়া সিলেটে পর্যটন ব্যবসায় ধস নেমেছে। শনিবার পর্যন্ত অফিস আদালত ছুটি থাকলেও দেখা মিলেনি পর্যটকদের। প্রবল বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে যায় অনেক এলাকা ও রাস্তাঘাট। এমনকি সিলেট নগরীর অধিকাংশ এলাকার রাস্তা ও বাড়িঘরের উঠোন, বারান্দা থাকে পানির নিচে। এরইমধ্যে ভোলাগঞ্জের সাদাপাথরে পানিতে তলিয়ে নিখোঁজ হয়েছেন ঢাকা মিরপুরের আব্দুস সালাম নামে এক দর্শনার্থী।
সিলেট বিভাগের দর্শনীয় জায়গাগুলো মধ্যে জাফলং, বিছনাকান্দি, পান্তুমাই, সাদাপাথর, রাতারগুল, মাধবকুণ্ড, টাঙ্গুয়ার হাওর, হাকালুকি হাওরসহ সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজারের বেশিরভাগই পানি নির্ভর। এসব জায়গায় পানি বেড়ে তা বিপজ্জনক অবস্থায় বিরাজ করছে, তাছাড়া যাতায়াতের রাস্তাঘাট অনেক জায়গায় ডুবে গেছে। ফলে এসব বিপদ মাড়িয়ে সিলেটে ঘুরতে আসার সাহস করেননি কেউ। যারা কয়েকজন এসেছেন তারাও সিঙ্গেল বা বন্ধুবান্ধব মিলে এসেছেন কিন্তু পারিবারিকভাবে কাউকে আসতে তেমন দেখা যায়নি।
ঈদে সিলেট বেড়াতে আসা দর্শনার্থীদের বেশিরভাগই পরিবার বাচ্চাকাচ্চা নিয়েই আসেন। তারাই মূলত বিভিন্ন হোটেল মোটেল ভাড়া করেন। কিন্তু এবার বৃষ্টির জন্য তা হয়ে ওঠেনি। তাছাড়া সিলেটের স্থানীয় অনেকেই কাছেপিঠে চা বাগান, ওয়াকওয়ে কিংবা খোলামেলা জায়গায় গেট টুগেদার বা ঘুরাফেরা করে থাকেন। বৃষ্টি এসব জায়গায় জোঁক, সাপ এসবের উপদ্রব থাকায় স্থানীয়রাও খুব একটা বের হননি।
এরআগে গত ঈদুল ফিতরে সিলেটে রেকর্ড সংখ্যক দর্শনার্থীদের ঢল নেমেছিল। ঈদের ছুটিতে পর্যটনখাতে ব্যবসা হয়েছিল শত কোটি টাকার। কিন্তু এবার তা ভিন্ন। গতবছরও ঈদুল আজহায় বন্যার কারণে পর্যটন ব্যবসায় ধস নামে। পর্যটক না আসায় সিলেটের পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত পড়েছে। বিশেষ করে হোটেল-মোটেল ব্যবসায়ীরা বেশি হতাশ। পর্যটক আকর্ষণ করতে ঈদের আগেই তারা হোটেল-মোটেল সংস্কার করে রেখেছিলেন। অনেক হোটেলের পক্ষ থেকে পর্যটকদের জন্য বিশেষ অফারও ঘোষণা করা হয়। একই অবস্থা পরিবহন ও রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ও।
সিলেট হোটেল মোটেল অ্যান্ড গেস্ট হাউস অনার্স অ্যাসোসিয়েশন সূত্র জানায়, সিলেটে প্রায় ৫০০ আবাসিক হোটেল ও গেস্ট হাউস রয়েছে। যেকোনো উৎসবের ছুটিতে এসব হোটেল মোটেল ও গেস্ট হাউস পর্যটকে পরিপূর্ণ থাকে। কিন্তু এবার বেশিরভাগ হোটেল খালি। মাত্র হাজার খানেক লোকের আগমন ঘটেছে সিলেটে।
এদিকে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে ঈদুল আজহায় টানা ৫ দিনের ছুটিতে পর্যটক বরণে আগে থেকেই প্রস্তুত করা হয়েছিল হোটেল, মোটেল, ইকো রিসোর্ট ও গেস্ট হাউজ। কিন্তু এবারের ঈদে বৃষ্টি থাকায় পর্যটন স্পটগুলো ছিল ফাঁকা। ঈদুল আজহার দীর্ঘ ছুটিতে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানসহ বিভিন্ন বিনোদনকেন্দ্রে নেই চিরচেনা দৃশ্য।
পর্যটন কেন্দ্র লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে দেখা যায়, সাধারণ ছুটির দিনের চেয়েও এবারের ঈদে লাউয়াছড়ায় দর্শনার্থীর সংখ্যা অনেক কম। এছাড়া মাধবপুর লেক, বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহি হামিদুর রহমান স্মৃতি কমপ্লেক্স ও সবুজ চা বাগানে দেখা যায়, ঈদের দিন দর্শনার্থীর সংখ্যা কম থাকলেও এর পরেরদিন শুক্রবারে কিছু লোকজন এসেছেন। শনিবারে সারাদিন বৃষ্টি হওয়ায় মানুষজন একেবারে কম দেখা যায়। তবে যারা ঘুরতে এসেছেন এদের বেশিরভাগই স্থানীয় দর্শনার্থী।
লাউয়াছড়া টিকেট কাউন্টারের দায়িত্বে থাকা শাহীন মাহমুদ বলেন, অন্যান্য বছরের তুলনায় ঈদের এই দুইদিন লাউয়াছড়ায় পর্যটকের সংখ্যা খুবই কম। অন্য সময় যেভাবে ভিড় থাকে এখন সে ভিড় নেই। যারা এসেছেন এরমধ্যে স্থানীয়দের সংখ্যা বেশি। বাইরের লোকজন কম এসেছে। ঈদের দিন বিদেশী পর্যটকসহ ২৯৪ জন, রাশিয়ান পর্যটক ছিলেন ২৭ জন। রাজস্ব আয় হয়েছে ২৬ হাজার টাকা। পরের দিন শুক্রবারে ১ হাজার ২শ’ জন। রাজস্ব আয় হয়েছে ৫৫ হাজার ৯৮২ টাকা ও শনিবার ৯৩২ জন দেশি-বিদেশি পর্যটক লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে প্রবেশ করেছেন। রাজস্ব আয় হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার টাকা। শাহীন মাহমুদ বলেন- অন্যান্য সময় ঈদের মৌসুমে লাউয়াছড়ায় প্রতিদিন কমপক্ষে তিন থেকে পাঁচ হাজার পর্যটক প্রবেশ করেন। সে তুলনায় বর্তমান এই সংখ্যা খুবই কম।
বনগাঁও অরণ্যনিবাস ইকো রিসোর্টের পরিচালক মো. এহ্সান কবির সবুজ বলেন, এবারে ঈদে গত ঈদের তুলনায় অর্ধেক রুম বুকিং হয়েছে। অতি বৃষ্টি ও বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা থাকায় বাহিরের পর্যটক কম এসেছে। বিভিন্ন ছাড় দেওয়ার পরেও পর্যটকদের সাড়া নেই।
ঈদের ৩য় দিন শনিবার সকাল থেকে বৃষ্টি শুরু হওয়ায় দুপুর পর্যন্ত পর্যটনস্থানগুলো মানব শূন্য ছিল। ছুটি শেষ হয়ে যাওয়ায় পর্যটকরা বিভিন্ন পরিবহনে করে লাউয়াছড়া ত্যাগ করতে দেখা যায়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে পরিবার নিয়ে ঘুরতে আসা শিক্ষিকা রুসনা বেগম বলেন, ঈদের ছুটিতে পরিবারের সবাইকে সময় দেওয়া যায়। তাই ঈদের ২য় দিন লাউয়াছড়া আসলাম। যদিও কয়েক বছর আগেও একবার শীতকালে এসেছিলাম, আশা ছিল এইবার নতুনত্ব কিছু পাবো, কিন্তু পেলাম না। নরসিংদী থেকে ঘুরতে আসা পর্যটক ব্যবসায়ী নাসির আহমদ বলেন, বৃষ্টির জন্য ঘুরে বেড়াতে সমস্যা হচ্ছে। হোটেল থেকে বিকেলে ঘুরতে এসেছি লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে। হবিগঞ্জ থেকে পরিবার নিয়ে ঘুরতে এসেছেন ডা. আব্দুল খালিক। তিনি বলেন, ঈদের ছুটি শুরুর পরের দিন ট্রেনে করে আমরা ভানুগাছ আসি। আসার দিন থেকে প্রতিদিন বৃষ্টি হচ্ছে এখানে। সবুজ প্রকৃতির মাঝে বৃষ্টি উপভোগ করছি। দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে দেখছি। বৃষ্টির কারণে সাময়িক সুবিধা হলেও প্রকৃতির সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে পেরেছি।
ট্যুরিস্ট পুলিশ দায়িত্বে থাকা পুলিশ পরিদর্শক প্রবাল সিনহা বলেন, লাউয়াছড়ায় সাধারণ সময়ে যে ভিড় থাকে ঈদের ছুটিতে এইদুইদিন ভিড় নেই বললেই চলে। রাস্তাও ছিল ফাঁকা। তিনি বলেন- হয়তো দু’একদিন মধ্যে পর্যটকের সংখ্যা বাড়তে পারে।
এদিকে লাউয়াছড়া সংরক্ষিত জাতীয় উদ্যানে পর্যটক শূন্যতাকে আশীর্বাদ হিসেবে দেখছেন পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষকেরা। তারা মনে করেন সংরক্ষিত বনে পর্যটকের উপস্থিতি কম মানে জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি কম হবে। বনের বাসিন্দা পশুপাখি কম উত্যক্ত হবে। তারা ভালো থাকবে। অফিসার ইনচার্জ সঞ্জয় চক্রবর্তী বলেন, পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য ট্যুরিস্ট পুলিশের পাশাপাশি কমলগঞ্জ থানা পুলিশ কাজ করছে। তবে গত ঈদের তুলনায় এবছর পর্যটক অনেক কম এসেছেন।