এবারো চামড়ায় হতাশা !
প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ জুলাই ২০২৩, ১২:৩২:৩৪ অপরাহ্ন
এমজেএইচ জামিল : সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে চামড়াজাত পণ্যের দাম কয়েকগুণ বাড়লেও দিন দিন কমছে চামড়ার মূল্য। গেল কয়েক বছর ধরে নায্যমূল্য না পাওয়ায় কুরবানীর পশুর চামড়া পানিতে ফেলতে ও মাটিতে পুতে ফেলতে দেখা গেছে। এবারো সেই পুরনো বৃত্ত থেকে বের হতে পারেনি চামড়া শিল্প। সরকার নির্ধারিত দাম দূরে থাক, নামমাত্র মূল্যেও সংগ্রহ হয়নি কুরবানী হওয়া সকল পশুর চামড়া। তাই কেউ কেউ বাধ্য হয়ে পানিতে ফেলে দিয়েছেন একসময় বৈদেশিক মূদ্রা অর্জনে এগিয়ে অন্যতম শীর্ষ রপ্তানী পণ্য চামড়া।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সিলেট বিভাগের এবছর ৪ লক্ষাধিক পশু কুরবানী হয়েছে। কিন্তু বিভাগে অর্ধেক পশুর চামড়াও সংগ্রহ হয়েছে কিনা তা নিয়ে সংশয় সিলেটের পাইকারী চামড়া ব্যবসায়ীদের। যদিও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ও বিসিক সূত্র জানিয়েছে এবছর ছাগল-ভেড়া চামড়া নিয়ে অনাগ্রহ থাকায় সংগ্রহ কম হলেও গরু-মহিষের কোন চামড়া নষ্ট হয়নি। তবে মাঠের পরিস্থিতি অনেকটা বিপরীতমূখী। ঈদুল আযহার দিন সকাল থেকে সারাদিন বৃষ্টি ঝরায় কুরবানী শেষে পশুর চামড়া অনেকের বাড়ীর আঙ্গিনা পড়ে থাকার খবর পাওয়া গেছে। বিনামূল্যেও কেউ চামড়া না নেয়ায় শেষ পর্যন্ত বানের পানিতে ভাসিয়ে দিয়েছেন কেউ কেউ। আবার পরিবেশের কথা চিন্তা করে কেউ কেউ সন্ধ্যার পর মাটিতে পুতে ফেলতে বাধ্য হয়েছেন। সিলেট নগরী, জেলা শহরের পাশর্^বর্তী উপজেলা সমূহে চামড়ার বাজার মূল্য এবং চাহিদা থাকলেও গ্রাম পর্যায়ের পরিস্থিতি ঠিক এর উল্টো। বিগত সময়ে মাদ্রাসা এবং মৌসুমী ব্যবসায়ীরা চামড়া সংগ্রহ করে থাকলেও এবছর অধিকাংশ মাদ্রাসা যেমন চামড়া সংগ্রহ করেনি আবার অনেক মৌসুমী ব্যবসায়ী চামড়ার ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন। ফলে একদিকে চামড়ার ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত হয়নি, অপরদিকে ভাটা পড়েছে চামড়া সংগ্রহে।
এদিকে গেল বছরে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে মাদ্রাসায় সংগ্রহ করা চামড়া সংগ্রহ করা হয়। পরবর্তীতে সেটা বাজারজাত করে অর্জিত টাকা মাদ্রাসার কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেয়া হয়। কিন্তু এবার সিটি কর্পোরেশন থেকে চামড়া সংগ্রহ করা হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিলেট বিভাগের ৪ জেলায় এবার এবার ৪ লক্ষাধিক পশু কুরবানী দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ২ লাখ গরু, ১৫০০ মহিষ, ২ লাখ ছাগল-ভেড়া রয়েছে। সরকার থেকে দাম নির্ধারণ করা হলেও এবারো চামড়ার ন্যায্যমূল্য মিলেনি। খুচরা বিক্রেতারা একেবারেই কম মূল্যে চামড়া বেচে দিতে বাধ্য হয়েছেন। মাঝারি কিংবা বড় গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে ২০০ থেকে সর্বোচ্চ ৪০০ টাকায়। একইভাবে নামমাত্র দামে বিক্রি হয়েছে ছাগল ও ভেড়ার চামড়া। আবার কিছু স্থানে গরুর চামড়ার সাথে ফ্রি দেয়া হয়েছে ছাগল-ভেড়ার চামড়া। কোথাও কোথাও ছাগলের চামড়া বিক্রি হয়েছে ১০-২০ টাকায়। সব মিলিয়ে হতাশ হয়েছেন পশুর মালিক ও চামড়ার খুচরা ব্যবসায়ীরা।
সিলেটের আড়তদার ও ব্যবসায়ীরা বলেছেন, লবণের দাম বেড়ে যাওয়া, শ্রমিকের মজুরি বেড়ে যাওয়া ও ট্যানারি মালিকদের কাছে বকেয়া থাকায় চামড়া ব্যবসা গভীর সঙ্কটে পড়েছে। এসব কারণেই নির্ধারিত দামের চেয়ে কম দামে চামড়া কিনতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। যদিও ঈদের আগে সরকারিভাবে চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। এতে প্রতি বর্গফুট গরুর লবণযুক্ত কাঁচা চামড়ার দাম ৪৭-৫২ টাকা ও ঢাকার বাইরে ৪০-৪৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়। খাসির লবণযুক্ত চামড়ার দাম প্রতি বর্গফুট ১৮-২০ টাকা ও বকরির চামড়া ১২-১৪ টাকা। গত বছরের তুলনায় এবার গরুর চামড়া প্রতি বর্গফুট ৭ টাকা এবং খাসির চামড়া ৩ টাকা বাড়ানো হয়। তবে সরকার নির্ধারিত দামে সিলেটে চামড়ার বেচাকেনা হয়নি। সংগ্রহ করা চামড়াগুলো কাঁচা। সিলেটের কোথাও ফুট ধরে চামড়া বিক্রি হয়নি। অনুমান করে পশুর সাইজের উপর ভিত্তি করে পিস হিসেবেই চামড়া বিক্রি হয়েছে। সর্বনিম্ন ২০০ থেকে সর্বোচ্চ ৪০০ টাকায় এবার চামড়া বিক্রি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।
সিলেটের পাইকারী ব্যবসায়ীরা জানান, গেল কয়েক বছর ধরে রাজধানীর ট্যানারি মালিকদের কাছে সিলেটের বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীদের অর্ধকোটি টাকার বেশী আটকে আছে। ফলে চামড়া ব্যবসায় সিলেটের অনেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। তবে গত দুই মৌসুম থেকে ট্যানারি মালিকরা অল্প করে বকেয়া পাওনা টাকা পরিশোধ করছেন। এবার কয়েকজন ব্যবসায়ী চামড়া সংগ্রহও করছেন। তবে তা গেল বছরের কম বলে জানান তারা।
ব্যবসায়ীদের মতে, গেল ঈদে সিলেট জেলায় প্রায় ৮০ হাজার গরু-মহিষের চামড়া সংগ্রহ করা হয়েছে। এর মধ্যে সিলেট নগরে চামড়া কিছুটা বেশি দামে ও গ্রামাঞ্চলের চামড়া কম দামে কিনেছেন ব্যবসায়ীরা। এসব চামড়া লবণ দিয়ে প্রক্রিয়াজাত করে গুদামে রাখার ব্যবস্থা করা হয়ছে। ১৫/২০ দিনের মধ্যে সেগুলো ট্যানারি মালিকদের কাছে বিক্রি করা হবে। নগরীর শামীমাবাদ এলাকার আশরাফ চৌধুরী জানান, কুরবানীর চামড়া বিক্রি করে অর্জিত টাকা আল্লাহর রাস্তায় বিলিয়ে দিতাম। কিন্তু দিন দিন চামড়ার কদর কমছে, দান থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন অসহায় মানুষ। এবছর ১ লাখ টাকা দিয়ে কেনা গরুর চামড়া বিক্রি করেছি মাত্র ২৫০ টাকা।
তিনি বলেন, আজ থেকে ১০ বছর আগেও যে চামড়া ১২০০-১৫০০ টাকায় বিক্রি হতো এখন সেটি ২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ছাগলের চামড়া ব্যবসায়ীরা নিতেই চান না। সেগুলো বিনামূল্যে দিয়ে দিতে হয়। সিলেটে কুরবানী দেয়া এমন কয়েকজনের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, তারা আগে কুরবানির পশুর চামড়া মাদ্রাসায় দান করতেন না হয় বিক্রি করে দিতেন। সেই টাকা মাদ্রাসার ইয়াতিম খানায় দান করতেন। চামড়ার দাম ক্রমাগত কমতে থাকায় অনেকে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ চামড়া সংগ্রহ ছেড়ে দিয়েছেন। নামমাত্র কয়েকটি মাদ্রাসা চামড়া সংগ্রহ করলেও এভাবে দাম কমতে থাকলে, তারাও চামড়া সংগ্রহ বাদ দিতে বাধ্য হবে।
সুনামগঞ্জ জেলার শান্তিগঞ্জ উপজেলার তেরহাল গ্রামের বাসিন্দা ইউসুফ বিন অকিল দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, আমিসহ আমার গ্রামে ৩০টির মতো পশু কুরবানী হয়েছে। কোন পশুর চামড়া বিক্রি হয়নি। ঈদের পরদিন সকাল পর্যন্ত অপেক্ষার পর এলাকার মুচি সম্প্রদায় স্বউদ্যোগে ফ্রিতে চামড়া নিয়ে যায়। এমন অবস্থা শান্তিগঞ্জ উপজেলার জামলাবাদ, হাসনাবাদ, নোয়াখালী গ্রামে। একদিন পর বিনামূল্যে স্থানীয় মুচিদের কাছে চামড়া তুলে দেন এলাকার মানুষ।
এ ব্যাপারে চামড়া সংগ্রহকারী একাধিক মুচি জানান, চামড়ার বাজার আগের মত নাই। তাই আমরা এখন চামড়া ক্রয় করিনা। কারণ ১ কেজি লবনের দাম এখন ৪৫ টাকা। একটি চামড়ায় সর্বনিম্ব ৫ থেকে সর্বোচ্চ ৮ কেজি লবণ লাগে। আর আমরা লবনজাত চামড়া ছাড়া কাচা চামড়া বিক্রি করতে পারিনা। একটি চামড়ায় ২ থেকে ৩০০ টাকার লবণ লাগে। চামড়া কিনে লবণ দিয়ে আমাদের লাভ দুরে থাক লোকসান দিতে হবে। তাই আমরা এলাকার মানুষদের বলেছি পানিতে না ফেলে কিংবা মাটিতে না পুতে আমাদেরকে বিনামূল্যে দিয়ে দিন। আমরা যদি কিছু পাই তাহলে আমাদের আয়ের একটা পথ হবে। আর এলাকার মানুষ আমাদেরকে চামড়া ফ্রি দিয়েছে।
জানা গেছে, সুনামগঞ্জ জেলাজুড়ে ঈদুল আযহার দিন সকাল থেকে সারাদিন মুষলধারে বৃষ্টি হওয়ায় মৌসুমী ব্যবসায়ীরা ঠিকমতো গ্রামে যেতে পারেনি। তাই চামড়া সংগ্রহে ভাটা কিছুটা ভাটা পড়ে যায়।
সিলেটের শাহজালাল চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সহ-সভাপতি শাহীন আহমদ দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, এবছর সিলেট জেলায় ৮০ হাজারের মতো চামড়া সংগ্রহ হয়েছে। সাইজভেদে প্রতি পিস চামড়া ২০০ থেকে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা পর্যন্ত চামড়া বিক্রি হয়েছে। ছাগল-ভেড়ার চামড়ার বাজার দর কম থাকায় এসবে আগ্রহ কম ছিল। তাই নামমাত্র দরে কেউ কেউ এই চামড়া সংগ্রহ করেছেন। সিলেট নগরী কিংবা জেলার কোন উপজেলায় চামড়া বিনষ্ট হয়েছে বলে আমরা শুনিনি।
এ ব্যাপারে নগরীর ঝালোপাড়ার চামড়া ব্যবসায়ী কাশেম মিয়া দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, এবার গত বছরের অর্ধেক চামড়া সংগ্রহ হয়েছে। কারণ আমাদের হাতে পর্যাপ্ত টাকা নেই। এছাড়া ঢাকায় ট্যানারী মালিকদের কাছে আমাদের বকেয়া টাকা পাওনা রয়েছে।
তিনি বলেন, সবকিছুর দাম বাড়ছে, লবণের দামও বেড়েছে। কিন্তু আমাদের মূলধন তেমন বাড়ছেনা। আমরা লবণ দিয়ে সর্বোচ্চ ৩ মাস পর্যন্ত চামড়া রাখতে পারি। এরপর আমাদেরকে ট্যানারী মালিকদের কাছে যেতে হবে। কিন্তু ট্যানারী মালিকগণ প্রতি বছর বকেয়া রাখে। গত ৬/৭ বছর থেকে ট্যানারী মালিকগণ আমাদেরকে নগদ পরিশোধ না করায় আমাদের পুজি ক্রমশ কমছে। অনেকেই চামড়া ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছে।