পর্যটন স্পট সাদাপাথর-জাফলং : সিলেটে বাঁধনহারা দর্শনার্থী
প্রকাশিত হয়েছে : ১৪ জুলাই ২০২৩, ১১:৪৫:১৫ অপরাহ্ন
ঘটছে মৃত্যুসহ নানান দুর্ঘটনা
মুনশী ইকবাল: পর্যটন নগরী সিলেট, রূপের রাণী সিলেট ময়ুরের পেখমের মতো বর্ষায় মেলে ধরে তার সৌন্দর্য্যরে ডানা। দূর পাহাড়ের গায়ে ভেসে বেড়ানো টুকরো টুকরো সাদা মেঘ, কোথাও পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা ঝরনাধারা। ঝরনার পানির কলকল শব্দে ছুটে চলা ও শীতল স্পর্শে প্রাণ জুড়িয়ে যায় নিমেষে। পাহাড়, নদী, মেঘ, জলাবন আর ঝরনা যেন একে অপরকে আলিঙ্গন করে আছে। নগরজীবনের যান্ত্রিকতা পেছনে ফেলে প্রকৃতির মধ্যে দুদণ্ড ডুব দিতে সবাই ছুটে আসেন সিলেটে। সিলেট থেকে দর্শনীয় স্থানগুলোতে যাওয়ার পুরো পথই প্রকৃতি তার সৌন্দর্যে বিমোহিত করবে যে কাউকে। পিচঢালা পথের দুই পাশে এখন বিশাল জলরাশি আর পাহাড়। গাড়ির জানালা খুলে দিলেই হু হু ঠান্ডা বাতাস শরীর জুড়িয়ে দেয়। আর তাই জাফলং, বিছনাকান্দি, রাতারগুল কিংবা সাদাপাথর দর্শনার্থীদের টানে চুম্বুকের মতো। এরমধ্যে যাতায়াতসহ নানান সুবিধা ও সৌন্দর্য্যে সবারকাছে পছন্দের শীর্ষে সাদাপাথর ও জাফলং। সাদাপাথর গত কয়েকবছর আর জাফলং সেই আশির দশক থেকে সিলেট ভ্রমণে আসা দর্শনার্থীদের আকর্ষণ করছে। এই আকর্ষণের টানে এসে অনেকে মুগ্ধ হয়ে বাড়ি ফিরেন, মাঝে মধ্যে কাউকে অসাবধানতাবশত পানিতে ডুবে লাশ হয়েও ফিরতে হয়। সৌন্দর্য্য ছাপিয়ে পর্যটক নিখোঁজের ঘটনায় জায়গা দুটো তখন অন্যরকম শিরোনাম হয়ে ওঠে। সম্প্রতি তিনজন নিখোঁজের পর লাশ ভেসে ওঠার ঘটনায় তা আবারও সামনে এসেছে। প্রতিবছরের বর্ষা মৌসুমে সিলেটের এ দুই পর্যটনকেন্দ্রে বেড়াতে গিয়ে পর্যটকেরা পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার একাধিক ঘটনা ঘটছে।
৪ জুলাই মঙ্গলবার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার পর্যটনকেন্দ্র সাদাপাথরে সাঁতারে নেমে নিখোঁজ হওয়ার প্রায় ৪৪ ঘণ্টা পর আবদুস সালাম (২৩) নামের এক পর্যটকের লাশ পাওয়া যায়। সকাল ১০টার দিকে কোম্পানীগঞ্জের ধলাই নদের উৎসমুখে লাশটি ভেসে ওঠে। আবদুস সালাম ঢাকার মিরপুর-১১ এলাকার মৃত আবুল কালামের ছেলে। এর আগে গত ২ জুলাই রোববার বেলা আড়াইটার দিকে সাদাপাথর পর্যটনকেন্দ্রে পানিতে নেমে সাঁতার দিতে গিয়ে নিখোঁজ হন তিনি। এরপর থেকে তাঁর সন্ধানে কাজ করছিল উপজেলা প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশসহ স্থানীয় বাসিন্দারা।
পরের সপ্তাহেই ১০ জুলাই সোমবার সকালে ধলাই নদে নৌকাডুবিতে নিখোঁজ আফিক মিয়ার (৪৩) লাশ তিন দিন পর পাওয়া যায়। ধলাই নদের রেলওয়ে বাংকারের পূর্বপাশের এলাকা থেকে লাশটি উদ্ধার করে পুলিশ। এর আগে গত ৭ জুলাই শুক্রবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে সাদা পাথর এলাকায় নৌকাডুবিতে নিখোঁজ হয়েছিলেন আফিক। তাঁর বাড়ি উপজেলার পূর্ব ইসলামপুর ইউনিয়নের কালীবাড়ি গ্রামে।
এরওআগে সিলেটের জাফলংয়ে পিয়াইন নদে গোসলে নেমে নিখোঁজ ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র আল ওয়াজ আরশের (১৫) লাশ উদ্ধার করা হয়। নিখোঁজের দুদিন পর ৮ জুলাই শনিবার সকাল ৭টার দিকে পিয়াইন নদের জিরো পয়েন্টে এলাকা থেকে লাশটি উদ্ধার করে পুলিশ। আরশদের বাড়ি কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার শিদলাই গ্রামে। তার বাবা জাহিদুল হোসেন পুলিশ পরিদর্শক (ট্রাফিক) হিসেবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কর্মরত। এসব কারণে আবারও আলোচনায় সাদাপাথর ও জাফলং।
সিলেটের সীমান্তবর্তী উপজেলা কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ সাদাপাথর। পাহাড়ের কোলে ধলাই নদের উৎসমুখে সাদাপাথর এলাকার অবস্থান। পাহাড়-পাথর আর স্বচ্ছ জলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে যেকোনো উৎসবে এখানে ছুটে আসেন মানুষ। পরিবার-পরিজন নিয়ে ধলাই নদের বুকে স্বচ্ছ জল আর সাদা পাথরের মুগ্ধতায় মন ভরিয়ে নেন তারা। জল-পাথরে এই বসতিতে আনন্দে সময় কাটান ছোট-বড়ো সবাই।
একই চিত্র সিলেটের সীমান্তবর্তী আরেকজনপদ গোয়াইনঘাট উপজেলায় অবস্থিত দীর্ঘদিন থেকে দেশের পরিচিত পর্যটন এলাকা জাফলংয়েও। পিয়াইন নদের স্বচ্ছ জলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে সারা বছরই এখানে কমবেশি পর্যটক বেড়াতে আসেন।
কিন্তু বেড়াতে এসে অনেকেই নিয়ম মানেন না। ইদানীং সবচেয়ে উদ্বেগের যে বিষয়টি লক্ষ করা গেছে তা হলো পর্যটনের মূল স্পট থেকে কেউ কেউ ছড়িয়ে যান কিছুটা দূরে অন্যদিকে। অপেক্ষাকৃত তরুণরা এটা বেশি করে থাকেন। তারা নিরিবিলি নিজেদের মতো পানিতে ঝাঁপাঝাঁপি করতে এসব স্থান বেছে নেন। বর্ষায় নদীতে থাকে প্রবল স্রোত। ফলে যেকোনো সময় তাদের ভেসে যাওয়ার শঙ্কা থেকে যায়। বুধবার বিকেলে ভোলাগঞ্জ ১০ নম্বর ঘাটে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধে দেখা যায় এমনই এক চিত্র। দেখা যায় বাঁধের বিশালাকৃতির বালির বস্তার উপর দিয়ে হেঁটে ধলাই নদের দিকে যাচ্ছেন কয়েকজন তরুণ। কুমিল্লা থেকে একটি গ্রুপ করে তারা এসেছেন, সবার গায়ে একই রঙের টি-শার্ট। বালির বস্তা পেরিয়ে ঝাঁপ দিয়ে তাদের পানিতে নামতে দেখা যায়। নদের তখন তীব্র স্রোত আর উত্তাল হাওয়া। এরআগেই কয়েকজন পৌঁছে পানিতে নেমে ঝাঁপাঝাঁপি করছিলেন। একেবারে নিরিবিলি এই স্থানে স্রোতের টানে তারা ভেসে গেলে দেখার কেউ ছিলেন না। বর্ষার এই সময় তা ছিল খুব বিপজ্জনক।
স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে জানা যায় নদের পানি বর্ষা মৌসুমে বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। তাই এ সময় পর্যটকদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়। স্রোতের পানিতে না নামতে বলা হয়। কিন্তু মানুষের মধ্যে এসব নিষেধাজ্ঞা শোনার প্রবণতা কম থাকে। তাদের মতে শুধু পুলিশ ও প্রশাসন নয়, পর্যটকদের সচেতন ও সতর্ক করার জন্য স্থানীয় মানুষজনেরও সম্পৃক্ত হওয়া প্রয়োজন। স্রোতের পানিতে না নামার পাশাপাশি পানিতে নামলে লাইফ জ্যাকেট পরার দিকে নজর রাখা প্রয়োজন।
তারা জানান, বর্ষা মৌসুমে হ্যান্ডমাইক নিয়ে দুজন স্বেচ্ছাসেবী সার্বণিক পর্যটনকেন্দ্রে থাকেন। তাঁরা পর্যটকদের স্রোতের পানিতে না নামার আহ্বান জানান। নৌকার ঘাটে সাইনবোর্ড দিয়ে পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ঝুঁকিপূর্ণভাবে পানিতে না নামতে নির্দেশনা দেওয়া রয়েছে। এরপরও মানুষ এগুলো শুনতে চান না।
স্থানীয় বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাথরগুলো পানিতে থাকার কারণে এতে শেওলা জমে। এ শেওলায় পা পিছলে অনেকে পড়ে যান। এ সময় পানির স্রোত বেশি থাকায় ভাসিয়ে নিয়ে যায়। আবার কখনো পা পিছলে গিয়ে পাথরে পড়ে মাথায় আঘাত পান। এতে জ্ঞান হারিয়ে পানিতে ভেসে যাওয়ার ঘটনাও ঘটে।
স্রোতের স্বচ্ছ পানি দেখে অনেকে লোভ সামলাতে না পেরে সাঁতার না জানলেও গোসলের জন্য পানিতে নেমে পড়েন। স্বচ্ছ পানি থাকায় গভীরতা বোঝা যায় না বলে পর্যটকেরা গভীর পানিতে চলে যান। এতে বর্ষার বাড়ন্ত পানি ভাসিয়ে নিয়ে যায়। অনেকে স্রোতের পানিতে গা ভাসিয়ে রাখেন। এ সময় স্রোতে তালিয়ে যান। ভোলাগঞ্জে স্থানীয় সাংবাদিক আব্দুল জলিল বলেন, পর্যটন স্পটে কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। দর্শনার্থীরা কোনো নিয়ম শৃঙ্খলা না মেনেই পানিতে নামেন, এতে তারা প্রায়ই দুর্ঘটনায় পতিত হন। প্রশাসন ও ইজারাদারদের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। তিনি বলেন, ইজারাদারদের পক্ষ থেকে লোক নিয়োগ করা আছে তারা মাইকিং করে দর্শনার্থীদের সতর্ক করেন। কিন্তু কেউ তাদের কথা শুনে না। তাই এখনই যদি প্রশাসনিক ভাবে কঠোর সিদ্ধান্ত না নেওয়া হয় তবে দুর্ঘটনা আরও ঘটার আশক্সক্ষা আছে। এক্ষেত্রে প্রশাসনের পক্ষ থেকে যদি পানিতে নামার জন্য একটা সীমানা নির্ধারণ করে দেওয়া হয় যার বাইরে কেউ পানিতে নামতে পারবেন না, তাহলে তা ইতিবাচক হতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমরা অনেক সময় আবেগপ্রবণ হয়ে যাই। যার কারণে বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে সাঁতার না জানলেও স্রোতের পানিতে নেমে পড়ি। এতে দুর্ঘটনা ঘটে। মানুষের শরীর দৌড়াদৌড়ির পর কিংবা হাঁটাহাঁটির পর গরম হয়ে যায়। সে অবস্থায় পানিতে নামলে শরীরের মাংসপেশি ঠান্ডা হয়ে যায়। আর এমনিতে পাহাড় বেয়ে নেমে আসা পানি পাথর ছুঁয়ে ঠান্ডা অনুভূত হয়। এমন অবস্থায় পানিতে নামলে শরীর নাড়াচাড়া করা সম্ভব হয় না। এতে সাঁতার জানলেও স্রোতের টানে পানিতে চলে গিয়ে ডুবে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। এর জন্য যাঁরা সাঁতারু, তাঁরা সাঁতারে নামার আগেই শরীরের সঙ্গে পানির একটি যোগসূত্র তৈরি করেন। সাঁতারের আগে পানিতে কিছু সময় তাঁদের হাত নাড়াতে দেখা যায়। আবার হাত-পা পানিতে ভিজিয়ে নেন অনেকে। পরে পানিতে নামেন। তাছাড়া নদের পানিতে বালু থাকে। বালুতে দাঁড়িয়ে থাকলে স্রোতের পানির সঙ্গে পায়ের নিচের বালুগুলো সরে যায়। এতে অভ্যস্ত নন পর্যটকেরা। অনেক সময় এর ফলে ভয়ে হার্ট অ্যাটাকও করেন অনেকে।
ট্যুরিস্ট পুলিশ সিলেটের সুপার মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেন বলেন, পর্যটকদের নিরাপত্তার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। সাদা পাথরে ট্যুরিস্ট পুলিশের ক্যাম্প স্থাপনের জন্য জেলা প্রশাসকের সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।