নগরে ফিরেছে যানজট, বেড়েছে দুর্ভোগ
প্রকাশিত হয়েছে : ১৮ জুলাই ২০২৩, ৬:১৭:৩৪ অপরাহ্ন
ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দের উদ্বেগ, সিসিক ও প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা
এমজেএইচ জামিল : নগরীতে যানজট কমাতে উদ্যোগের অন্ত ছিল না বর্তমান বিদায়ী মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর। ২০২১ সালের ১ জানুয়ারী থেকে নগরীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এলাকা বন্দরবাজার-জিন্দাবাজার-চৌহাট্টা সড়কে রিক্সা ও ভ্যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দেয় সিলেট সিটি কর্পোরেশন। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে নিয়োগ করা হয় নিরাপত্তাকর্মী। কিন্তু শেষবেলায় এসে নিষেধাজ্ঞা মানছেনা কেউ। অবাধে চলছে রিকশা, ভ্যান ও ঠেলাগাড়ি। ফলে ব্যস্ততম সড়কটিতে বেড়েছে যানজট। এর রেশ ছড়িয়ে পড়ছে নগরীর অন্যান্য পয়েন্টে। একদিকে রিক্সা, অপরদিকে হকারদের দৌরাত্মে এক দুর্ভোগের এলাকায় পরিনত হয়েছে বন্দরবাজার-চৌহাট্টা সড়ক।
এদিকে নগরীর ব্যস্ততম এলাকা আম্বরখানা, চৌহাট্টা, জিন্দাবাজার, বন্দরবাজার জুড়ে হকারদের দৌড়াত্ম বেড়ে যাওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ দোকান মালিক সিমিতি সিলেট জেলা শাখা, মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স ও সিলেট মহানগর ব্যবসায়ী ঐক্য কল্যাণ পরিষদের নেতৃবৃন্দ। সোমবার রাতে গণমাধ্যমে প্রেরিত এক বিবৃতিতে এ ব্যাপারে সিসিক ও প্রশাসনের সহযোগিতা কামনা করেন তারা।
সোমবার সরেজমিনে দেখা গেছে, চৌহাট্টা পয়েন্ট থেকে অবাধে চলছে বন্দরবাজারমুখী রিক্সা। আগে এই পয়েন্টে সিসিকের কর্মচারীরা থাকলেও এখন নেই। ফলে বিনা বাধায় চলছে রিক্সা। ফলে জিন্দাবাজার পয়েন্ট থেকে শুরু করে বন্দরবাজার পর্যন্ত শুরু হয়ে তীব্র যানজট। এদিকে চৌহাট্টা থেকে কোর্ট পয়েন্ট পর্যন্ত অবাধে ব্যবসা করছেন হকাররা। আগে রাতের বেলায় বসলেও এখন দিনের বেলায় ফুটপাতের পাশাপাশি রাস্তার একটা বিশাল অংশ দখল নিয়ে দেদারসে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে হকাররা। অপরদিকে নগরীর লাললিঘীর পারস্থ অস্থায়ী হকার মার্কেট খালি পড়ে আছে। নামমাত্র কয়েকজন ব্যবসায়ী এখানে ব্যবসা করলেও অধিকাংশ দোকান খালি পড়ে আছে। যেসব দোকানদাররা এখানে ব্যবসা করছেন তারাও সন্ধ্যার পর চলে আসেন ফুটপাতে। ফলে সন্ধ্যার পর থেকে নগরীর ব্যস্ততম এলাকার বন্দরবাজার পয়েন্টটি চলে যায় হকারদের দখলে।
জানা গেছে, আগে মেয়র আসছেন, পালাতে হবে, এমন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা থাকলেও বর্তমানে অনেকটা নির্দ্বিধায় ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন হকাররা। এজন্য শেষ সময়ে এসে মেয়র আরিফুল হকের দায়সারা দায়িত্ব পালনকে দায়ী করছেন কেউ কেউ। তারা বলছেন, আরিফুল হক চৌধুরী নগরীর ফুটপাত হকারমুক্ত রাখতে এবং নগরীকে যানজটমুক্ত রাখতে অনেক সাহসী ও সময়োপযোগী উদ্যোগ নিয়েছিলেন। নগরীর উন্নয়নে তার অবদান সিলেটবাসী কখনো ভুলবে না। যতদিন মেয়রের পদে আছেন অন্তত ততদিন তিনি ধারাবাহিকভাবে তার দায়িত্ব পালন করবেন বলে প্রত্যাশা সচেতন নাগরিকের। নতুন মেয়র দায়িত্ব নিলে পরবর্তীতে কি উদ্যোগ নেন তাও পর্যালোচনায় আসবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সোমবার নগরীর চৌহাট্টা, সুরমা পয়েন্ট, লামাবাজার, রিকাবী বাজার, সোবহানীঘাট পয়েন্ট, নাইওরপুল পয়েন্ট, সুবিদবাজার পয়েন্টে তীব্র যানজট দেখা দেয়। সুবিদবাজার পয়েন্টে যানজটের জন্য রাস্তার পাশের্^ স্থাপিত কয়েকটি অভিজাত শ্রেণীর সন্তানদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে দায়ী করছেন স্থানীয়রা। অনেকের অভিযোগ ব্যয়বহুল খরচের এসব প্রতিষ্ঠানের সকল শিক্ষার্থী ভিআইপিদের সন্তান। এসব প্রতিষ্ঠানের একটিরও নিজস্ব পার্কিং নেই। তাই স্কুল ছুটির আধাঘন্টা আগেই রাস্তার দুই পাশে সারিবদ্ধভাবে দাড়িয়ে থাকে দামী গাড়ী। স্কুল ছুটির পরও জ্যাম সারতে একঘন্টারও বেশী সময় লাগছে। এই সময় চরম দুর্ভোগের শিকার হন পাবলিক যানবাহনে চলাচলকারী যাত্রী সাধারণ।
নগরের ভুক্তভোগীরা বলছেন, গত কয়েকদিন থেকে নগরীতে যানজট বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিদিন বেলা ১১টা থেকে নগরে রাত ১১টা পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে যানজট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। এছাড়া নগরীর ভেতরে দিনের বেলা মালবাহী ট্রাক ঢুকে পড়তে দেখা গেছে। এতে যানজট আরও প্রকট আকার ধারণ করছে।
সোমবার বেলা দুইটার দিকে নগরীর জিন্দাবাজার এলাকায় রিকশায় বসা ছিলেন নগরের মির্জা জাঙ্গাল এলাকার বাসিন্দা তামিম হোসাইন। একপর্যায়ে রিকশা থেকে নেমে তিনি হাঁটা শুরু করেন। তানভীর বলেন, বাসা থেকে বের হয়ে জেল জিন্দাবাজারে আসতে তাঁর প্রায় ২৫ মিনিটের মতো সময় লেগেছে। যদিও হেটে আসতেও এ পথে ১০ মিনিটে জিন্দাবাজার পৌঁছে যাওয়ার কথা। কিন্তু তীব্র যানজটে ২৫ মিনিট আটকে থাকেন। শেষ পর্যন্ত হেঁটেই জিন্দাবাজারের দিকে রওনা হয়েছেন। তার গন্তব্য ছিল জেলরোড।
নগরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, জেল রোড থেকে পূর্ব জিন্দাবাজার, বন্দরবাজার থেকে চৌহাট্টা মোড়, মিরবক্সটুলা থেকে চৌহাট্টা মোড়, আম্বরখানা থেকে চৌহাট্টা মোড়, রিকাবীবাজার থেকে লামাবাজার, বন্দরবাজার এলাকা, কালীঘাট ও মহাজনপট্টি এলাকা, বন্দরবাজার থেকে তালতলা, কাজিরবাজার, আম্বরখানা থেকে মিয়া ফাজিলচিস্ত, নাইওরপুল এলাকা, মিরাবাজার থেকে রায়নগর, শিবগঞ্জ এলাকা, সোবহানীঘাট থেকে মেন্দিবাগ ও হুমায়ুন রশীদ চত্বরে বেলা ১১টার পর থেকে থেমে থেমে তীব্র যানজট ছিল।
সোমবার বিকেল ৫টার দিকে নগরীর লামাবাজার সড়কে ওসমানী মেডিকেল থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় বন্দরবাজারের দিকে আসছিলেন আনসার উদ্দিন। তিনি বলেন, মেডিকেল থেকে বন্দরবাজার যাওয়ার জন্য তাঁরা সিএনজিচালিত অটোরিকশায় উঠেছিলেন। প্রথমে একবার লামাবাজার পয়েন্টে, আরেকবার তালতলা পয়েন্টে যানজটে পড়ে যান। সুরমা পয়েন্ট পার কোর্ট পয়েন্টেও তীব্র যানজট দেখে শেষ পর্যন্ত কোর্টের গেইটে নেমে হেটে বন্দরবাজার আসেন। ওসমানী মেডিকেল থেকে বন্দরবাজার আসতে সিএনজি অটোরিক্সার যেখানে ১৫ থেকে ২০ মিনিটে আসার কথা সেখানে তার সময়ে লেগেছে প্রায় ৫০ মিনিট। এই পথে তাকে ৩০ মিনিট যানজটে পড়ে থাকতে হয়। কয়েক দিন আগেও শহরে এমন যানজট ছিল না। তালতলা পয়েন্ট থেকে কোর্টপয়েন্ট পর্যন্ত রাস্তার উভয়পাশে হকারদের ভ্যানগাড়ীর সারি দেখে মনে হয় এটা যেন স্থায়ী হকার মার্কেট। এই দুর্ভোগ থেকে মুক্তির জন্য নগর কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি।
এদিকে সোমবার নগরীর জেল রোড-জিন্দাবাজার সড়কে দেখা গেছে, নগরের জেল রোড থেকে পূর্ব জিন্দাবাজার এলাকা পর্যন্ত যানবাহনের তীব্র চাপ। সড়কে দীর্ঘ যানজট লেগে আছে। মূলত বারুতখানা মোড়ে হাওয়া পাড়া থেকে বারুতখানা সড়কে গলির সড়কে যানবাহন চলাচল করায় মূল সড়কে যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া জিন্দাবাজার-জেল রোড সড়কের সড়কের পাশে বেশ কয়েকটি যানবাহন যত্রতত্রভাবে পার্কিং করা।
সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের ডিসি (ট্রাফিক) মুহাম্মদ আব্দুল ওয়াহায দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, গেল কয়েকদিন আফগানিস্তান ও বাংলাদেশ ক্রিকেট টীমের খেলাকে কেন্দ্র করে নগরে যানজট কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছিল। এখনো যানজট তুলনামূলক কম। তবে আমাদের ট্রাফিক বিভাগ যানজট নিরসনে কাজ করছে। কিন্তু যত্রতত্র পার্কিংয়ের কারণে যানজট নিরসনে আমাদেরকে বেগ পেতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, জিন্দাবাজার-চৌহাট্টা রোডে রিক্সা চলাচল নিয়ন্ত্রণ এবং ফুটপাত হকারমুক্ত করার এখতিয়ার ট্রাফিক বিভাগের নয়। তবে জিন্দাবাজার-চৌহাট্টা রোডে রিক্সা চলাচল বন্ধ রেখে যানজট কমানো যাবেনা। কারণ আমাদেরকে সচেতন হতে হবে। যেখানে সেখানে রাস্তার পাশের্^ যানবাহন দাঁড়িয়ে রাখা থেকে আমাদের বিরত থাকতে হবে। যত্রতত্র পার্কিং বন্ধে ট্রাফিক পুলিশ কাজ করছে। তবে যত্রতত্র পার্কিংয়ের পরিমাণ অনেকাংশে বেড়ে গেছে।
এদিকে সোমবার এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ দোকান মালিক সিমিতি সিলেট জেলা শাখা, মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স ও সিলেট মহানগর ব্যবসায়ী ঐক্য কল্যাণ পরিষদের নেতৃবৃন্দের পক্ষ থেকে প্রেরিত যৌথ বিবৃতিতে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি সিলেট জেলা শাখার আহ্বায়ক মাহি উদ্দিন আহমদ সেলিম, সিলেট মহানগর ব্যবসায়ী ঐক্য কল্যাণ পরিষদের সভাপতি আব্দুর রহমান রিপন, মহানগর ব্যবসায়ী ঐক্য কল্যাণ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক বলেন, নগরীর রাস্তার দুই পাশ এখন হকারদের দখলে। হকাররা সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ফুটপাত ও রাস্তা দখল করে ব্যবসা করে যাচ্ছে নির্র্দিধায়। যার ফলে একদিকে যেমন যানজট সৃষ্টি হচ্ছে, অন্যদিকে পথচারীদের চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। প্রায় সময়ই হকাররা ফুটপাতে বসা নিয়ে তাদের মধ্যে মারামারির ঘটনাও ঘটছে। অন্যদিকে নারীরা চলতে গিয়ে ইভটিজিং শিকার হচ্ছেন। হকাররা দলভেদে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ করে চলেছে। এই অবৈধ ফুটপাত দখলমুক্ত করতে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের কোন তৎপরতা না থাকায় ফুটপাত ও রাস্তায় হকারদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে নগরীর একদিকে যেমন সৌন্দর্য্য বিনষ্ট হচ্ছে, তেমনি আইনশৃঙ্খলারও অবনতি ঘটছে। যার ফলে মার্কেটের ব্যবসায়ী ও ক্রেতা ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। মার্কেটের সামনে ফুটপাত দখল করে রাখায় ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
নেতৃবৃন্দ আরো বলেন, সিসিক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী অবৈধ ফুটপাত দখলমুক্ত করতে তৎপরতা চালিয়ে ছিলেন, কিন্তু নির্বাচনের পর থেকে এখন আর সেই তৎপরতা নেই। উনার দায়িত্ব আগামী নভেম্বর পর্যন্ত থাকলেও তিনি এখনই লাগাম ছেড়ে দেওয়ায় ব্যবসীরা চরম হতাশায় ভোগছেন। বন্দরবাজার থেকে চৌহাট্টা পর্যন্ত রিকশা প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকলেও, এখন অবাধে এসব রাস্তায় প্রবেশ করছে রিকশা। তাই সর্বস্তরের ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে নেতৃবৃন্দ এসব সমস্যা সমাধানে সিসিক ও প্রশাসনের উর্ধ্বতন মহলের সহযোগিতা কামনা করেছেন।