গরমে-বিদ্যুতে নাজেহাল জীবন
প্রকাশিত হয়েছে : ২০ জুলাই ২০২৩, ১২:১৯:১৬ অপরাহ্ন
ভরা বর্ষায় তাপমাত্রা ৩৬
মুনশী ইকবাল: তীব্র গরম আর ঘণ্টায় ঘণ্টায় লোডশেডিংয়ে সিলেটের জনজীবনে নাজেহাল অবস্থা। বৃদ্ধ এবং শিশুদের কষ্টের সীমা নেই। আগে দিনের বেলা লোডশেডিংয়ের মাত্রা বেশি থাকলেও দুইদিন থেকে দিনরাত সব সমান হয়ে গেছে। কোনো কোনো এলাকায় আধাঘণ্টা বিদ্যুত দিয়ে একঘণ্টা করেও লোডশেডিংয়ের অভিযোগ করেছেন লোকজন। বুধবার সিলেটের তাপমাত্রা ছিল প্রায় ৩৬ এর কোঠায় (৩৫ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস) কিন্তু অনুভূতি ছিল ৪৮।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, শ্রাবণের এই সময়ে যখন মেঘ-বৃষ্টির ঘনঘটা থাকার কথা, সেখানে গত কয়েকদিন ধরে সারাদেশে চিটচিটে গরম ভোগাচ্ছে মানুষকে। আগামী আড়াই মাস এমন গরম চলতে পারে।
আবহাওয়ার এমন ‘অসহনীয়’ অবস্থার জন্য মৌসুমি বায়ুর নিষ্ক্রিয় অবস্থাকে দায়ী করে আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক জানান আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গরম এরকমই থাকবে। মাঝেমধ্যে তাপমাত্রা কম থাকতে পারে, কিন্তু গরমের অনুভূতি কম থাকবে না। তিনি বলেন, বাতাসে এখন জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেশি, বৃষ্টিপাত কমে গেছে। এখন তাপমাত্রা যদি ৩২ থেকে ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মাঝেও থাকে, আর্দ্রতার কারণে গরম অনুভূত হবে বেশি। গরমের সময় আমাদের ঘাম হয়। ঘামের মাধ্যমে শরীর নিজেকে ঠাণ্ডা করে। কিন্তু জলীয় বাষ্প থাকলে এই ঘাম বের হওয়ার প্রক্রিয়াটা বাধাগ্রস্ত হয়। তাই অস্বস্তিকার গরম লাগে। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে বড়ো ধরনের বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা নাই জানিয়ে এই আবহাওয়াবিদ বলেন বৃষ্টি হলেও তা খুব সামান্য। ঢাকা, রাজশাহী এরকম আরও কয়েক বিভাগে কিন্তু বৃষ্টিপাত অলরেডি কমে গেছে।
এদিকে এত গরমে মানুষের দুর্ভোগ চরম পর্যায়ে এসেছে বিদ্যুতের জন্য। বাসাবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কোথাও মানুষ স্বস্তিতে ছিলেন না। গরমে ঘেমে বেড়েছে অসুখ বিসুখ। শ্রাবণের অবিরল বারিধারার এই সময়ে খটখটে আকাশ কপালে চিন্তার দাগ স্পষ্ট করে তুলেছে। ঘামে ভেজা শরীর শুকাতে না শুকাতে আবার চলে যাচ্ছে বিদ্যুৎ। এতে ঘামে ঠান্ডা জনিত রোগের পাশাপাশি বেড়েছে এলার্জি, চুলকানির প্রকোপ। রাতের পর রাত হাতপাখা চালিয়ে কান্ত বাবা-মা।
ছাপাখানা, ফটোকপি, প্রিন্টিং ব্যবসা লাটে উঠেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন এক দুই ঘণ্টা জেনারেটর দিয়ে ব্যাকাপ দেওয়া যায়, কিন্তু ঘণ্টার পর ঘণ্টা জেনারেটর চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আগে দিনে কারেন্ট না থাকলেও রাতে অন্তত যন্ত্রণা কম ছিল। ছাপার কাজ অনেক সময় তাই রাতে করে নেওয়া যেত। কিন্তু এখন দিনরাত সমান হয়ে গেছে। রাতা দুইটা তিনটা কোনো বাছবিচার নেই। কয়েকদিন থেকে অবস্থা এমন দাড়িয়েছে কারেন্ট কখন আসে আর যায় সেই হিসাব মেলানো দায় হয়ে গেছে। এতে না হচ্ছে কোনো কাজ আর না হচ্ছে ঘুম বিশ্রাম।
গরম কমার কোনো ভালো খবর নেই কোথাও। বরঞ্চ বিশ্বজুড়ে তাপপ্রবাহ আরো বাড়ার পূর্বাভাস দিয়েছে জাতিসংঘ। এশিয়া থেকে ইউরোপ বা আমেরিকা, বিশ্বের বেশির ভাগ অঞ্চল চরম তাপপ্রবাহে ফুটছে। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও পারদ অতিক্রম করছে আগের সব রেকর্ড। এমন পরিস্থিতিতে তাপপ্রবাহ আরো বাড়ার পূর্বাভাস দিয়েছে তারা।
তাপমাত্রা কমার কোন লণ নেই বলে মঙ্গলবার জানিয়েছে জাতিসংঘের বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা বা ডব্লিউএমও। সংস্থার তাপ বিষয়ক উপদেষ্টা জন নায়ারন জেনেভায় বলেছেন, তাপমাত্রা আরো বাড়বে। বিশ্বকে আরো দাবদাহের জন্য প্রস্তুত হতে হবে।
সংস্থাটি জানায়, তাপপ্রবাহের তীব্রতার কারণে উত্তর আমেরিকা, এশিয়া, উত্তর আফ্রিকা ও ভূমধ্যসাগরে তাপমাত্রা আরো কয়েকদিন ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে থাকবে।
এদিকে এশিয়া, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় জারি করা হয়েছে স্বাস্থ্য সতর্কতা। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে জারি হয়েছে স্বাস্থ্য সতর্কতা। হাসপাতালে বেড়েছে রোগীর ভিড়। এ পরিস্থিতিতে বেশি করে পানি পান ও সূর্যের আলো থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
বর্ষায় বাংলার প্রকৃতির এই রূপ বিস্মিত করে সবাইকে। কেননা বর্ষাকে প্রকৃতির রাণী বলা হয়। কিন্তু কয়েকবছর ধরে সেই রেশ আর দেখা মিলে না। আবহমান কাল ধরে আমরা দেখে এসেছি গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহ আর প্রখর রোদে জনজীবন যখন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে, তখন বর্ষার প্রার্থনা যেন অবধারিত হয়ে ওঠে। ঠিক সে সময়ই প্রকৃতিকে শীতল, সতেজ, স্নিগ্ধ, কোমল আর উজ্জ্বল করতে ঘন গৌরবে নবযৌবনে আগমন করে বর্ষাঋতু। মরা নদীও বর্ষায় জেগে ওঠে তার রূপ-যৌবন জানান দিতে চায়। বাংলাদেশ যে নদীমাতৃক দেশ এটা পূর্ণতা পায় বর্ষাকালে। নদীর ময়লা-আবর্জনা, দুর্গন্ধ, কালো জল যেন হারিয়ে যায় বর্ষার প্রি নাচনে। প্রাণ ফিরে পায় প্রকৃতি। বর্ষায় বৃষ্টি তার রিনিঝিনি নূপুর পায়ে ঝুমুর ঝুমুর তালে অহর্নিশ ঝরে পড়তো বাংলার উর্বরা ভূমিতে।
গ্রামীণ অর্থনীতিতে বর্ষা তথা শ্রাবণ মাসের ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। আমাদের প্রধান খাদ্যশস্য ধানের অধিকাংশ প্রজাতি যেমন আউশ, আমন, ইরি ধান এ সময় রোপণ করা হয়। এসব ধানের চারা রোপণে উপযোগী প্রয়োজনীয় সেচ বা পানির চাহিদা মেটায় বৃষ্টির পানি। এতে কৃষকের সেচ ব্যয় বহুলাংশে কমে যায়। বর্ষাকালে নদী, নালা, খাল, বিল ইত্যাদির পানি অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়। এতে মাছের প্রজনন ত্রে ও বিচরণ ত্রে বৃদ্ধি পায় এবং ফলন বাড়ে। মাছের ফলন বৃদ্ধি পেলে গ্রামীণ মৎস্যজীবী তথা চাষিরা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতেন। এছাড়া এসময় নদী পথের প্রসারতা বৃদ্ধি পায়, ফলে নৌ চলাচলও সহজতর হয়। কিন্তু বর্ষার সেই সুদিন এখন নেই। মানুষ তার নিজ হাতে সেই সুদিনে কুঠারাঘাত করেছে। তাই এ বিষয়ে সতর্ক হওয়ার সময় চলে যাচ্ছে। এজন্য বৃক্ষ নিধন বন্ধ করতে হবে। প্রকৃতির উপর আঘাত বাদ দিতে হবে। পাহাড় টিলা কেটে সাবাড় ছাড়তে হবে। প্রকৃতিবিদদের মতে জলবায়ুর বিরূপ পরিবর্তনের এই সময়ে বৃসম্পদ সংরণের পাশাপাশি বৃরোপণে উদ্বুদ্ধ হওয়া আবশ্যক। তাই তীব্র গরম থেকে রক্ষা পেতে এবং ঝড়-ঝঞ্ঝা, বন্যা-খড়া, জলোচ্ছ্বাস-পাহাড় ধস তথা পরিবেশের ভারসাম্য ও সুরার জন্য বেশি বেশি বৃ রোপণের কোনো বিকল্প নেই।