ডলার সংকটে হুন্ডির পালে সুবাতাস
প্রকাশিত হয়েছে : ০৭ আগস্ট ২০২৩, ৬:২৬:৩৫ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট: একটা সময় বিদেশের সাথে টাকা লেনদেনের সবচেয়ে পরিচিত ও ব্যবহৃত মাধ্যম ছিল হুন্ডি। তারপর ব্যাংকের মাধ্যমে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ায় বৈধ পথে টাকা পাঠানোর চাহিদা ক্রমশ বাড়তে থাকে। কিন্তু অতি সম্প্রতি ডলারের সংকটের জন্য হুন্ডির সেই পুরানো পালে আবারও হাওয়া লেগেছে। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে স্টুডেন্ট ভিসার লেনদেনে।
বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিসহ বিভিন্ন ফি হুন্ডির মাধ্যমে পাঠানোর ঘটনা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। অনেক শিক্ষার্থীই এখন দেশের বাইরের উচ্চশিক্ষার ফি পাঠানোর জন্য হুন্ডিকে বেছে নিচ্ছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি অতিপ্রয়োজনীয় বৈধ লেনদেনও অবৈধ পথে চলে যাওয়ায় দেশে হুন্ডির বাজার আরো শক্তিশালী হচ্ছে। ডলারের বিনিময় হার নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভুল নীতির কারণে হুন্ডির লেনদেন বাড়ছে।
উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে বিদেশগামী ও দেশের বাইরে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের ভর্তি ফিসহ বেশির ভাগ ব্যয় হুন্ডির বাজারে চলে গেছে। অনেক শিক্ষার্থীই এখন বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয় খরচ পাঠানোর জন্য হুন্ডির মতো অপ্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতিকে বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। ব্যাংক থেকে ফি পাঠানোসংক্রান্ত ফাইল (স্টুডেন্ট ফাইল) না খোলার কারণে বৈধ এ লেনদেন অবৈধ পথে চলে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
গত মাসের (জুলাই) শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে দেশ ছেড়েছেন মাহমুদ হোসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ শিক্ষার্থী স্টুডেন্ট ফাইল খোলার জন্য প্রায় ছয় মাস ধরে বিভিন্ন ব্যাংকে ঘুরেছিলেন। কিন্তু ডলার সংকটের কথা বলে কোনো ব্যাংকই ফাইল খুলতে রাজি হয়নি। শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে থাকা পরিচিত একজনের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি ফি, টিউশন ফিসহ অন্যান্য ফি জমা দিয়েছেন। মতিঝিলের একটি মানি এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে সে টাকা যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়েছেন বলে এ শিক্ষার্থী জানিয়েছেন।
বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন মনে করেন, ডলার সংকট মোকাবেলা করার কথা বলে ব্যাংকগুলো স্টুডেন্ট ফাইল খোলা বন্ধ করে দিয়েছিল। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রচ্ছন্ন নির্দেশনাও ছিল। কিন্তু এটি মনে রাখা দরকার, কোনো অতিপ্রয়োজনীয় লেনদেনই বন্ধ করে দেওয়া যায় না। বৈধ চ্যানেলে ডলার পাঠাতে না পেরে শিক্ষার্থীরা হুন্ডির বাজারে যেতে বাধ্য হয়েছে। এর মাধ্যমে ইনফরমাল মার্কেট আরো বড়ো হয়েছে।
ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘ডলার সংকট কাটাতে বাংলাদেশ ব্যাংক চাহিদা নিয়ন্ত্রণের পথে হেঁটেছে। নানান বিধিনিষেধ আরোপ করে আমদানি কমিয়েছে। আমদানি কমানোর চেয়েও বেশি প্রয়োজন ছিল ডলারের সরবরাহ বাড়ানো। পাশাপাশি দেশ থেকে অর্থ পাচার ঠেকানো। বিদেশগামী শিক্ষার্থী, ভ্রমণ কিংবা চিকিৎসার জন্য দেশ থেকে যে পরিমাণ ডলার যায়, সেটি খুব বেশি নয়। ডলার সংকটের প্রধান কারণ অর্থ পাচার। এটি ঠেকানো না গেলে কোনোভাবেই সংকট কাটবে না।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে রেকর্ড পরিমাণ অর্থ শিক্ষাসংক্রান্ত কাজে বিদেশ পাঠানো হয়েছে। অর্থবছর শেষে এ অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫২ কোটি ৮ লাখ ডলার। টাকার অংকে যা সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এর আগে কোনো অর্থবছরে শিক্ষার উদ্দেশ্যে এত পরিমাণ অর্থ বিদেশ পাঠানো হয়নি। ২০২১-২২ অর্থবছরে এ-সংক্রান্ত কাজে বিদেশ পাঠানো অর্থের পরিমাণ ছিল ৪১ কোটি ৪৫ লাখ ডলার। এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে পাঠানো হয় ২৪ কোটি ৩১ লাখ ডলার। আর ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিদেশে উচ্চশিক্ষায় যাওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য দেশ থেকে ২১ কোটি ৮০ লাখ ডলার পাঠানো হয়।
রেকর্ড পরিমাণ অর্থ ব্যাংকিং চ্যানেলে বিদেশ পাঠানো হলেও শিক্ষার্থীদের হুন্ডিতে যেতে হচ্ছে কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে দেশের প্রথম প্রজন্মের একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘উচ্চশিক্ষার কথা বলে শিক্ষিত তরুণরা দেশ ছাড়তে চাচ্ছেন। দেশ ছাড়তে চান এমন শিক্ষার্থীদের সংখ্যা লাখ লাখ। কিন্তু এত পরিমাণ শিক্ষার্থীর স্টুডেন্ট ফাইল খোলা ব্যাংকের পক্ষে সম্ভব নয়। ব্যাংকগুলোর হাতে চাহিদা অনুযায়ী স্টুডেন্ট ফাইল খোলার মতো ডলারও নেই। এ কারণে শিক্ষার্থীরা হুন্ডির বাজারে যাচ্ছেন।’
বিদেশে উচ্চশিক্ষাপ্রত্যাশী শিক্ষার্থীরা মূলত দেশের ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজের ভর্তি, টিউশন, আবাসন ফিসহ বিভিন্ন খরচ পাঠান। এজন্য ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের একটি ফাইল খুলতে হয়। বৈদেশিক মুদ্রায় লেনদেন হয়, ব্যাংকগুলোর এমন সব এডি শাখা থেকেই ফাইল খোলার সুযোগ রয়েছে। ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা ওই ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাঠান।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বেসরকারি ও বিদেশী খাতের প্রথম সারির ব্যাংকগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিদেশগামী শিক্ষার্থীদের ফাইল খোলে। এক্ষেত্রে অগ্রগামী ব্যাংকগুলো হলো ইস্টার্ন, ব্র্যাক, দ্য সিটি, মিউচুয়াল ট্রাস্ট (এমটিবি), ব্যাংক এশিয়া, প্রাইম, প্রিমিয়ার ও সাউথইস্ট। বেসরকারি খাতের আরো এক ডজনের মতো ব্যাংক এসব ফাইল খোলে। বিদেশী স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড, এইচএসবিসিসহ অন্য কয়েকটি ব্যাংকও স্টুডেন্ট ফাইল খোলার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকায় ছিল। কিন্তু ডলার সংকট শুরু হওয়ার পর প্রায় দুই বছর ধরে ব্যাংকগুলো এসব ফাইল খোলা কমিয়ে দিয়েছে। কোনো কোনো ব্যাংক আনুষ্ঠানিকভাবে শাখায় চিঠি দিয়ে স্টুডেন্ট ফাইল খোলা বন্ধ রেখেছে। কিছু ব্যাংক চালু রাখলেও প্রভাবশালীদের তদবির লাগছে।
বিদেশগামী শিক্ষার্থীদের স্টুডেন্ট ফাইল প্রায় বন্ধ রাখা ব্যাংকগুলোর একটি বেসরকারি খাতের দ্য সিটি ব্যাংক। গত বছরের শেষের দিকে ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয় থেকে এ-সংক্রান্ত চিঠি পাঠানো হয়। ওই চিঠিতে স্টুডেন্ট ফাইল খোলা বন্ধ রাখতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন বলেন, ‘ডলার সংকটের কারণে স্টুডেন্ট ফাইল খোলা বন্ধ রাখা হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে এখনো ফাইল খোলা হচ্ছে। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী আমাদের পক্ষে এ মুহূর্তে ফাইল খোলা সম্ভব নয়। একটি ফাইল খুললে তিন-পাঁচ বছর পর্যন্ত প্রতি মাসে নিয়মিত ডলার পাঠাতে হয়।’
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমানও জানান, স্টুডেট ফাইল খোলা আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে বিদেশগামী একজন ছাত্র ২০-৩০ হাজার ডলার পর্যন্ত বিদেশ পাঠান। পাঁচজন ছাত্রের টিউশন ফি পাঠানো হলে সেটির পরিমাণ লাখ ডলার ছাড়িয়ে যায়। বর্তমান পরিস্থিতিতে যেকোনো ব্যাংকের জন্য ১ লাখ ডলার অনেক মূল্যবান। সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনা করেই বিদেশগামী শিক্ষার্থীদের ফাইল খোলা বন্ধ রাখা হয়েছিল। তবে কারো প্রয়োজন তীব্র হলে সে ফাইল খোলা হচ্ছে।’
বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর কতসংখ্যক শিক্ষার্থী বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য যাচ্ছেন তার একটি পরিসংখ্যান দিয়েছে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো। সংস্থাটির ‘গ্লোবাল ফ্লো অব টারশিয়ারি লেভেল স্টুডেন্টস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সালে বাংলাদেশ থেকে ৪৯ হাজার ১৫১ শিক্ষার্থী বিদেশে গেছেন উচ্চশিক্ষা নিতে। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। ২০২১ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য দেশটিতে যান ৮ হাজার ৬৬৫ বাংলাদেশী শিক্ষার্থী। এছাড়া মালয়েশিয়ায় ৭ হাজার ৫৪৮, অস্ট্রেলিয়ায় ৫ হাজার ৬৪৭, কানাডায় ৫ হাজার ১৩৬, জার্মানিতে ৩ হাজার ৯৩০, যুক্তরাজ্যে ৩ হাজার ১৯৪, ভারতে ২ হাজার ৭৫০, দক্ষিণ কোরিয়ায় ১ হাজার ১৭৬ ও সৌদি আরবে ১ হাজার ১৬৮ বাংলাদেশী শিক্ষার্থী গত বছর উচ্চশিক্ষা নিতে গেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে ১০ হাজার ৫৯৭ জন বাংলাদেশী শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য গেছেন। ২০২০-২১ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া বাংলাদেশী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৮ হাজার ৫৯৮ জন। ২০১৯-২০ অর্থবছরেও ৮ হাজার ৮৩৮ জন বাংলাদেশী শিক্ষার্থী যুক্তরাষ্ট্রে যান। যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ দূতাবাসের একটি সূত্র বলছে, চলতি বছর যুক্তরাষ্ট্রগামী বাংলাদেশী শিক্ষার্থীর সংখ্যা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। ভিসা প্রার্থীদের সাক্ষাৎকার নিতেই দূতাবাসের কর্মীরা হিমশিম খাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিভিন্ন ব্যাংকের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য যাওয়া একজন ছাত্রের জন্য প্রতি বছর ৫০-৬০ হাজার ডলার পাঠাতে হয়। স্টুডেন্ট ফাইল খোলার দিক থেকে সামনের সারিতে থাকা ব্যাংকগুলোর বছরে ৩-৫ কোটি ডলার পর্যন্ত বিদেশে পাঠাতে হচ্ছে। ডলার সংকট তীব্র হওয়ায় ব্যাংকগুলো নতুন করে নিজেদের বৈদেশিক মুদ্রার দায় বাড়াতে চাইছে না। এ কারণে বিদেশগামী শিক্ষার্থীদের ফাইল খোলা বন্ধ করে দেয়া হয়। কোনো কোনো ব্যাংক চালু রাখলেও ফাইল খুলতে বাড়তি কাগজপত্র চেয়ে সময়ক্ষেপণ করছে।
প্রসঙ্গত, ২০২১-২২ অর্থবছরে রেকর্ড ৮৯ দশমিক ১৬ বিলিয়ন বা ৮ হাজার ৯১৬ কোটি ডলারের আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলে বাংলাদেশ। ফলে অর্থবছর শেষে দেশের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ৩৩ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। সরকারের চলতি হিসাবের ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ১৮ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলার। সব মিলিয়ে ব্যালান্স অব পেমেন্টে (বিওপি) ঘাটতির পরিমাণ ৬ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। ডলারের সংকট তীব্র হয়ে উঠলে গত অর্থবছরের শুরু থেকেই এলসি কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। আমদানির এলসি খোলায় বিভিন্ন শর্তও আরোপ করা হয়। তার পরও ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে বিওপির ঘাটতির পরিমাণ ৮ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম মাসেও (জুলাই) রিজার্ভ থেকে ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিক্রি করা হয়েছে।