দোয়ারায় আবারো সক্রিয় চোরাকারবারিরা মহাজনদের কাছে জিম্মি সীমান্তের মানুষ
প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ আগস্ট ২০২৩, ৮:৩২:৫৭ অপরাহ্ন
দোয়ারাবাজার থেকে সংবাদদাতা : সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার সীমান্তে আবারো সক্রিয় চোরাচালান চক্র। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এসব করতে গিয়ে প্রাণ হারাচ্ছে অনেকেই। লোভের ফাঁদে নিঃস্ব হচ্ছে শ্রমিকরা। তবে ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছে এখানকরা কথিত মহাজনরা। অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য। ইউপি সদস্য, চেয়ারম্যান, জনপ্রতিনিধি, বিজিবি ও বিএসএফকে ম্যানেজ করেই এসব কাজ চালায় স্থানীয় মহাজনরা। চোরাচালান বন্ধে বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আরো সক্রিয় হওয়ার দাবী স্থানীয়দের। পুলিশ বলছে, সীমান্ত এলাকার মানুষদের সচেতন করতে বিট পুলিশিংসহ নানাভাবে কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।
অতিসম্প্রতি কাঁটাতারের সীমানা ডিঙিয়ে ভারত থেকে গরু পার করতে গিয়ে পাহাড়ি নদীর স্রোতের তোড়ে ভেসে যান তাজুল ইসলাম (৩৫) নামের এক যুবক। পরে উপজেলার খাসিয়ামারা নদী থেকে ওই যুবকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। গত দুই বছরে এভাবে ওপার থেকে চোরাই মালামাল আনতে গিয়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বিএসএফ এবং পাহাড়িদের গুলিতে অসংখ্য প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।
পুলিশ সূত্রে জানা যায় শনিবার (৫ আগস্ট) বিকেল ৫টার দিকে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে দোয়ারাবাজার থানা পুলিশের বিশেষ অভিযানে উপজেলার বাংলাবাজার ইউনিয়নের কলাউড়া মার্কেটের কলাউড়া মাদ্রাসা রোডের ইকবালের দোকানের সামনের পাকা রাস্তার উপর অভিযান পরিচালনা করে মোঃ ফারুক আহমদ (৩৬)কে আটক করা হয়। এ সময় তার দেহ তল্লাশি করে প্যান্টের পকেটে থাকা একটি কৌটার ভিতরে ৯০ পিছ ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করে পুলিশ। মোঃ ফারুক আহমদ দক্ষিণ কলাউড়া গ্রামের মৃত আব্দুল হামিদের ছেলে।
দোয়ারাবাজার সীমান্তে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড সুনামগঞ্জ ব্যাটালিয়ন (২৮-বিজিবি) উপজেলার বাগানবাড়ি বিওপির টহল দল গত বৃহস্পতিবার (৩ আগস্ট) রাতে উপজেলার বোগলাবাজার ইউনিয়নের বাগানবাড়ি গ্রামে অভিযান চালিয়ে ২৪ বোতল বিদেশি মদসহ ওমর ফারুক আকাশ (২২) নামের এক মাদক ব্যবসায়ীকে আটক করে। বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার রাত ১১টার দিকে উপজেলার বোগলাবাজার ইউনিয়নের বাগানবাড়ি (তালতলা) এলাকার সীমান্ত মেইন পিলার ১২২৬/৩ এস হতে আনুমানিক ৫০ গজ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ২৪ বোতল ভারতীয় মদ (এসি ব্ল্যাক)সহ বোগলাবাজার ইউনিয়নের কাঁঠালবাড়ি গ্রামের নাজিম উদ্দীনের ছেলে ওমর ফারুক আকাশকে আটক করে বিজিবি।
রোববার রাতে (৬ আগস্ট) উপজেলার লক্ষীপুর ইউনিয়নের ভাঙ্গাপাড়া সীমান্তে চোরাকারবারি সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ একটি চক্র বিএসএফের উপর হামলা চালিয়ে তাদের আহত করে। স্থানীয় একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাতের আঁধারে লুকিয়ে উপজেলার বোগলা ও লক্ষীপুর ইউনিয়নের ভাঙ্গাপাড়া এলাকা দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে অনেকেই। এরা সবাই ভারতে গিয়ে গরু-ছাগল, মাদক আনা নেয়াসহ বিভিন্ন অপকর্মের সঙ্গে জড়িত।
তারা আরো বলেন, এলাকায় গরু ও মাদকের চোরাচালানের কাজ চলে। তবে যারা গরুর ব্যবসা করে তাদের অধীনে অনেকেই কাজ করে। যারা ব্যবসা করে তারা নিজেরা কখনো কাঁটাতারের দিকে যায় না। তারা কামলা নেয়। চালান প্রতি পাঁচশো থেকে দুই তিন হাজার টাকা দেয় কামলাদের।
অনুসন্ধানে জানা যায়, স্থানীয় মহাজনদের সঙ্গে ভারত সীমান্তের অনেকের নিয়মিত যোগাযোগ হয়। ওই প্রান্ত থেকে গরু, মাদক বা কোনো জিনিসের তথ্য পাওয়ামাত্র স্থানীয় মহাজনরা শ্রমিকদের পাঠান ওই এলাকায়। তবে কোন কারণে বিজিবি ও বিএসএফকে ম্যানেজ না করতে পারলে শ্রমিকদের ওই পাশেই (ভারতে) টানা কয়েকদিন থাকতে হয়। কাঁটাতারের ওপর প্রান্তে হাজং পাড়াতে তারা এসময় অবস্থান করেন। দুই পাশের সীমান্তরক্ষীদের ম্যানেজ করার পর শ্রমিকরা চালান নিয়ে এদেশে ঢুকেন।
এসময় দিনের বেলায় দেশীয় গরুর সাথে ছেড়ে দেয়া হয় পাহাড়ে। রাতের আঁধারে দেশীয় গরুর সাথে ভারতীয় গরু নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হয়। সীমান্তের অরক্ষিত অংশের ব্রিজ ও কালভার্টের নিচ দিয়েই মূলত এই চোরাচালান হয়ে থাকে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। চোরাচালানের সাথে জড়িত মাঠ পর্যায়ে যারা কাজ করে তারা সবাই শ্রমিক। কয়েকজন এক সাথে ভারতে ঢুকে গরু, মাদক ও ব্যবহার্য সামগ্রী এনে মহাজনদের হাতে তুলে দেয়।
স্থানীয়দের অভিযোগ চোরাচালানে জড়িত কতিপয় ব্যক্তির ইন্ধনে নিঃস্ব হচ্ছে এলাকার সহজ সরল মানুষ। যাদের জন্য প্রতিনিয়ত হয়রানি ও বিব্রতকর পরিস্থিতির শিকার হতে হচ্ছে সবাইকে। গরু ও মাদক চোরাচালান বন্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আরো সক্রিয় হওয়ার দাবী স্থানীয়দের। তারা বলেন, রাতের আঁধারে অনেক সময় বিজিবির অগোচরেই তারা ভারতে প্রবেশ করে। ভারত অংশের আদিবাসী পল্লী, হাজং পাড়া ও ডালু এলাকা থেকে মাদক সরবরাহ ও কেনাবেচা করে এসব লোকজন। যার কারণে এলাকাতে মাদকের ভয়াবহতা প্রকট আকার ধারন করছে।