নিঃসঙ্গ মৃত্যু প্রসঙ্গে
প্রকাশিত হয়েছে : ১৯ আগস্ট ২০২৩, ১২:৩০:৪৬ অপরাহ্ন
বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান কথা সাহিত্যিক বিনয় কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের ‘দৃষ্টিপাত’ উপন্যাসের একটি বিখ্যাত উক্তি হচ্ছে, ‘বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে বেগ কেড়ে নিয়েছে আবেগ’। হ্যাঁ, আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক জীবনযাত্রা মানুষকে অনেক কিছু উপহার দিলেও মানুষের মধ্যেকার আবেগ মায়া-মমতা ও সহমর্মিতা বহুলাংশে কেড়ে নিয়েছে, তা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। আধুনিক জীবনযাত্রায় মানুষ যতো বেশী অভ্যস্ত হচ্ছে, ততোই সরে যাচ্ছে প্রচলিত সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধ থেকে। স্বজন তথা পরিবারের সদস্যদের প্রতি দায়দায়িত্ব ও ভালোবাসার বন্ধন শিথিল হয়ে পড়ছে। বিশেষভাবে পরিবারের বয়স্ক সদস্যদের প্রতি অবহেলা বাড়ছে। এতে অসহায় ও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছেন বয়স্করা। প্রবীণ জনগোষ্ঠীর এই সমস্যা নতুন নয়। যৌথ পরিবারের বন্ধন শিথিল হয়ে পড়া যখন শুরু হয়েছে, তখন থেকেই এ সমস্যা দিন দিন প্রকট হচ্ছে। এর সাথে সাম্প্রতিক সময়ে যুক্ত হয়েছে নিঃসঙ্গতা। অনেকে এটাকে আধুনিক মহামারী হিসেবে আখ্যায়িত করছেন।
সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৭ সালে এশিয়ার শিল্পোন্নত দক্ষিণ কোরিয়ার ‘নিঃসঙ্গ মৃত্যু’ হয়েছে ২ হাজার ৪১৫ জনের। গত বছর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৩৭৮ জনে। প্রশাসনের বক্তব্য, কোভিড মহামারীর সময়ে সমান্তরাল মহামারী হয়ে ওঠেছে ‘নিঃসঙ্গ মৃত্যু’। যে কারণে এ ধরনের মৃত্যু বাড়ছে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা সেগুলো হচ্ছে, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, দারিদ্র্য ও জনসংখ্যার সংকট। তাদের মতে, আধুনিক জীবন যাপন ক্রমশঃ দামী হয়ে ওঠায় সন্তান নিচ্ছেন না অনেকেই। কেউ কেউ আবার ভাগ্যদৌড়ের জীবনে আরো বেশী আয়ের খোঁজে এতো ব্যস্ত যে বাবা-মা, ভাই-বোন, দাদা-দাদী, নানা-নানীকে সময় দিতে পারছেন না।
দেখা গেছে, ‘লোনলি ডেথ’ অর্থাৎ নিঃসঙ্গ মৃত্যু হচ্ছে যাদের, তাদের ৬০ শতাংশের বয়স পঞ্চাশ বা ষাটের কোঠায়। যদিও চল্লিশ, এমনকি সত্তরের কোঠায় পৌঁছানো মানুষও ‘ঘাতক’ নিঃসঙ্গতার পাল্লায় পড়ে মারা যাচ্ছেন। মারা যাচ্ছেন তো যাচ্ছেন, নিজ ফ্লাট বা গৃহে তাদের লাশ পচে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে না পড়া পর্যন্ত তাদের মৃত্যুর খবরটুকু পর্যন্ত কেউ জানতে পারছেন না।
এদিকে পরিস্থিতি ক্রমশ: ভয়াবহ হয়ে ওঠায় দক্ষিণ কোরিয়া প্রশাসন পাশ করেছে ‘লোনলি ডেথ প্রিভেনশন অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট-২০২১’। এ বিষয়ে বিস্তারিত গবেষণা করে দেখছেন দেশটির বিশেষজ্ঞরা। যদিও জীবন যাপনে পরিবর্তন না এলে বিলাসিতা থেকে না সরলে এই ভবিতব্য বা ধারা বদলাবে না মানুষের, এমনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন সমাজবিজ্ঞানী ও মনস্তত্ত্ববিদরা।
সম্প্রতি মিডিয়ায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর মাঝে নিঃসঙ্গতা ও অসহায়ত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্র প্রবীণরা অবহেলা ও অযত্নের শিকার হয়ে পরিবার থেকে দুরে সরে যাচ্ছেন বা পরিবারই তাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। তার নিকটতম স্বজনরা এমনকি ছেলেমেয়েরা পর্যন্ত তাকে বোঝা মনে করছে। আবার অনেক প্রবীণ নিজেই কারো উপর বোঝা হয়ে থাকতে চাচ্ছেন না বলে বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নিচ্ছেন। বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ। আর এর শিকার প্রবীণরা বিশেষভাবে মহিলারা। আবার গ্রামের প্রবীণদের আর শহরের প্রবীণদের সমস্যা অনেক সময় ভিন্ন হয়। শহরে অনেক প্রবীণ সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল, কিন্তু মনস্তাত্ত্বিক সমস্যায় ভোগেন বেশী। নিঃসঙ্গতা বা পারিবারিক অবহেলা এক্ষেত্রে বিশেষভাবে দায়ী। গ্রামের প্রবীণদের মধ্যে আর্থিক অস্বচ্ছলতা বেশী।
সর্বোপরি, বাংলাদেশে প্রবীণ জনগোষ্ঠীকেই বেশী নিঃসঙ্গতায় ভুগতে দেখা যায়। সন্তান ও নিকটজনদের অবহেলা বা প্রবাসে অবস্থান তাদেরকে এই মর্মান্তিক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়। প্রচলিত যৌথ বা একান্নবর্তী পরিবার প্রথা ক্রমশঃ ভেঙ্গে যাওয়ায় পরিবারের বয়োবৃদ্ধ সদস্যদের প্রতি অবহেলা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাদের প্রতি কর্তব্য ও দায়বোধ কমে যাচ্ছে। ফলে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর মাঝে সৃষ্টি হচ্ছে নিঃসঙ্গতাবোধ, যা তাদেরকে অসহায় করুণ মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
ইসলাম ধর্মে মা-বাবার সেবা যত্নের বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তাদের প্রতি অবহেলা প্রদর্শন অর্থাৎ দায়িত্ব পালন না করাকে গর্হিত অপরাধ হিসেবে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশেও পিতামাতার প্রতি দায়িত্ব পালনের বাধ্যবাধকতা সংক্রান্ত আইন রয়েছে। এ অবস্থায় পরিবারের সদস্যদের বিশেষভাবে সন্তানদের উচিত আইন রীতিনীতি সর্বোপরি নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ থেকে পরিবারের প্রবীণ সদস্যদের বিশেষভাবে পিতামাতার প্রতি তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করা। তাদেরকে কোন অবস্থাতেই অযত্ন ও অবহেলা না করা এবং নিঃসঙ্গতার দিকে ঠেলে না দেয়া। সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধ অটুট রাখতে চেষ্টা করা। কারণ মনে রাখতে হবে, প্রকৃতির নিয়মে আয়ু থাকলে সবাইকেই একদিন বয়োবৃদ্ধ দশায় উপনীত হতে হবে অর্থাৎ প্রবীণ হতে হবে।