হাওর পাড়ের চার গ্রামে নেই বিদ্যালয়
প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ আগস্ট ২০২৩, ৬:৫৪:১০ অপরাহ্ন
তিনশতাধিক শিশুর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত
তাহিরপুর প্রতিনিধি: তাহিরপুরে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হাওর পাড়ের বিনোদপুর, পনিয়াখালি, কান্দাপাড়া ও রতনপুর গ্রামে নেই প্রাথমিক বিদ্যালয়। গ্রামগুলো টাংগুয়াসহ বিভিন্ন হাওর বেষ্টিত। বর্ষাকালে নৌকা আর হেমন্তে পায়ে হেঁটে যেতে হয় চার কিলোমিটার দূরবর্তি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। বাড়ি থেকে স্কুল দূরে থাকায় শিশুরাও স্কুলে যেতে চায় না। ফলে শিক্ষা জীবনের শুরুতেই শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ঐসব গ্রামের কোমলমতি তিন শতাধিক শিশু। এসব গ্রামের অধিকাংশ মানুষই হাওর থেকে মাছ ধরে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন বিধায় নিজ সন্তানদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে শংকিত।
যুগ যুগ ধরে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার টাংগুয়া হাওর তীরবর্তি ঐসব গ্রামগুলোতে এমনি অবস্থা বিরাজ করছে। তারা একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের দাবি জানিয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৪ গ্রামে প্রায় পাঁচ শতাধিক পরিবারের বসবাস। পরিবারগুলোতে ৫-১০ বছর বয়সী শিশু রয়েছে প্রায় তিন শতাধিক। গ্রামগুলোর পশ্চিম-উত্তরে চার কিলোমিটার দুরে বীরেন্দ্রনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পশ্চিমে টাংগুয়ার হাওরের অপর পাড়ে প্রায় ৬ কিলোমিটার দূরবর্তি ইন্দ্রপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পূর্বদিকে এরালিয়াকোনা হাওরের অপর পাড়ে মন্দিয়াতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং পূর্ব-উত্তর দিকে ৫ কিলোমিটার দুরবর্তি রঙ্গাছড়া নদীর অপর পাড়ে সোনাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় অবস্থিত। এই অবস্থায় চার গ্রামের প্রায় শতাধিক শিক্ষার্থী দীর্ঘদিন ধরে দূরবর্তী বিদ্যালয়ে গিয়ে লেখাপড়া করলেও বিদ্যালয়ে যাওয়ার অনীহা বাড়তে শুরু করেছে। এতে অভিভাবকরা সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন রয়েছেন।
এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, বিনোদপুর গ্রামের এনামুল হক ২০০৪ সালের ৪ সেপ্টেম্বর তেত্রিশ শতক জমি দান করলে ঐ জায়গায় গ্রামবাসীর উদ্যোগে এনামপুর ও বিনোদপুর বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নামকরণ করা হয়। ২০০৫ সালের ১ জানুয়ারি বিনোদপুর গ্রামের জহিরুল ইসলাম বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নিয়ে আরো তিনজন সহকারি শিক্ষিকা নিয়ে বিনা বেতনে এলাকার শিশুদের পাঠদান শুরু করেন। দুই বছর পর স্কুল পরিচালনা কমিটি গঠন করে ২০০৭ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর শিক্ষকদের স্থায়ীভাবে নিয়োগ দেয়া হয়। ২০১০ সালে এফআইভিডিবির সহযোগিতায় নেদারল্যান্ড সরকারের আর্থিক অনুদানে ১২ লক্ষ ৭২ হাজার তিনশত টাকা ব্যয়ে একটি স্কুল ভবন নির্মাণ করা হয়। ২০০৭ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত গ্রাম বাসিন্দাদের অর্থায়নে একজন শিক্ষককে নিয়মিত বেতন প্রদান করা হয়। প্রধান শিক্ষকসহ বাকি দুজন নিজ এলাকার কোমলমতি শিশুদের কথা বিবেচনা করে দীর্ঘ ৭ বছর এখানে বিনা বেতনে পাঠদান করার পর শিক্ষকদের সংসারের অভাব অনটনের কারণে বিদ্যালয়টির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। ২০১৩ সালে সারাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ হওয়ার সময় প্রধান শিক্ষক বিদ্যালয়টি সরকারিকরণের আশায় পুনরায় চালু করেন এবং স্কুলটি জাতীয়করণের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে ফাইল জমা দেওয়া হয়। বিভিন্ন দপ্তরে ঘুরে কোন উপায়ন্তর না পেয়ে তিনি এলাকার লোকজনকে নিয়ে স্কুলটি জাতীয়করণের লক্ষ্যে স্থানীয় সংসদ সদস্য প্রকৌশলী মোয়াজ্জেম হোসেন রতনের সহযোগিতা কামনা করলে সংসদ সদস্য প্রধানমন্ত্রী বরাবর একটি ডিও লেটার প্রেরণ করেন।
সাকিরা বেগম, সায়লা বেগমসহ গ্রামের কয়েকজন শিক্ষার্থী জানায় গ্রামে বিদ্যালয় না থাকায় আমাদের অনেক সহপাঠী দুরের স্কুলে যায়না, আবার অনেকে লেখাপড়াও ছেড়ে দিয়েছে। আমাদের গ্রামে একটি বিদ্যালয় হলে আমরা লেখাপড়া করার সুযোগ পেতাম।
স্কুল পরিচালনা কমিটির সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমাদের মত নিজেদের পরবর্তি প্রজন্মও স্কুলের অভাবে লেখাপড়া করতে পারছে না। ফলে নিরক্ষরতা ও শিশু শ্রম বাড়ছে। আগামী প্রজন্মের উজ্জল ভবিষ্যতের জন্য এই স্কুলটির জাতীয়করণের জন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষসহ প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন জানান তিনি।
স্কুলটির জমিদাতা এনামুল হক বলেন, বিদ্যালয় স্থাপনের জন্য ৩৩ শতক জমি দান করে মানুষের দ্বারে-দ্বারে গিয়ে শুধু আশ্বাসই পেয়েছি। কাজের কাজ কিছুই হয়নি। মৃত্যুর আগে বিদ্যালয়টির জাতীয়করণ দেখে যেতে চাই।
স্থানীয় ইউপি সদস্য শাহজাহান খন্দকার বলেন, একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় না থাকায় ৪ গ্রামের অনেক শিশুরা দুরে খুব কষ্ট করে লেখাপড়া করছে। অনেকে ঝরে পড়ছে। শিক্ষার অভাবে শিশু-কিশোর ও যুব সমাজ বিপথগামী হচ্ছে।
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবুল খায়ের জানান, যেসব জায়গায় স্কুল নেই সেসব জায়গায় স্কুল স্থাপনের জন্য চলতি বছরের এপ্রিল মাসে একটি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। অনেকেই এ প্রকল্পের আওতায় আমাদের কাছে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিয়েছেন। আমাদের টিম মাঠ পর্যায়ে তদন্ত করে যাচাই বাছাই করে যেসব জায়গায় স্কুলের বেশি প্রয়োজন সেসব জায়গায় স্কুল নির্মাণ করা হবে।