সিলেট ইকোপার্ক : জায়গা কম, ঘরমুখী সাপ
প্রকাশিত হয়েছে : ২৬ আগস্ট ২০২৩, ৫:০৪:৫২ অপরাহ্ন
#লোকালয়ে আতঙ্ক, স্থানান্তরের দাবি
মুনশী ইকবাল : শহরতলীর আলুরতল এলাকায় ১১২ একর জায়গা ঘিরে গড়ে উঠে টিলাগড় ইকোপার্ক। কিন্তু এই পার্কে আয়তনের তুলনায় সাপ এখন অনেক বেশি। জায়গা কম হওয়ায় সাপগুলো ঘরমুখী। যখন তখন মানুষের ঘরে প্রবেশ করে সাপ। এতে এলাকায় আতঙ্কের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
এটি সিলেট বনবিভাগ, বন অধিদপ্তর, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের ইকোপার্ক প্রকল্প। এতে প্রাকৃতির পরিবেশে বনের পশুপাখি দেখার এক অনন্য সুযোগ তৈরি হয় দর্শনার্থীদের জন্য। পিচঢালা রাস্তা চলে গেছে বনের গহীনে। মাঝে মাঝে তারের বেড়া দিয়ে শেড তৈরি করে রাখা হয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির পশুপাখি।
এই পার্কের আশপাশে সিলেট কৃষি বিশ^বিদ্যালয়, বালুচর, শেভরন গ্যাসফিল্ড, মালনিছড়া চা বাগানসহ অনেকগুলো লোকবসতি। ফলে এসব এলাকায় প্রায়ই নানান ধরনের সাপ লোকালয়ে বন থেকে চলে আসে। পরে বনবিভাগের মাধ্যমে এসব সাপ ইকোপার্কে অবমুক্ত করা হয় বলে স্থানীয়রা জানান। বারবার লোকালয়ে সাপ চলে আসায় এখন জনমনে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। তারা সাপ ইকোপার্কে অবমুক্ত না করে দূরে স্থানান্তরের দাবি জানিয়েছেন। বনবিভাগ সূত্র বলছে আশপাশের বনবাদাড় ও চা বাগান থেকে এসব সাপ লোকালয়ে খাবারের সন্ধানে চলে আসে। মূলত খাবার সংকটের জন্যই তারা এভাবে আসে। আর সাপ নিয়ে কাজ করা সামাজিক সংগঠনগুলো বলছে টিলাগড় ইকোপার্কে আয়তনের তুলনায় সাপের সংখ্যা বেশি, তাই সাপ ধরা পড়লে এখানে সাপ অবমুক্ত করা নিরাপদ নয়।
বুধবার সিলেটের বালুচর এলাকা থেকে এনিম্যাল রেসকিয়ার শ্রীবাস নাথের নেতৃত্বে সাড়ে ৯ ফুট সাইজের একটি বার্মিজ অজগর উদ্ধার করে স্নেক রেসকিউ টিম বাংলাদেশ। দিবাগত রাত সাড়ে ১২ টার দিকে সাপটি দেখতে পেয়ে এলাকাবাসী তাদের জানান। এরপর শ্রীবাস নাথ গিয়ে ওয়াইল্ড লাইফ ক্রাইম ইউনিট এর সহযোগিতা এবং নির্দেশনায় উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। পরদিন বৃহস্পতিবার বন বিভাগের এনিম্যাল কিপার মাসুদ হাওলাদার এর সহযোগিতায় সাপটি টিলাগড় ইকোপার্কে সংরক্ষিত বনে অবমুক্ত করা হয়।
মানুষ এবং বন্যপ্রাণীর মধ্যে একটি সহাবস্থান তৈরি এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে বণ্যপ্রাণী ও সাপ নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি লক্ষ্যে কাজ করে স্নেক রেসকিউ টিম বাংলাদেশে। ২০২০ সালে সিদ্দিকুর রহমান রাব্বি টিমটি প্রতিষ্ঠা করেন এবং অনেক কম সময়ের মধ্যেই সদস্যদের প্রশিক্ষণ প্রদান ও উদ্ধার কাজ শুরু করেন। যেকোনো বাসা-বাড়ি কিংবা আখড়ায় কোনো সাপ বিপদাপন্ন এই সংবাদ পেলে তৎক্ষণাৎ হাজির হয়ে যায় ‘স্নেক রেসকিউ টিম বাংলাদেশ’। উদ্ধারের পর তারা সাপটিকে ফিরিয়ে দেন প্রকৃতির কোলে। তাদের প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত রেস্কিউয়াররা বিপদগ্রস্ত অথবা মানুষের বাসস্থানে ঢুকে পড়া কোনো সাপ এবং অন্য বন্যপ্রাণীদের উদ্ধার করে আবার সেগুলো প্রকৃতিতে তাদের অবস্থানে ফিরিয়ে দেন। এছাড়াও অসুস্থ সাপ এবং অন্যান্য বণ্যপ্রাণীর চিকিৎসার মাধ্যমে সেগুলো সুস্থ করে অবমুক্ত করেন।
বালুচরের অজগরের ব্যাপারে এনিম্যাল রেসকিয়ার শ্রীবাস নাথ দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, এলাকাবাসী রাতে আমাদের খবর দিলে সাথে সাথে আমরা গিয়ে সাপটি ধরে বন বিভাগরে কাছে হস্তান্তর করি। পরে তা টিলাগড় ইকোপার্কে অবমুক্ত করা হয়। শ্রীবাস বলেন আমরা বন বিভাগকে পরামর্শ দিয়েছিলাম সাপ ইকোপার্কে অবমুক্ত না করে খাদিম জাতীয় উদ্যানে করার জন্য। তবুও ইকোপার্কে সাপ অবমুক্ত করে দেওয়া হয়। তিনি বলেন আমাদের অভিজ্ঞতার আলোকে ধারণা করছি টিলাগড় ইকোপার্কের আয়তনের তুলনায় সাপের সংখ্যা বেশি। তাই সাপের খাদ্য সংকট দেখা দেওয়ার আশঙ্কা আছে, ফলে কদিন পরপরই সাপ লোকালয়ে খাবারের সন্ধানে চলে যায়। তাই বাস্তবতার আলোকে ইকোপার্কে সাপ অবমুক্ত নিরাপদ নয় বলে আমাদের মনে হয়। এক্ষেত্রে পাশ^বর্তী খাদিম জাতীয় উদ্যানে অনেক জায়গা তাই ওখানে অবমুক্ত করা নিরাপদ। এছাড়া একান্ত যদি ইকোপার্কে অবমুক্ত করতে হয় তবে একটি নির্দিষ্ট স্থান ঘেরাও দিয়ে মুরগ কোয়েল ইত্যাদির যোগানের মাধ্যমে সেই জায়গায় অজগড় অবমুক্ত করা যায়। এতে সাপ বাইরে যাওয়ার আশঙ্কা নেই আবার খাবারেও সমস্যা হবে না।
এদিকে কদিন পরপরই লোকালয়ে সাপ চলে আসার ঘটনায় স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। এলাকাবাসী জানান, এই এলাকায় আমরা অনেক আগ থেকে বসবাস করে আসছি। আমরা আমাদের মতো আর পশুপাখি তাদের মতো বনজঙ্গলে বাস করে। কিন্তু ইদানীং প্রায়ই বাড়িঘরে অজগরসহ বিভিন্ন ধরনের সাপ চলে আসে। রাতবিরাতে এসব কারণে আমরা নিরাপত্তাহীতায় ভোগছি। সাপ দেখলে আমরা বিভিন্ন জনদের খবর দেই, তারা এসে সাপ নিয়ে যায় আবার পাশের ইকোপার্কেই তা ছেড়ে দেয়। ইকোপার্কে ছেড়ে দিলে তা আবার চলে আসার সুযোগ থাকে তাই অজগড় এখানে না ছেড়ে অন্য কোথাও দূরে বনজঙ্গলে ছেড়ে দিলে ভালো।
এ ব্যাপারে বন বিভাগের সিলেট রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা ও ওয়াইল্ড লাইফ রেঞ্জার শহিদুল্লাহ দৈনিক জালালাবাদকে জানান, ইকোপার্কে আর অবমুক্ত না করার বিষয়টি আমাদের বিবেচনায় আছে। টিলাগড় ইকোপার্কের আয়তন অনেক কম মাত্র ১১২ একর, সেই তুলনায় খাদিম জাতীয় উদ্যানের আয়তন ১৭শ একর। আমরা চেষ্টা করি সাপসহ বিষাক্ত কোনো প্রাণী ধরা পড়লে তা খাদিম জাতীয় উদ্যানে অবমুক্ত করতে। বৃহস্পতিবার অজগরটি পরিবহন সমস্যার কারণে টিলাগড় ইকোপার্কে অবমুক্ত করতে হয়েছে।
সিলেট নগরীর উত্তর-পূর্ব কোণে শহর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং সিলেট প্রকৌশল কলেজের কাছে অবস্থিত একটি রিজার্ভ ফরেস্টে টিলাগড় ইকোপার্কের অবস্থান। ফরেস্টের ১১২ একর জায়গা নিয়ে ২০০৬ সালে পার্কটি স্থাপন করা হয়। এটি সিলেট বনবিভাগ, বন অধিদপ্তর, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের ইকোপার্ক প্রকল্প। পার্কটিতে রয়েছে ঘন গাছ-গাছালি এবং নানান প্রকার প্রাকৃতিক উদ্ভিদ ও বৃক্ষরাজি। এখানে বিভিন্ন ধরনের প্রাণীকে বন্য পরিবেশে ঘুরে বেড়ায়। এছাড়াও এর বনবাদাড়ে রয়েছে নানান প্রজাতির সাপ। দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেওয়ার পর বিভিন্ন আলাদা শেডে তারের জালের বেড়া দিয়ে তা সংরক্ষিত রাখা হয়েছে।