কমলগঞ্জে হারিয়ে যাচ্ছে দেশি মাছ, বৃদ্ধি পাচ্ছে হাইব্রিড মাছ
প্রকাশিত হয়েছে : ২৮ আগস্ট ২০২৩, ৫:৩৭:৫৪ অপরাহ্ন
কমলগঞ্জ প্রতিনিধি: মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে চলতি বর্ষা মৌসুমে নদী, নালা, হাওর ও জলাশয়ে পানির অভাবে দেশি মাছের সংকট দেখা দিয়েছে। পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতের অভাবে পানি কম হওয়ায় মাছের প্রজনন কমে গেছে। একই সাথে আগের তুলনায় দেশি জাতের অনেক মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ফলে স্থানীয় বাজারে হাইব্রিড প্রজাতির মাছের বিক্রি বেড়ে গেছে। তবে পরিবর্তিত জলবায়ুতে ও স্বার্থান্মেষী মহলের কারণে মৎস্য সম্পদ সংকুচিত হয়ে পড়ছে। ধ্বংস হচ্ছে দেশীয় প্রজাতির মাছের আবাসস্থল। বাধাগ্রস্থ হচ্ছে প্রজনন সুবিধা, কমছে উৎপাদন ও বিলুপ্তির দিকে যাচ্ছে মৎস্য ও জলজ অনেক প্রজাতি। এসব নানা কারনে দেশীয় প্রজাতির মাছের তীব্র আকাল দেখা দিয়েছে। স্থানীয় মৎস্যজীবিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, একটা সময় কমলগঞ্জ উপজেলার জলাশয় গুলো মৎস্যজীবিরা ইজারা নিতেন। সম্প্রতি কয়েকবছর ধরে বিত্তবানরা এসব লীজ নিয়ে দেশি মাছের প্রজনন নষ্ট করছেন। একই সাথে বিভিন্ন নিষিদ্ধ পদ্ধতিতে জলজ প্রাণি শিকারের কারণে মাছসহ অন্যান্য প্রাণীও বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। ফলে মৎস্যজীবীরা বাধ্য হয়ে এই পেশা পরিবর্তন করছেন। চলতি বর্ষার ভর মৌসুমেও পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতের অভাবে মাছের আবাসস্থল শুকিয়ে যেতে দেখা যায়। ফলে বাজারে যেমন দেশীয় মাছের আকাল তেমনি খামারিদের চাষাবাদকৃত বিদেশী প্রজাতির মাছে বাজার দখল। আমিষের চাহিদা মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ উৎস্য মাছের উৎপাদন হ্রাস পাওয়ায় প্রকৃতিতে হারিয়ে যাচ্ছে সমস্ত মা ও বাবা মাছ।
উপজেলা মৎস্য অধিদপ্তর সুত্রে জানা যায়, ২৬০ প্রজাতির দেশি মাছ ছিলো। বর্তমানে প্রায় ১০০ প্রজাতির দেশীয় মাছ বিলুপ্ত হওয়ার পথে। অনাবৃষ্টির কারণে নদী ও হাওরে পানির অভাবে দেশীয় মাছ সংকট হচ্ছে। একই সাথে নদী ও জলাশয়ে বিষ প্রয়োগ করে মাছের প্রজনন নষ্ট করা ও বিভিন্ন নিষিদ্ধ পদ্ধতিতে মাছ শিকারের কারণে দেশি মাছ কমে গেছে। একই সাথে হাইব্রিড মাছের চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে।
উপজেলার রহিমপুর ইউনিয়নের মৎস্যজীবী সাকিল মিয়া বলেন, ভরা বর্ষা মৌসুমে নদী ও হাওরে পানি না থাকায় মাছ শিকার করতে পারিনি পুরো মৌসুমে। অনেক দিন মাছ শিকারের সরঞ্জাম নিয়ে নদী থেকে খালি হাতে ফিরতে হয়েছে। মাছ শিকার না করলে পরিবারের সদস্যরা অনাহারে দিন কাটাতে হয়।
মৎস্যজীবী বকুল মালাকার, অধন পাল, গৌড়া, শামিম মিয়া বলেন, আমরা সারাজীবন নদী থেকে মাছ শিকার করে বিকেলে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেছি। কিন্তু গত কয়েকবছর ধরে হাওর ও নদীতে গেলে মাছ মিলেনা। বিভিন্ন জায়গা থেকে হাইব্রিড মাছ সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করি। শুষ্ক মৌসুমে নদী সেচ মেশিন দিয়ে শুকিয়ে মাছ শিকার করা হয়। একই সাথে বিষ দিয়ে মাছ ধ্বংস করা হয়। বর্তমানে সময় যতো গড়াচ্ছে ততোই মাছের আবাসস্থল ভরাট হচ্ছে। নিজের খাবারের জন্যও নদী, বিলে মাছ পাওয়া দায় হয়ে পড়েছে। আমাদের পরিবার সংকুলান করাও কঠিন হয়ে উঠছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গত কয়েকদিন ধরে থেমে থেমে বৃষ্টিপাত হওয়ায় জলাশয়গুলোতে কিছুটা পানি চোখে পড়েছে। বর্ষা মওসুমে চাহিদা মতো বৃষ্টিপাত না হওয়ায় একদিকে আমন চাষাবাদে ব্যাঘাত ঘটছে, অন্যদিকে মৎস্যজীবিরাও দুর্বিষহ জীবন ধারণ করছেন। তাছাড়া মৎস্য আইন সম্পর্কে ব্যাপক জনসাধারণের সচেতনতার অভাবে বিভিন্ন সময়ে অপরিকল্পিতভাবে ডিমওয়ালা ও পোনা মাছ নিধন, কারেন্ট জাল ব্যবহার, নদী ও বিল সেচ, নদীতে আড়াআড়িভাবে বাঁশের খাঁটি ও বাঁধ নির্মাণ করে মাছের বংশবিস্তার ধ্বংস করা হচ্ছে।
কমলগঞ্জের হাওর ও নদী রক্ষা আঞ্চলিক কমিটির সদস্য সচিব, পতনঊষার ইউপি সদস্য তোয়াবুর রহমান বলেন, ফি বছর বর্ষা মওসুমে আমরা কেওলার হাওরসহ নদী, ছড়া ও জলাশয় থেকে ছোটবড় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ আহরন করতাম। মৎস্যজীবিদের কাছ থেকেও তরতাজা মাছ কিনে নিতাম। তবে বর্তমান সময়ে মাছের উৎপাদন অনেকটা কমে গেছে।
কমলগঞ্জ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, মানুষ সৃষ্টি সমস্যা ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশীয় মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এখন হাওর আর হাওর নেই। হাওর এখন কৃষি জমি হয়ে গেছে। উপজেলার খাল, বিল, নদী, নালা ভরাট হওয়ার কারণেও মাছের প্রজনন হারিয়ে যাচ্ছে। রাতের অন্ধকারে বিষ প্রয়োগ ও নিষিদ্ধ পদ্ধতিতে অবাধে মাছ শিকার করা হয়। তাছাড়া চাবাগান ও কৃষিক্ষেতে অত্যধিক পরিমাণে রাসায়নিক সার, কীটনাশক প্রয়োগ, আবাসস্থল বিনষ্ট এসব নানা কারণে দেশীয় মাছের সংকট সৃষ্টি হচ্ছে।