জন্ম নিবন্ধনে জনভোগান্তি চরমে :সিসিকে দিনে মাত্র ৩০টি রেজিস্ট্রেশন
প্রকাশিত হয়েছে : ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ৫:১৮:১৬ অপরাহ্ন
এমজেএইচ জামিল :
জন্মনিবন্ধনের সনদ পেতে ভোগান্তির কথা নতুন নয়। প্রায়ই কার্যকর থাকে না নিবন্ধনের সার্ভার, সনদ হাতে পেতে দিনের পর দিন ঘুরতে হয় একজন অভিভাবককে। জন্মনিবন্ধনের আবেদন থেকে শুরু করে সনদ হাতে পাওয়া পর্যন্ত কয়েক ধাপের বিড়ম্বনা ও ভোগান্তিতে পেরিয়ে যায় দীর্ঘ সময়। এছাড়া রয়েছে দালালদের দৌরাত্ম্য। সবমিলিয়ে জন্মনিবন্ধন সনদ পেতে তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হওয়া সুবিধাভোগীদের জন্য নিত্য নৈমত্তিক ব্যাপার। এরমধ্যে জন্ম নিবন্ধনের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের নতুন নিয়মে বিপাকে পড়েছেন সেবাপ্রার্থীরা। ফলে জন্ম নিবন্ধনের জনভোগান্তি এখন চরমে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গেল কয়েক মাস থেকে কখনো দিনের অধিকাংশ সময়, কখনো মাসের অধিকাংশ দিন আবার কখনো পুরো মাস ধরে বন্ধ থাকছে নিবন্ধনের সার্ভার। এরই মধ্যে গত (২৭ আগস্ট) রোববার নতুন নিয়ম চালু করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগের জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের দায়িত্বে থাকা রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়। এখন থেকে ইউনিয়ন-পৌরসভা-ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড ও সিটি কর্পোরেশন পর্যায়ে দৈনিক সর্বোচ্চ ৩০টি এবং জোন অফিসের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ১০০টি নিবন্ধনের সত্যতা যাছাই ও রেজিস্ট্রেশনের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। এর বেশী নিবন্ধন নিচ্ছেনা রেজিস্ট্রার জেনারেলের জন্ম নিবন্ধনের সার্ভার। ফলে সীমাহিন ভোগান্তিতে পড়েছেন জন্ম নিবন্ধন করতে আসা অভিভাবকগণ। এতে বিপাকে পড়েছেন নিবন্ধনের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ। বুধবার সিলেট সিটি কর্পোরেশনের জন্ম নিবন্ধন বিভাগে গিয়ে এর সত্যতা মিলেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সিলেট সিটি কর্পোরেশনের নিবন্ধন বিভাগে প্রতিদিন গড়ে আড়াই থেকে ৩০০ আবেদন জমা পড়ে। এরমধ্যে দৈনিক দেড়শো থেকে ২০০ আবেদন যাছাই ও রেজিস্ট্রেশন করা সম্ভব হয়েছে। গত রোববার থেকে ৩০টির বেশী আবেদন যাছাই ও রেজিস্ট্রেশন করা সম্ভব হচ্ছেনা। ফলে নিবন্ধন করতে আসা সেবাপ্রার্থীদের সাথে নিবন্ধনের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের বাক-বিতন্ডার ঘটনা ঘটছে।
জানা গেছে, গত রোববার (২৭ আগস্ট) জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন রেজিস্ট্রার জেনারেল (অতিরিক্ত সচিব) মোঃ রাশেদুল হাসান স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে দৈনিক ৩০টি জন্ম নিবন্ধন করা হবে বলে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, সম্প্রতি গভীর উদ্বেগের সহিত লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, কোন কোন নিবন্ধক হঠাৎ করে কোন ১ (এক) দিনে ১০০-৫০০ পর্যন্ত নিবন্ধন করছেন। আবার কোথাও অথরাইজড ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড-কে অপব্যবহার করে ১ (এক) দিনে বা রাতে বিপুল সংখ্যক নিবন্ধন সম্পন্ন করা হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে অথরাইজড ইউজার ও নিবন্ধক-কে চিহ্নিত করা যায় এবং তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে বা ব্যাখ্যা চাওয়া হলে তারা দায়িত্ব অস্বীকার করেন। ক্ষেত্রবিশেষ, নানারকম অপাঙক্তেয়, অবান্তর যুক্তির অবতারণা করা হয়। কোথাও কোথাও থেকে এরকম করে নিবন্ধিত অযাচিত জন্ম নিবন্ধগুলো বাতিলের জন্য এ অফিসে পত্র প্রেরণ করা হয়। এতে এ অফিসের কাজ বেড়ে যায়, বিডিআরআইএস’র উপর চাপ সৃষ্টি হয়, সিস্টেমে অনভিপ্রেত জন্ম নিবন্ধন সংযুক্ত হয়, জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়, এ অফিসের ভাবমূর্তির ক্ষুন্ন হয়। এ প্রবণতা রোধ করা জরুরি। এজন্য এখন থেকে নিবন্ধক কার্যালয়গুলো (ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড) প্রতিদিন সর্বোচ্চ ৩০ (ত্রিশ) টি এবং সিটি কর্পোরেশনের ওয়ার্ড পর্যায়ে সর্বোচ্চ ৩০ (ত্রিশ) টি ও জোন অফিসের ক্ষেত্রে নিবন্ধন আবেদনের তথ্যের সঠিকতা যাচাই বাছাই করে সর্বোচ্চ ১০০ (একশ) টি পর্যন্ত রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করা যাবে। এর অতিরিক্ত করা যাবে না, বিডিআরআইএস’র সিস্টেম তা গ্রহণ করবে না। ইহা সংশ্লিষ্ট সকলের অধিক্ষেত্রের সকল নিবন্ধক-কে অবহিত করার জন্য অনুরোধ করা গেল।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর থেকে একটি ইউজার আইডি থেকে সার্ভারে গিয়ে ৩০ টি নিবন্ধন রেজিস্ট্রেশন হচ্ছে। এরপর স্বয়ংক্রিয়ভাবে রেজিস্ট্রেশন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ঐ বিজ্ঞপ্তিতে সিটি কর্পোরেশনের ওয়ার্ড পর্যায়ে ৩০টি এবং জোন পর্যায়ে সর্বোচ্চ ১০০টি আবেদন রেজিস্ট্রেশনের কথা থাকলেও রোববার থেকে ৩০টির বেশী আবেদন যাছাই ও রেজিস্ট্রেশন করতে পারছেনা খোদ সিলেট সিটি কর্পোরেশনের জন্ম নিবন্ধন বিভাগ।
সিলেট সিটি কর্পোরেশনের জন্ম নিবন্ধন বিভাগের দায়িত্বে থাকা সিসিকের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. জাহিদুল ইসলাম দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, আমাদের এখানে প্রতিদিন আড়াই থেকে ৩০০ আবেদন জমা হয়। এর মধ্যে আমরা আগে দৈনিক কমপক্ষে ১৫০ থেকে ২০০টি আবেদন যাছাই ও রেজিস্ট্রেশন করতে পেরেছি। এতে জনভোগান্তি কিছুটা কমেছিল। এবার নতুন নিয়ম নিয়ে আমরা যেমন বিপাকে পড়েছি। তেমনী সেবা নিতে আসা নাগরিকবৃন্দও ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। সিলেট সিটি কর্পোরেশনের পুরনো ৩৬ জন ওয়ার্ড কাউন্সিলার রয়েছেন। প্রতিটি ওয়ার্ড থেকেই কাউন্সিলারগণ আবেদন পাঠান। ওয়ার্ড প্রতি ৫টি করে আবেদন আসলেও ১৮০টি আবেদন জমা হচ্ছে। এরমধ্যে মাত্র ৩০টি আবেদন রেজিস্ট্রেশন করতে গিয়ে আমরা নিজেরাই সমস্যায় পড়েছি।
জানা গেছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি, চাকরিতে যোগদান, পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্রসহ নাগরিক সেবার ১৯টি ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় জন্মসনদের। বলতে গেলে, জন্মনিবন্ধন বর্তমানে একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। যা সবার ক্ষেত্রে আবশ্যিকভাবে প্রয়োজন। এমন কোনো মানুষকে খুঁজে পাওয়া কঠিন যিনি তার সন্তানের জন্য জন্মনিবন্ধন সনদ নিতে ভোগান্তিতে পড়েননি। সাধারণ মানুষের ভোগান্তিকে পুঁজি করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে দালাল চক্র। ‘দ্রুত সময়ে, কোনো ধরনের ঝামেলা ছাড়াই জন্মসনদ দেওয়া হবে’ এমন প্রলোভন দেখিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে টাকা। টাকা দিলেও হয় না সমাধান। সার্ভার নেই, বাবা-মায়ের নামের বানান ভুল, অনলাইন কপিতে সমস্যাসহ নানা জটিলতার অজুহাতে মাসের পর মাস ঝুলিয়ে রাখা হয় আবেদন।
সিলেট সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন এলাকায় কোনো শিশু জন্মগ্রহণ করলে তার মা-বাবাকে প্রথমে ওয়ার্ড কাউন্সিলর অফিসের মাধ্যমে ক্লিয়ারেন্স নিয়ে যেতে হয় সিটি কর্পোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয়ে। সেখান থেকে দেওয়া হয় জন্মসনদ। কিন্তু কোনো ভুল সংশোধন করতে হলে সেটি আর সিটি কর্পোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে করা যাবে না। সেক্ষেত্রে যেতে হবে সিলেট জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে। এছাড়া জন্মসনদ নিতে প্রথমে অনলাইনে আবেদন করে যেতে হয় সিটি কর্পোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয়ে। সেখানে জমা দেওয়ার পর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা তথ্য ইনপুট দেন। পরে সেটি ভেরিফায়েড হয়ে আসে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় থেকে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গেল জুলাই মাসের প্রায় অর্ধেক সময় সার্ভার বন্ধ ছিলো। চলতি আগস্ট মাসেও কয়েকদিন বন্ধ ছিল সার্ভার। চালু থাকলেও কখন ফের বন্ধ হয়ে যায় সেই চিন্তা নিয়েই কাজ করেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাবৃন্দ। বাংলাদেশে ২০০৪ সালে জন্ম নিবন্ধন আইন করা হলেও কার্যকর হয় ২০০৬ সাল থেকে। ২০১০ সালে সার্ভার পরিবর্তন করা হলে দেখা যায়, ২০১১ সালের আগে করা অনেক সনদের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে তাদের আবার নতুন করে জন্ম সনদ করাতে হয়। তবে বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি হলেও জন্ম নিবন্ধনের সংখ্যা ১৯ কোটি ৩৫ লাখের বেশি। ভালো স্কুলে ভর্তি বা বয়স কমাতে একাধিক জন্ম নিবন্ধন এজন্য দায়ী বলে কর্মকর্তারা মনে করেন।
সিসিকের সংশ্লিষ্ট বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারী ও মার্চ এই ৩ মাসে নগরীতে জন্ম নিবন্ধন করেছেন ১১হাজার ৫৭৫ জন। এই ৩ মাসের ৬৬ কর্মদিবসে প্রতিদিন গড়ে নিবন্ধন করেছেন ১৭৫ জনের বেশী। এপ্রিল-মে ও জুন এই ৩ মাসে নগরীতে নিবন্ধন করেছেন ৭ হাজার ৩৭১ জন। এই ৩ মাসের ৬৬ কর্মদিবসে প্রতিদিন গড়ে নিবন্ধন করেছেন ১১১ জনের বেশী মানুষ। তবে এই ৩ মাসে বেশ কিছু দিন সার্ভার বন্ধ ছিলো। এছাড়া কার্যদিবসের অধিকাংশ সময় সার্ভারে ত্রুটিজনিত কারণে ঠিকমতো কাজ হয়নি।
জানুয়ারী থেকে জুন পর্যন্ত ৬ মাসের জন্ম নিবন্ধনের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এই ৬ মাসে নগরীতে মোট জন্ম নিবন্ধন করেছেন ১৮ হাজার ৯৪৬ জন। এই সময়ে ১৩২ কার্যদিবসে প্রতিদিন গড়ে জন্ম নিবন্ধন করেছেন ১৪৩ জন।
সিসিকের সংশ্লিষ্টরা জানান, গত জুলাই ও আগস্ট মাসের অধিকাংশ সময় সার্ভার বন্ধ ছিলো। এতে সেবাপ্রার্থী মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। এখন সার্ভার চালু হলেও দৈনিক ৩০টি আবেদন রেজিস্ট্রেশন করলে জনভোগান্তি আরো বহুগুন বেড়ে গেছে। কিন্তু ৩০ টি আবেদন রেজিস্ট্রেশনের পর কেন্দ্র থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সংশ্লিষ্ট অফিসের কিছুই করার থাকেনা।
সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মতো একই চিত্র বিভিন্ন ইউনিয়ন কার্যালয়ে। দৈনিক ৩০টির বেশী আবেদন রেজিস্ট্রেশন করতে না পারায় জন্ম নিবন্ধনের দুর্ভোগ শহর থেকে গ্রামে সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। দৈনিক রেজিস্ট্রেশনের সংখ্যা বাড়িয়ে জনভোগান্তি দুর করার দাবী সেবাপ্রার্থী মানুষের।