‘যাদুর কাঠি’তে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে শ্রীলংকা
প্রকাশিত হয়েছে : ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ৬:৫২:৫২ অপরাহ্ন
জালালাবাদ ডেস্ক: নিত্যনতুন খাতে বিনিয়োগ নিয়ে এগিয়ে আসছেন বিদেশীরা। জ্বালানি সরবরাহ এখন স্বাভাবিক। খাদ্যপণ্যের দাম কমতির দিকে। রিজার্ভও ঊর্ধ্বমুখী। সব মিলিয়ে অর্থনৈতিক সংকটের দুর্বিষহ দিনগুলো পেছনে ফেলে এসেছে শ্রীলংকা। সর্বশেষ গত মাসেই মূল্যস্ফীতি ৪ শতাংশে নামিয়ে এনেছে দেশটি।
বাংলাদেশের রিজার্ভ থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে কারেন্সি সোয়াপ চুক্তির আওতায় ২০ কোটি বা ২০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছিল শ্রীলংকা। বৃহস্পতিবার রাতে এর মধ্যে দ্বিতীয় কিস্তিতে ১০ কোটি ডলার ফেরত দিয়েছে দ্বীপদেশটি। এর আগে গত ১৭ আগস্ট প্রথম কিস্তিতে ফেরত দিয়েছিল ৫ কোটি ডলার। বাকি ৫ কোটি ডলারও চলতি মাসে ফেরত আসার বিষয়ে আশাবাদী বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তারা। শুধু বাংলাদেশ নয়, অন্যান্য দেশ ও সংস্থার ঋণও এখন একটু একটু করে পরিশোধ করে দিচ্ছে শ্রীলংকা।
চরম দুর্বিপাকে পড়ার দেড় বছরের মধ্যেই লংকাদ্বীপের অর্থনীতির এ প্রত্যাবর্তনকে রীতিমতো ‘জাদুকরী’ হিসেবে দেখছেন বৈশ্বিক অর্থনীতির পর্যবেক্ষক ও বিশেষজ্ঞরা। এর পেছনে মূল কৃতিত্ব দেওয়া হচ্ছে দ্বীপদেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর পি নন্দলাল বীরাসিংহেকে। তার নেতৃত্বে সেন্ট্রাল ব্যাংক অব শ্রীলংকার (সিবিএসএল) নেওয়া পদক্ষেপগুলোই দেশটিকে কার্যকরভাবে সমৃদ্ধির পথে ফিরিয়ে এনেছে বলে মনে করা হচ্ছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় গত জুলাইয়ে দেশটির প্রেসিডেন্ট ও অর্থমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে সেপ্টেম্বরের মধ্যেই দেউলিয়াত্ব থেকে বেরিয়ে আসার ঘোষণা দিয়েছিলেন। এ লক্ষ্য পূরণে তার সবচেয়ে বড়ো ভরসার জায়গাও এখন নন্দলাল বীরাসিংহে।
প্রতি মাসেই মূল্যস্ফীতির পরিস্থিতি নিয়ে নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে শ্রীলংকার স্ট্যাটিস্টিকস ডিপার্টমেন্ট। এ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত মাসে দেশটিতে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার নেমে এসেছে ৪ শতাংশে। এর আগে জুলাইয়ে এ হার ছিল ৬ দশমিক ৩ শতাংশ। বিশেষ করে খাদ্যদ্রব্যের ক্রমহ্রাসমান দাম ভোক্তা পর্যায়ে স্বস্তি ফেরানোর পাশাপাশি খাদ্য মূল্যস্ফীতির হারকে এখন শূন্যেরও নিচে নামিয়ে আনা হয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসার বিষয়টিকে লংকান অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরে আসার লক্ষণ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। অথচ ছয় মাস আগে গত ফেব্রুয়ারিতেও দেশটিতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫০ শতাংশের বেশি। এর আগে গত বছরের সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৬৯ দশমিক ৮ শতাংশে। সে সময় খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে দাঁড়ায় ৯৪ শতাংশে।
সিবিএসএলে নন্দলাল বীরাসিংহে ও তার সহকর্মীরা এতদিন শ্রীলংকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনার ওপর জোর দিয়েছেন সবচেয়ে বেশি। সেটি নিয়ন্ত্রণে আসায় তারা এখন মনোযোগ দিচ্ছেন অর্থনীতিকে প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরিয়ে আনার ওপর। গত বছর দেশটির অর্থনীতি সংকুচিত হয়েছিল ৭ দশমিক ৮ শতাংশ। চলতি বছর তা ২ শতাংশে নেমে আসার পূর্বাভাস রয়েছে। এ অবস্থায় প্রবৃদ্ধিকে উৎসাহিত করতে শিগগিরই সুদহার ২০০ বেসিস পয়েন্ট (২ শতাংশ) কমিয়ে আনার কথা ভাবছে সিবিএসএল। এর আগে জুন ও জুলাইয়ে সুদহার ৪৫০ বেসিস পয়েন্ট (সাড়ে ৪ শতাংশ) কমিয়েছিল দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যদিও এর কিছুদিন আগেও মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে আগ্রাসীভাবে বাড়ানো হয়েছে সুদহার। চলতি বছরের এপ্রিল ও মার্চে শ্রীলংকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদহার বাড়িয়েছিল রেকর্ড ১ হাজার ৫০ বেসিস পয়েন্ট (সাড়ে ১০ শতাংশ)।
নন্দলাল বীরাসিংহের নেতৃত্বে সিবিএসএল অর্থনৈতিক প্রত্যাবর্তনের পথে নিয়ে এলেও শ্রীলংকার অর্থনৈতিক দুর্বিপাকের পেছনে সবচেয়ে বেশি দায় দেওয়া হয় সাবেক রাজাপাকসে সরকারের আমলের কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। এক সময় ক্রমাগত রুপি ছাপিয়ে বাজারে তারল্য বাড়িয়ে তুলছিল সিবিএসএল। বিশেষ করে প্রতিষ্ঠানটিতে নন্দলাল বীরাসিংহের দুই পূর্বসূরি ভিলাগামাগে ডন লাক্সমানের ও অজিত নিভার্দ কাবরালের সময়ে মুদ্রা ও রিজার্ভ পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি দেখা দেয়। ডন লাক্সমানের অধীনে ক্রমাগত মুদ্রা ছাপিয়ে সমালোচনার শিকার হয় সিবিএসএল। আর অজিত নিভার্দ কাবরালের সময়ে ভুল মুদ্রানীতির কারণে ডলারের বিপরীতে লংকান রুপির টানা অবমূল্যায়ন ও রিজার্ভে চাপ পড়ার অভিযোগ ওঠে। বিশেষ করে রিজার্ভ শূন্যের কাছাকাছি নেমে আসায় ডলারের অভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিও বন্ধ করে দিতে হয় শ্রীলংকাকে। একই সঙ্গে পাওনাদারদের দেনা পরিশোধ করতে না পেরে ২০২২ সালের এপ্রিলের মাঝামাঝি নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণায় বাধ্য হয় দেশটি।
চূড়ান্ত বিপর্যয়ের ওই মুহূর্তে সিবিএসএলের ১৭তম গভর্নর হিসেবে লংকাদ্বীপের আর্থিক ও মুদ্রা ব্যবস্থার হাল ধরেন আপাদমস্তক ক্যারিয়ার সেন্ট্রাল ব্যাংকার ড. নন্দলাল বীরাসিংহে।
মুদ্রানীতি ও বিনিময় হার বিশেষজ্ঞ নন্দলাল বীরাসিংহে দায়িত্ব নিলেও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বেশ কিছুদিন নিজের ক্যারিশমা দেখানোর সুযোগ পাননি। কেননা আর্থিক দেউলিয়াত্ব, লাগামহীন মূল্যস্ফীতি, খাদ্য ও জ্বালানি পণ্যের সংকট ক্ষুব্ধ লংকাবাসীকে রাস্তায় নামিয়েছিল। ভেঙে পড়েছিল রাষ্ট্র ও প্রশাসন। রাষ্ট্র ও সরকারের নির্বাহী প্রধানরা দেশ ছেড়ে পালাচ্ছিলেন। এমন এক পরিস্থিতিতে ২০২২ সালের মে মাসের মাঝামাঝি এক বক্তব্যে নন্দলাল বীরাসিংহে বলেন, ‘অনতিবিলম্বে সরকার গঠন না হলে শ্রীলংকার অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের আর কোনো আশাই থাকবে না।’ তার সে হুঁশিয়ারির মধ্যেই নতুন করে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সরকারপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন রনিল বিক্রমাসিংহে। এর পরও দেশটিতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না ফেরায় পদত্যাগের হুমকি দেন ড. নন্দলাল বীরাসিংহে।
গোতাবায়া রাজাপাকসে ক্ষমতা ছাড়ার পর দেশটিতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরতে থাকে। নন্দলাল বীরাসিংহেও শ্রীলংকার আর্থিক ও মুদ্রাবাজার খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগী হওয়ার সুযোগ পান। যদিও মূল্যস্ফীতি ততদিনে নিয়ন্ত্রণের প্রায় ঊর্ধ্বে, যা সেপ্টেম্বরে গিয়ে দাঁড়ায় রেকর্ড সর্বোচ্চে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে আগ্রাসীভাবেই সুদহার বাড়াতে থাকে শ্রীলংকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আগ্রাসী সুদহার নীতির সুফলও মিলতে থাকে। নিয়ন্ত্রণে আসে ঋণের প্রবাহ। আবার এ বর্ধিত সুদহার নির্ধারণের ক্ষেত্রে অনুসরণ করা হয় বাজারভিত্তিক পদ্ধতিকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা (বিশেষ করে ডলার) ক্রয়-বিক্রয়ের প্রবণতাকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ঠেকানো হয় রুপির বিনিময় হারে পতনকে। এক পর্যায়ে ডলারসহ অন্যান্য মুদ্রার বিপরীতে লংকান রুপির বিনিময় হার বাড়তে থাকে।
ব্যাংকগুলোয় নগদ অর্থের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হয় নানামুখী পদক্ষেপ। ঋণ বাড়ানোর পরিবর্তে তফসিলি ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নির্দিষ্ট হারে তারল্য আমানত হিসেবে জমা রাখতে বলা হয়। সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিলেও তা ছাড় করায় নগদ অর্থের পরিবর্তে ব্যবহার হতে থাকে বিনিময়যোগ্য অন্যান্য সম্পদ। এতে বাজারে বা ব্যাংকগুলোয় তারল্য প্রবাহ না বাড়লেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বাড়তে থাকে।
২০২২ সালের অক্টোবরে প্রথম দেশটির খাদ্য ও জ্বালানি খাতে পণ্যের প্রাপ্যতা বেড়ে যায়। এছাড়া দেশটিতে সরকারি বন্ডের সুদহারও বাড়িয়ে তোলেন বীরাসিংহে। একই সঙ্গে ২০২৩ সালেরও মূল্যস্ফীতিকে ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার লক্ষ্যও ব্যক্ত করেন তিনি, যা গত মাসে অর্জন করতে সম্ভব হয়েছে।
সিবিএসএল জানিয়েছে, গভর্নর হওয়ার আগে ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠানটির ডেপুটি গভর্নর হিসেবে পদোন্নতি পান ড. পি নন্দলাল বীরাসিংহে। সে সময় তিনি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে (আইএমএফ) ভারত, শ্রীলংকা, বাংলাদেশ ও ভুটান বিষয়ক অল্টারনেট এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টরের পদে নিয়োজিত ছিলেন। যদিও ডেপুটি গভর্নর হিসেবে তার পদায়ন হয় পরের বছর ২০১২ সালে। আইএমএফে পাঠানোর আগে তিনি সিবিএসএলের অ্যাসিস্ট্যান্ট গভর্নর এবং ইকোনমিক রিসার্চ বিভাগের চিফ ইকোনমিস্ট ও ডিরেক্টর হিসেবেও কাজ করেছেন।